গুড মর্নিং, কলকাতা/৪০
রেনেসাঁস শুরু হয় প্রথম বলিরেখাটিকে ঘিরে।
তাই এই সময়টায় ত্বকের যত্ন নেবেন না। হু হু বাতাস, শুকনো হাওয়া আর ক্লিফ রিচার্ডসের গান আপনার জন্য মাইন বিছিয়ে রাখবে। চোখের নীচে আঁকা হবে উত্তর কলকাতার সরু গলি। চেস্ট অফ ড্রয়ারের গোপন কুঠুরি থেকে দেবব্রত বিশ্বাসের এল পি রেকর্ড বের করে আনার আগে, পুরনো গ্রামোফোন ডাস্টিং করার আগে, ফ্যাব ইন্ডিয়ার ডার্ক শেডের শাড়িতে নতুন ন্যাপথলিন গুঁজে দেবার সামান্য আগেও ত্বকের যত্ন নেবেন না।
এই সময়টাই অসহ্য। কাঞ্চন ফুল ফুটতে শুরু করেছে ইতিউতি। উটের থাবার মতো পাতা। ক্যামেল ফুট বা মাউন্টেন এবোনি…যে কোনও নামেই আপনি ডাকতে পারেন। শুধু ত্বকের যত্ন নেবেন না, প্লিজ। ক‘দিন বাদে, এ মাহ ফাগুনে গুলাল উড়বে। খুনিয়া রং যেন পরপুরুষ। ইচ্ছেমতো হাইলাইট করে দেবে। শুক্লপক্ষে আকাশ পরিষ্কার। শুটিং স্টারদের সাথে মোম জোছনার ব্যাপক সেলফি। আসি আসি বলে জ্যোৎস্না ফাঁকি দেবে না। বেদের মেয়েরা কথা রাখবে। ‘খোকা হোক‘, ‘খোকা হোক‘ ডাকে মুখর হবে বৈকন্ঠপুর বনক্ষেত্র। আপনি ভাববেন ‘পিউ কাঁহা‘,’পিউ কাঁহা‘। যাই ভাবুন, মিলন হল দোঁহে। আপনার ভাবনার আকাশে সারারাত সলমাজরি। মৌন হয়ে থাকাটাই যৌনতার নতুন পাসওয়ার্ড। মোটমাট, এই মোম জোছনায় ত্বকের কোনোরকম যত্ন নেবেন না।
রেনেসাঁস শুরু হয় প্রথম বলিরেখাটিকে ঘিরে।
‘গুড মর্নিং, কলকাতা‘ চল্লিশে পা দিল। দ্বিতীয় বসন্ত। রাধারও এখন ফর্টি প্লাস। পুরনো লিরিক শোনার বয়েস। ওদিকে, রহিমাবাদ চা-বাগান ধামসা মাদলে মেতে উঠেছে। শুশুনিয়া পাহাড়ের বাহুমূলে বনতুলসীর ঝাঁঝ। রোহিনীর রাস্তায় আলপনা এঁকে দিচ্ছে দুইশো সিসির মাচো বাইক। কলকাতার খোঁপায় করৌঞ্জ ফুল। এসময়, সিঁধকাঠি শান দেবার সময়। নদীর ফলস্ ‘পাড়‘ ভাঙার দিন। শেকহ্যান্ড দূরত্বে মৃত্যুকে রোমান্স শেখানোর বিকেল। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া দূরত্বে মৌন হয়ে থাকাটাই আপনার যৌনতার নতুন পাসওয়ার্ড। স্পীচ ইজ গ্রেট, সাইলেন্স ইজ গোল্ড। এই হিরণ্ময় নীরবতা ভীষণ বাঙময়। ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে …
রেনেসাঁস শুরু হয় প্রথম বলিরেখাটিকে ঘিরে।
.
এই সময় ত্বকের যত্ন নিতে নেই। কপি দ্যাট।
গুড মর্নিং, কলকাতা/৩৯
সব সত্যি হলে কেউ আর স্বপ্ন দেখত না। পরিযায়ী পাখিরা হাজার মাইল দূরে এসে প্রেম করত না। সূর্যের নীচে কোনও ডটেড লাইন থাকত না। মফস্সলের কবিরা গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলত না। মানুষের বুকে ঠান্ডা ইস্পাত ছোঁয়ানোর আগে বুক কেঁপে যেত মানুষের। সব সত্যি হলে মাঝরাতে মিথ্যে স্বপ্নে ঘুম ভাঙত না, স্বপ্নে ছুঁয়ে দেখা কবিতা দিনের বেলা ভাবতেও ভয় করত না স্মোকি চোখের বালিকাদের।
শহরে কেউ আর কবিতা লেখে না। স্রেফ দু-লাইন লেখার জন্য সবাই সর্ষে খেতের পাশে আসে। সত্যিকারের কাঁচা কবিতারা উঠে আসে আলপথ ধরে। শহরে কেউটে থাকে, আলকেউটে নয়। শহরের ফেরিওয়ালারা কেউ আর জ্যোৎস্না রঙের ব্রা ফেরি করে না। শহরে ফুলছাপ প্যান্টিও আউট অফ স্টক। শহরের দম আটকে আসছে। গ্রাম ঘিরে ফেলেছে কংক্রিটকে। জীবনানন্দ সভাঘরে যে এত কালো মানুষের ভিড় হবে দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি কেউ।
সব সত্যি হলে কেউ আর স্বপ্ন দেখত না। জিওল মাছের মতোই, মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনত আমাদের দানাদার গুচ্ছ ভালোবাসা। সব সত্যি হলে ট্রেন লেট করত না, কবিতার হোর্ডিং-এ ভরে যেত হিলকার্ট এবং রাজমহল রোড। নাম না জানা গলিপথ গুলোও। ‘মরিয়ম মেয়ে‘ রা স্কিনি জিন্সের বদলে লাল-কালোর তুখোড় কম্বিনেশনে কিস্তিমাৎ করে দিত। সব সত্যি হলে পানশালায় আদা কুচি থাকত না, উৎপলকুমার বসুর কবিতা মুখে মুখে ফিরত। ভাগ্যিস সব সত্যি হয় না। ভাগ্যিস।
শহরে কেউ আর স্বপ্ন বোনে না। হেমসেলাই দেওয়া স্বপ্নের দিন গিয়াছে। শহর ভর্তি বজরা। ডিঙি নৌকা অ্যান্টিক পিস। তবু সুখী রমণীর দিবাস্বপ্নেও ছলাৎছল! ফোর্ট উইলিয়ামে এত পাহারার মধ্যেও ঝাড়বাতি চুরি হয় কোন অঙ্কে? শহর সুখে নেই। শহরে কোকিলের মাথাখারাপ হয় না। যে শহরে মেয়েরা স্বপ্ন দেখে ঘেমে ওঠে না, যে জনপদে মেয়েদের কপালে ঘামের ছাড়পত্র নেই… আমি সেই শহরকে ঘিরে ফেলব। গ্রাম দিয়ে। প্রমিস।
সব সত্যি হলে কেউ আর স্বপ্ন দেখত না। সক্কলে ঘুমনোর আগে খাটের নীচে টর্চের আলো ফেলে দেখে নিত। সব সত্যি হলে তোমার লাল-কালোয় হুলিয়া জারি হতো, শহরে মার্চ পাস্ট করত খোজা সৈন্যের দল। পাহারা দিত কম্যান্ডোবাহিনী। পোস্টবক্স ভরে যেত প্রেমের চিঠিতে। ভুল বানান, ঘামে ভেজা এইসব চিঠিতে ঠিকানা লেখা নেই। এক একটা চিঠির গায়ে তিসিফুলের গন্ধ, একএকটা নীলখামে মৃত পুরুষের হাসিমুখ। ছেলেদের কাঁদতে নেই, শহর শিখিয়েছে।
সব সত্যি হলে কেউ আর স্বপ্ন দেখত না। সবাই রাত জাগত আর সতর্কবাণীতে ছেয়ে যেত মূর্খের সিলেবাস। অবরুদ্ধ শহরে টহল দিত হুডখোলা জিপ। ক্লাচ আর অ্যাক্সিলেটরের নিখুঁত খেলায় মেতে উঠত কবিরা। স্টিয়ারিঙে বসা ডোকরার ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যেত ট্র্যাফিক সিগনাল।
ভাগ্যিস স্বপ্ন সত্যি হয় না। নইলে সবাই রাত জাগত।
আর জেগো না, রাত জেগো না, রাত জেগো না রাই। রাতের এখন তৃতীয় প্রহর, শিশির পুড়ে ছাই।
গুড মর্নিং, কলকাতা/৩৮
জয়ন্তী রিভার বেডে একটা নিঃসঙ্গ পলাশ গাছ আছে। প্রতিটা ব্যর্থ প্রেমের আগে পরে সেই বেদনাহত গাছে পলাশ ফোটে। বিকেলের মনখারাপ হয় যখন, তার ঠিক আগে পরে সেই গাছে আগুন লাগে। আগুন বলে আগুন, ঘুমোতে না দেওয়া আগুন, বৃষ্টি নামানো আগুন, চিনচিনে ব্যথার মত পলাশ রঙের আগুন। ফাগ ওড়া বসন্তদিনে, কোকিল ডাকা বসন্ত রাতে সেই আগুন ছড়িয়ে যায় বালাপোষ থেকে বালাপোষে। এমন বিষন্ন কালারপ্যাস্টেলে কেউ যেন ছবি না আঁকে। বসন্ত একটা ব্লাইন্ড লেন। শশিভূষণ দে স্ট্রিটে তখন স্প্যাথোডিয়া ফোটে। রুদ্রপলাশ, রুদ্রপলাশ। ‘অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই‘।
রাত্রি গভীর হলে যূথবদ্ধ ঐরাবত আসে জয়ন্তী নদীর কিনারায়। নিঃসঙ্গ পলাশের পাতাহীন ডাল থেকে চুুঁইয়ে পরে নিকষিত হিম। স্তনভারে আছে (যে) দেহ স্তোক নম্র হয়ে, সে আগুনের গাছ এক অনন্ত প্যারাডক্স। ব্রেনফিভার পাখির ডাক সামান্য অনুষঙ্গ মাত্র। স্বচ্ছ লঁজেরি যেমন, অনিঃশেষ এক পেঁয়াজের খোসা। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। পলাশের ডাল নুয়ে আসে রমণের গুণে। বসন্তের এই অদ্ভুত এক মাতাল সমীকরণ। পাগলা খাব কি, ঝাঁঝেই মরে যাব। ‘অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই‘।
জয়ন্তী রিভার বেডে একটা নিঃসঙ্গ গাছ আছে। আছে তো আছে। সে আছে তার মতো। উত্তরের অপেক্ষা না করে নদী আর নুড়ি নিয়ে, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিয়ে আছে একরকম। জনপদ উপেক্ষা করে, মালভূমি উপেক্ষা করে, রুক্ষ মাটিকে অস্বীকার করে এ এক নিঃশব্দ দ্রোহ। বন্দুকের নল নেই, হিলকার্ট রোডের হারিয়ে যাওয়া কাঠের বাড়িগুলোতে কোনও ফিসফিস নেই, মাহিন্দ্রা উইলিস জীপ নেই, নিভে আসা হেডলাইট নেই… শুধু নদীতটে একা দাঁড়িয়ে থাকা আছে। ‘একা এবং একক‘। নিরুচ্চার দ্রোহ। শেষ শীতে সেই গাছে ভেলভেটের মত ফুল আসে। আগুন রঙের ফুল। পলাশ। কলকাতা শহরে বসে আমি সেই আগুনের তদন্তে নামি। ক্লু খুঁজতে থাকি চরের বুকে জেগে ওঠা হঠাৎ নদীটির কাছে, চোখ গেল পাখিটির কাছে, মিছিলের ভিড়ের কাছে। দিক আর দিগরের কাছে। তবু, ‘…আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই‘।
বসন্তকালে কলকাতা এয়ারপোর্টের একটা ট্রলিতেও অচল চাকা নেই। বসন্তকালে কোনও ট্যাক্সি রিফিউজ করে না।ওরে গৃহবাসী, মার্চে অনর্থক আঁচল ঠিক করা নেই। মার্চ একটি প্রেমের ঋতু। মার্চে কেউ পাশ ফিরে শোয় না।
জয়ন্তী রিভার বেডে একটা আগুন রঙের নিঃসঙ্গ পলাশ গাছ আছে। রাতপাহারা দিতে দিতে সে যূথবদ্ধ ঐরাবতের বৃংহণ শোনে। তার ভেলভেটে চাঁদের আলো পিছলে যায়। গাছটির মখমলে পতঙ্গ উড়ে আসে। আগুন আর পতঙ্গের পুরনো গল্প। ওল্ড কামারাদারি।
বসন্তে আমি ষড়যন্ত্রের মাদুর পাতি। বসন্ত গুমখুনের শ্রেষ্ঠ সময়।
‘অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই‘।