আমজনতারকারবার

মোনালিসা বিশ্বাস

 

অনেকে যেমন বলেন আমিও তেমনি বলি, গরম কাল সহ্য করার একটাই কারণ— আম। তবে ছোট থেকে আমের সাথে আমার তেমন কোনো মাখামাখি সম্পর্ক ছিল না। শুধুমাত্র সকালে, স্কুল থেকে ফিরে আর রাতে আম খেতাম আমি, ব্যস। কস্মিনকালেও আম ছোট টুকরো করে কেটে খাই নি। খোসা ফেলে দুটো চাকলা, একটা আঁটি এই ভাবে খেতাম, তবে ঐ যে বললাম মাখামাখির সম্পর্ক ছিল না তাই দুটো তিনটের বেশি খেতাম না। আর ছিল আম ভাল করে ধুয়ে ছোট্ট ফুটো করে খাওয়া। এটা অবশ্য খাওয়া নয় চাখা। আমাদের বাড়ির লোক খেয়েই বেঁচে আছে মানে জামা কাপড়ের কথা কেউ বিশেষ ভাবে না কিন্তু খাবার নিয়ে ট্যাঁ ফোঁ চলে না। আমার বাবা খেতে খুব ভালোবাসত, মা খাওয়াতে। আমাদের বাড়িতে কেউ কখনো জিজ্ঞাসা করে না আম দেব? ব্যস কেটে দিয়ে দেয়।প্রতি বছর হরেদরে একশ কেজি, হ্যাঁ একদম ঠিক একশ কেজি আম আসত আমাদের বাড়ি, মা আর তার দুই ছা মিলে যা কিনত তাতে এটা হত। এখন মা অসুস্থ বলে পরিমাণ কমেছে।
তা এক এক জনের পছন্দ এক এক রকম আমার ছোটভাই( আসলে দাদা) হিমসাগর ছাড়া বাকিদের মানুষ মানে আম মনে করে না, বড় জোর ল্যাংড়াকে নম্বর দেবে। খাবার পর সে আম খেতে পছন্দ করে(সকাল, দুপুর,রাত)। বড়ভাই আমের ব্যাপারে অমায়িক, আমুদে। সে ভোর থেকে মাঝ রাত অবধি আম খেতে পারে যখন তখন। আমের ঝুড়ি থেকে আম নিয়ে ফুটো করে খেয়ে তাকে ফুলিয়ে রাখায় পারদর্শী আমার বড়ভাই। আর আম নিয়ে তার বিশেষ বাছবিচার নেই, বলে আম হল রাজা ফল, তার আবার জাত কী? বলেই একটা খেয়ে নেয়।
আর আম আর মাকে নিয়ে স্মৃতি বলতে দুটো পরিষ্কার ছবি। মা দুহাতে আম ভরা থলে টানতে টানতে বাজার থেকে হেঁটে( পা থাকতে রিক্সায় কেন তত্ত্বে বিশ্বাসী) বাড়ি অবধি এসে নীচ থেকে হাঁক মারত থলে উপরে নিয়ে যেতে, আমি ছোটবৌদি ছুটতাম আর বড় ঘরের মেঝেতে(বসার ঘর) মা পা ছড়িয়ে বসে আম কাটছে, দিচ্ছে, খাচ্ছে। মা আম খেয়ে মেঝেতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তো অনেক সময়, ঘুম থেকে উঠে আবার আম খেত। মা আর বড় ভাইয়ের বিশেষ ক্ষমতা ছিল, ওরা আঁটি সাদা করে ফেলত একেবারে। বড় ভাই এখনো করে। আমার এসব বাড়াবাড়ি মনে হত তাই মা আমায় তৃতীয় সুর+ষষ্ঠ সুর আখ্যায় ভূষিত করত জেন্ডারের কথা না ভেবেই, আমার নাকী মানুষ হবার চান্সও নেই (তখন বলত) নিছক আম কম খাই বলে এহেন বেচারী আমি মানুষ হবার অন্য উপায় ভাবতে থাকতাম।
আমাদের বাড়িতে আলাদা খাবার ঘর থাকলেও বড় ঘরেই চিরকাল খাওয়া হত,রাতের বেলা সব্বাই একসাথে গোল করে বসে। খাবার শেষে মা আম কেটে সাপ্লাই দিত, পরে ছোটবৌদি, বড়বৌদি কিছু সময়। কাটছে, দিচ্ছে, হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ক্ষুদে দুটোও আমভক্ত হনুমান।
আমি বড় হলাম, আমের সাথে মাখামাখি বাড়ে নি তবে বুঝেছি গাছে আমের মুকুল আসা থেকে উত্তেজিত থাকি আমি। তার গন্ধ, গুটি ধরা, যৌবন লাভ, রাঙা হওয়া অবশেষে আঁটি হয়ে বাতিল হওয়া অবধি লক্ষ্য করি আমি। শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরের জানলার সামনে আমগাছ। রাস্তায় ফলন্ত গাছ দেখে পা আটকে যায়। খাই না খাই আমার চার পাশে আম থাকা চাই, দেখেও সুখ। বাড়ির বাকিদের কিছু প্রভাব তো পড়বেই, তাই না? হ্যাঁ আমি আ-মোহিত, আ-মোদিত একটি প্রাণ। তবে খাওয়া বাড়াইনি বলে বোধহয় মায়ের চোখে মানুষ হই নি আজও ?
(এ শুধু আমার পরিবারের পাকাআমানিবাস শোনালাম, কাঁচা আমের কেচ্ছা গাইলে আরো দু’ পাতা বেশি হত)?

Be the first to comment

আপনার মতামত...