জয়ন্ত বসু
চারপাশে নিকষ কালো, এক কথায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। দুপাশে বেশ খানিকটা দূরে দূরে কখনও জঙ্গল, কখনও ছোট ছোট গ্রাম। মাঝে মধ্যে আলোর ফুটকি। ওগুলো নাকি সোলার আলো, স্থানীয় ভাষায় “ছোলার আলো”। ভটভটির সারেঙ্গকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি রাস্তা চিনছেন কী করে?” দুপাশে বিস্তৃত বিদ্যা নদীর উপর দিয়ে দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে সারেঙ্গ সাহেব বললেন “কেন? আমরা তো ওইখানে যাব!” অনেক কষ্টে বাড়ানো আঙুল অনুযায়ী তন্নতন্ন করে তাকিয়ে শেষমেশ উদ্ধার করা গেল দুটি আলোর ফুটকিকে। যারা নাকি গন্তব্য ঘাটে লাগানো দুটি সোলার এবং যাদের দেখে সারেঙ্গ সাহেবরা রাতের পর রাত গাঁয়ে পৌঁছন, ঘরে পৌঁছন! যদি কখনও ওই সোলার আলোগুলি হঠাৎ খারাপ হয়ে যায় বা হঠাৎ উড়ে আসা মেঘে ঢেকে যায় চারপাশে, তবে কী করে দিক চিনবেন নৌকা বা ভটভটির চালকরা? প্রশ্ন করতে সাহস পাইনি।
আসলে সুন্দরবনে জীবনটা এমনই। দিনে-রাতে অর্ধেকের বেশি সময় জোয়ারের জলের তলায় থাকা, সম্প্রতি সুন্দরবনের একাংশে গ্রিডের বিদ্যুত পৌঁছালোও এখনও অধিকাংশ জায়গাতেই সোলার বিনা আলো নেই, আবার এমনকি সোলারও নেই এমন জায়গাও কম নয়। না আছে পাকা রাস্তা, না পাকা বাড়ি। যাতায়াত বলতে জলে ডিঙ্গি নৌকা বা ভটভটি আর পাড়ে কোথাও সাইকেল বা ভ্যান রিক্সা কোথাও বা বড়জোর ট্রেকার বা অটো। তথাকথিত পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বালাই নেই। কোনও বড় ধরনের অসুস্থতা হলে মাইলের পর মাইল ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পৌঁছতেই প্রাণ চলে যায়। শিক্ষার অবস্থা খানিকটা ভালো, নিয়ম করে বেশ কিছু স্কুল আছে সুন্দরবন জুড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্কুলছুটের শেষ নেই। এত কিছুর উপরে আছে, জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। যত জঙ্গলের খাবার কমছে ততই বাঘের আনাগোনা বাড়ছে মানুষ থাকে এমন দ্বীপগুলিতে। বস্তুত ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়ের আগে পৃথিবী জুড়ে খুব কমজনই সুন্দরবনকে বাঘের বাসস্থানের বেশি কিছু জানতেন। আয়লার পর অধিকাংশ মানুষ জানতে পারলেন, হ্যাঁ এখানে মানুষ আছে। একটি দুটি নয়, সাকুল্যে প্রায় আধ কোটি; অর্থাৎ কলকাতা পুরসভা এলাকার প্রায় সমান এবং প্রসঙ্গত এই মানুষদের মধ্যে দরিদ্রের হার প্রায় ৪২ শতাংশ যা দেশ ও রাজ্যের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। সব মিলিয়ে এ এক অদ্ভুত মিশেল; বাঘ আছে; কাজ নেই, দারিদ্র্য আছে; রাস্তা নেই, হঠাৎ ঝড় আছে; ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, লিস্টটা ইচ্ছে করলেই রবার ব্যান্ডের মতো বাড়ানো যাবে। আর হ্যাঁ, মোবাইল আছে। সরকারের পরিকল্পনায় নয়, বাজারি নিয়মে।
এত কিছু সত্ত্বেও সুন্দরবন বেশ ছিল। গত প্রায় ২০০ বছর, যখন থেকে ইংরাজ শাসকদের অনুমতি নিয়ে জমিদাররা বসতি গড়তে শুরু করেন। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবন বিপন্ন হল। এটা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বজুড়ে যে অঞ্চলগুলি সবচেয়ে বিপন্ন সেই তালিকায় একেবারে উপরদিকের নাম সুন্দরবন। বিপদ দ্বিমুখী। একদিকে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন গোটা অঞ্চলজুড়ে অতি প্রবল ঝড় ও সাইক্লোনের সংখ্যা ও সম্ভাবনা বাড়ছে, অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে সমুদ্রের জলতট বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই কমছে স্থলভাগ। ২০০৯ সালে আয়লা থেকে শুরু হয়ে একের পর এক ট্রপিকাল সাইক্লোনের জন্ম হয়েছে গোটা অঞ্চল জুড়ে। কখনও সিডার কখনও নার্গিস, কখনওবা হুদহুদ। ঝড়ের গতি ২০০ কিমি ছাড়ানো তো এখন হিন্দি সিনেমার ২০০ কোটি টাকা বাণিজ্য করার মতো জলভাত। তবে বোধহয় আরও বড় বিপদ হচ্ছে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন গড়পড়তা বছরে ৮ মিলিমিটার করে সমুদ্রের জল উঠছে ভারতীয় সুন্দরবনে। দ্বীপগুলি বসে যাচ্ছে চার মিলিমিটার; সবমিলিয়ে প্রতিবছর ১২ মিলিমিটারের কমবেশি জল আর স্থল কাছাকাছি হচ্ছে। লোহাচরা দ্বীপ ডুবে গেছে, নব্বইয়ের দশকে ডুবে গেছে মুন আইল্যান্ড; ভারত বাংলাদেশের সংযোগস্থলে থাকা একটি দ্বীপ। ডোবার মুখে ঘোড়ামারা। আগামীকাল ডুববে মৌসুনি। তর্কের খাতিরে যদিও মেনে নেওয়া যায় সুন্দরবনের নতুন করে চর তৈরি হচ্ছে তবুও যোগবিয়োগের পর বিশেষজ্ঞদের হিসাবে বিয়োগের অংশই অনেক বেশি। গত ছয় দশকে কলকাতা শহরের থেকেও বড় অংশের জমি ডুবে গেছে সুন্দরবনে। হঠাৎ বিপদের উদাহরণ হাতের কাছে। বছর দুয়েক আগে কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ করে ফুঁসে উঠল মুড়িগঙ্গা। বাঁধ ভেঙে ও টপকে এক রাত্রে প্লাবিত হল ১৪টি গ্রাম। মাথার উপর ছাদ হারালেন পঁচিশ হাজার মানুষ।
সুন্দরবনের তিনভাগের প্রায় দুভাগ বাংলাদেশ। ভারতীয় ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধ্যে মিল যেমন অজস্র তেমন পাশাপাশি অমিলও চোখে পড়ে বিশেষজ্ঞদের চোখে। বিখ্যাত পরিবেশ সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশানাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (IUCN)’ দ্বারা প্রস্তুত একটি রিপোর্টে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনকে নিম্নলিখিত ভিত্তিতে তুলনা করা হয়েছে–
১) নদী : সুন্দরবন নদীর দেশ। বাংলাদেশ সুন্দরবন তৈরি মূলত পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার শাখানদী থেকে। নদীর পাশাপাশি অগুনতি শিরা উপশিরার মতো ছোট নদী বা ফাঁড়ি দিয়ে জল গিয়ে মেশে বঙ্গোপসাগরে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সুন্দরবনের মধ্যে প্রায় মোট ১২ হাজার কিমি নদী রয়েছে যা কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্বের প্রায় ছত্রিশ গুন। ছোট বড় মিলিয়ে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি হল বালেশ্বর, বাসুর, শিবঘা, কোবাভাবা, কালিন্দী ও রায়মঙ্গল। ভারতীয় সুন্দরবনেও একইভাবে বহু নদী আছে।
২) লবণাক্ততা : সমুদ্রের মোহনার কাছাকাছি হবার কারণে সুন্দরবনের জল যে লবণাক্ত হবে তার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেটা চিন্তার তা হল সুন্দরবন অঞ্চলে নদীতে ক্রমেই লবণাক্ততা বাড়ছে কেননা গত কয়েক দশক ধরে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশের নদীগুলি ক্রমেই পলিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। যদিও সুন্দরবনের পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে মিষ্টি জল আসছে তা সত্ত্বেও লবণাক্ততা বাড়ছে; যার ধাক্কায় অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে বেশ কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের। ভারতীয় সুন্দরবনে লবণাক্ততার সমস্যা আরও জটিল কেননা এখানে উপরিভাগ থেকে মিষ্টি জল নিয়ে আসা গঙ্গা ও ইছামতী দুটি নদীতেই জলের পরিমাণ অনেক কমেছে।
৩) বাঁধ : বাংলাদেশ সুন্দরবনে অবশ্য বাঁধের পোষাকি নাম পোল্ডার। সব মিলিয়ে সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ৪১টি পোল্ডার তৈরি করা হয়েছে মূলত জলের লবণাক্ততা এবং জোয়ারের সময় চাষের জমিতে সেই লবণাক্ত জল ঢোকা আটকাতে। ভারতীয় সুন্দরবনের বাঁধের সঙ্গে বাংলাদেশের পোল্ডারের তফাৎ হল এখানে এক একটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে বাঁধ দেওয়া হলেও পোল্ডার দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে।
৪) মানুষ : এখানেও বড় তফাৎ রয়েছে ভারতীয় সুন্দরবনের সঙ্গে। আমাদের সুন্দরবনে জঙ্গলের গায়ে লাগানো দ্বীপে বসবাসকারী প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ থাকলেও, বাংলাদেশে তা নয়। এখানে জঙ্গল অঞ্চলের বাইরে পাঁচটি জেলার প্রায় ২০টি উপজেলায় কমবেশি ৮০ লক্ষ মানুষ থাকেন। সুন্দরবনের গা ছোঁয়ানো সে অঞ্চলের আনুষ্ঠানিক নাম ‘সুন্দরবন ইমপ্যাক্ট জোন’। এই মানুষদের একটা বড় অংশ তাদের জীবিকার কারণে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল, যে সংখ্যাটা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লক্ষের আশেপাশে। দুই সুন্দরবনেই দারিদ্রতার হার অত্যন্ত বেশি।
৫) সরকারি পরিষেবা : স্পষ্টতই শিক্ষাসংক্রান্ত পরিষেবা দুর্বল। কখনও কখনও পাঁচ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে একটি মাধ্যমিক স্কুলের দেখা পাওয়া যায় না। পানীয় জলের যোগান বা শৌচ ব্যবস্থাও বেশ দুর্বল। অধিকাংশ বাড়ি কাঁচা বা ঝুপড়ি প্রকৃতির। বেশিরভাগ মানুষই পুকুরের জল পান করেন কেননা টিউবওয়েলের জল অনেক ক্ষেত্রে লবণাক্ত বা আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। অন্য একটি গবেষণা বলছে, প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জল পান না। ভারতীয় সুন্দরবনে শিক্ষার পরিস্থিতি তুলনায় অনেক উন্নত, পানীয় জলের অবস্থা খুব ভালো না হলেও বাংলাদেশের থেকে ভালো ও আর্সেনিকের সমস্যা কম।
৬) মাছ, বাদাবন ও বাঘ : এই একটা জায়গাতেই বাংলাদেশের সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম সেরা। বিজ্ঞানীরা বলেন এই জঙ্গলে প্রায় ৩৪০টি প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। প্রসঙ্গত সুন্দরবনের বাদাবনে যে বিপুল বৈচিত্রের উদ্ভিদের দেখা মেলে তা পৃথিবীর অন্য কোনও বাদাবনে দেখা যায় না। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ সুন্দরবনের এখনও সুন্দরী গাছের যথেষ্ট দেখা মিললেও ভারতের সুন্দরবনে তা ক্রমেই বিরল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি প্রায় সাড়ে চারশো প্রজাতির প্রাণী রয়েছে বাদাবনে। অন্য জায়গায় দেখা মেলে না এমন প্রজাতির পাশাপাশি বাঘ, নদীর টেরাপিন, অলিভ রিডলে কচ্ছপের মতো প্রজাতি যারা বিশ্বে ক্রমেই অস্তিত্ব হারাচ্ছে তাদের দেখা মেলে এই অরণ্যে। বাংলাদেশ সুন্দরবনের তিনভাগের এক ভাগ জল যার কিছুটা সমুদ্রের গা ঘেঁষে, কিছুটা সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের জলাশয়ের মাধ্যমে আর বাকিটা সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনে। প্রথমটিতে সামুদ্রিক মাছ ধরা, মাঝেরটিতে নোনাজলের মাছ চাষ ও শেষেরটিতে নোনা জলের পাশাপাশি মিষ্টি জলের মাছ দেখা যায়। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০-র উপর প্রজাতির মাছ রয়েছে এই অঞ্চলে। চিংড়ি পাওয়া যায় ২৪ প্রজাতির আর কাঁকড়া ৭ প্রজাতির। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে বঙ্গোপসাগরে চাষ করা হয় এমন প্রাণীর ৯০ শতাংশের আঁতুরঘর সুন্দরবনে। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক গবেষণা জানিয়েছে যে সংরক্ষণের প্রশ্নে ভারতীয় সুন্দরবন এগিয়ে।
৭) পর্যটন : সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসেন সুন্দরবনে প্রধানত বাঘের টানে এবং এদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০০৬-০৭ সালে যেখানে ১ লক্ষ পর্যটক এসেছিলেন সেখানে ২০১৪ সালে এসেছিলেন ২ লক্ষ। ফরামজল, হাড়বেড়িয়া, কটকা, কচিলখালি, দুবসা দ্বীপ ইত্যাদি বাংলাদেশ সুন্দরবনের মূল পর্যটন আকর্ষণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এই পর্যটন থেকে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট আয় করলেও যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তবে তা সুন্দরবনের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হতে পারে। পাশাপাশি ভারতীয় সুন্দরবনে পর্যটনে কড়াকড়ি বেশি ও তুলনামূলকভাবে পর্যটক কম। দুই সুন্দরবনেই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশসম্মত পর্যটন বাড়ানোর উপায় আছে বলে মনে করা হয়।
৮) জলবায়ুর পরিবর্তন : সুন্দরবন পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনের হিট লিস্টের সামনের সারিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতীয় সুন্দরবনের তুলনায় বাংলাদেশ সুন্দরবনের বিপন্নতা আরও বেশি। বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে গড়পড়তা সমুদ্রের জল বাড়ার প্রবণতা বছরে দশ মিলিমিটারের কাছাকাছি অর্থাৎ ২১০০ সালে সমুদ্র প্রায় আড়াই ফুট পাড়ের কাছাকাছি উঠে আসতে পারে। এর ফলে যে সমুদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশের বড় অঞ্চল জলে ডুববে তাতে সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি রয়েছে তীব্র সামুদ্রিক ঝড় বাড়ার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে নার্গিস, সিডার, আয়লার মতো ঝড় আছড়ে পড়েছে এই অঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর ভবিষ্যদ্বাণী, দুর্যোগ ক্রমশ বাড়বে।
এতগুলি বিষয়ের মধ্যে আবহাওয়ার পরিবর্তনের মতো নতুন ও অচেনা বিপদ আমাদের সুন্দরবনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র জীবন হারানোর আশঙ্কাই নয়, আরও বেশি করে জীবিকা হারানোয় আশঙ্কায়। নদীতে মাছ কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। দ্বীপের ভেতরকার মিষ্টি জলের বহু পুকুরই অয়লার ধাক্কায় লবণাক্ত, তথৈবচ চাষের জমিও। সরকারি নানান নিয়মবিধির পাল্লায় পড়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ঢুকে মধু সংগ্রহ করার জীবিকাও। তাই সবমিলিয়ে সুন্দরবন ছাড়ার ঢল নেমেছে। পুরুষ হলে নানারকম কাজের লোভ দেখিয়ে তাদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একরকম হচ্ছে, যদিও অভিযোগ বেশিরভাগ অংশের শেষমেশ ঠিকানা হয় কলকাতা-দিল্লি-মুম্বাইয়ের যৌনপল্লী। বস্তুত দালালি এখন সুন্দরবনের প্রতিষ্ঠিত জীবিকা। সবমিলিয়ে গ্রামে জোয়ান পুরুষদের দেখা নেই, অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও কোথাও বা মহিলাদের বাস। আশ্চর্যের কথা এত কিছু সত্ত্বেও সুন্দরবনের জনসংখ্যা বাড়ছে! কোথা থেকে আসছেন এই মানুষরা? কেনই বা আসছেন চরম বিপন্নতা মাথায় নিয়ে? গবেষকরা এর উত্তর জানেন না। বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষণা বলছে সুন্দরবনের অতি বিপন্ন অঞ্চলে যারা থাকেন ও তাদের জন্য উপযুক্ত রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে না পারলে, ধীরে ধীরে সরিয়ে দিতে না পারলে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
এটা আশ্চর্যের কথা যে এই সার্বিক বিপন্নতাকে আরও উস্কে দিচ্ছে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলাদলি। আরও একটি এমন জায়গা পাওয়া কঠিন যেখানে এমন রাজনৈতিক বৈচিত্র দেখা যায়। এখানে তৃণমূল আছে, আছে সিপিএম, এসইউসি আর কম হলেও অতি বাম নকশালপন্থীরা, অতি ডান বিজেপি ও কংগ্রেস তো বটেই। এদের অধিকাংশই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত আর সেই পারস্পরিক দড়ি টানাটানির খেলার মাঝে পড়ে আন্তর্জাতিক হেরিটেজ সাইট সুন্দরবন হাঁসফাঁস করছে, ফিরে যাচ্ছে কখনও বাঁধ সারানোর বা বাঘ সংরক্ষণের হাজার হাজার কোটি টাকা। মাঝখান থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার লম্বা মাটির বাঁধের একটা বড় অংশই ভঙ্গুর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিংড়ি চাষের মতো আত্মঘাতী জীবিকা। চিংড়ির চাষ করতে গিয়ে নদীর অন্যান্য মাছের চারা ও সার্বিক জীববৈচিত্র্য গোল্লায় যাচ্ছে তো বটেই, পাশাপাশি বাঁধ কেটে চিংড়ি চাষের জন্য দ্বীপের মধ্যে জল ঢোকানোর ফলে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে মাটির বাঁধ। পরিবেশবিদরা বা সুন্দরবন বিশেষজ্ঞরা বারবার আফশোষ করেন যে সুন্দরবনের কোনও মাস্টার প্ল্যান নেই। আসলে সুন্দরবনে গরিব মানুষদের ভোট পাবার জন্য যে মাস্টাররা আছেন তারা কোনওদিন প্ল্যান করার কথা ভাবেননি। হয়তো বা এরা অধিকাংশই সুন্দরবনে থাকেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে সুন্দরবন না বাঁচলে কলকাতা বাঁচবে না, ঢাকাও বাঁচবে না। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা সংস্থা ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) জানিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে খুব দ্রুত কলকাতা ও ঢাকার মতো শহর বিপন্নতার হিট লিস্টে একেবারে উপরে চলে আসবে; তার কারণ সুন্দরবনের বেড়ে চলা বিপন্নতা। প্রসঙ্গত একটা গল্প মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে রাজ্য বন দপ্তরের হেড কোয়ার্টারে বসে এক কর্তা কমপিউটারে লক্ষ করলেন যে একটি বাঘ ক্রমেই বন দপ্তরের গেটের দিকে এগিয়ে আসছে! আসলে বাঘ নয়, বাঘের কলার যা বেশ কয়েকটি বাঘের গলায় পরানো হয়েছিল তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের হাল হকিকত বুঝতে। সেই কলারটি থেকে সিগনাল যত বনদপ্তরের দিকে এগোতে শুরু করেছিল ততই হৈচৈ শুরু হয়েছিল দপ্তরে; তাহলে কি বাঘ জঙ্গল ছেড়ে সল্টলেকে ঢুকে পড়েছে? যখন জানা গেল বাঘ নয়, বাঘের খারিজ করা কলার নিয়ে এক আধিকারিক দপ্তরের দিকে আসছেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সবাই। মনে রাখতে হবে সুন্দরবন ছেড়ে বাঘেরা হয়তো কলকাতা বা ঢাকায় আসতে পারবে না; (তারা কতদিন সুন্দরবনে থাকতে পারবে তাও ভাববার বিষয়) কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপদ যখনতখন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কলকাতা বা ঢাকার মতো শহরের বুকে। যত সুন্দরবন নষ্ট হবে, নষ্ট হবে বাদাবনের দেওয়াল; তত বিপদ বাড়বে। আর আমাদের প্রস্তুতি যেহেতু প্রায় শূন্যের কাছাকাছি তাই বিপর্যয় যে বড় আকারের হবে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং কিছুদিন আগে কলকাতার রাস্তায় শোভা পাওয়া ব্যানারটির উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না; সুন্দরবন বাঁচলেই কলকাতা বাঁচবে। বাদাবনকে ভেন্টিলেটর থেকে বের করে না আনতে পারলে দুই বাংলার একটা বড় অংশকে শেষমেশ ভেন্টিলেটরে ঢুকে পড়তে হবে, এটা বুঝতে বড় বিজ্ঞানী হতে হয় না।
**লেখাটিতে যেখানে বাংলাদেশ সুন্দরবন বলা হয়নি, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে।
লেখাটি একটি রেড অ্যালার্ট। কিন্তু যাদের কানে যাওয়া দরকার তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে তো?