স্টেশন মাস্টার
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় যাত্রা আসলে আমাদের আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-নদী-নালা-জলা-জঙ্গল বাঁচানোর লড়াইয়ের অসংখ্য কাহিনির কয়েকটিকে একত্র দেখতে চাওয়ারই ইচ্ছে থেকে; যার নামকরণ করতে গিয়ে অনিবার্যত ফিরতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাঁর ‘স্ফুলিঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই আমরা পেয়েছি ‘পীড়িত ধরণীর বেদনাভার’, যে অনির্বচনীয় রূপকল্পটিই আমাদের এই সংখ্যার মূল বিষয়-ভাবনার নামান্তর হয়ে উঠেছে।
মাসকয়েক আগের কথা। এ-বছরের ২৮ জানুয়ারির ‘দ্য হিন্দু’-র পাতায় সংবাদসংস্থা পিটিআই-এর একটি খবর চোখে পড়েছিল। খুব আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো খবর নয়, বাংলা খবরের কাগজগুলি সে খবরের পেছনে সময় এবং কলাম-সেন্টিমিটার খরচ করার কোনও প্রয়োজন মনে করেনি। সে খবরের শিরোনামটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘দূষণের মাপকাঠিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ নম্বরে ভারত’। এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স-এর (সংক্ষেপে ইপিআই) দ্বিবার্ষিক সেই রিপোর্টে প্রকাশিত এমন গৌরবজনক একটি তথ্য পরিবেশনের মঞ্চ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর অধিবেশনকে। এধরনের রিপোর্টে সচরাচর যেমন হয়ে থাকে – তালিকার একেবারে তলানিতে থাকা দেশগুলির নাম খবরের গোড়ায় উল্লেখ করে পরের অনুচ্ছেদে সেরা দেশগুলির প্রসঙ্গে আসা হয়েছিল। পিছিয়ে থাকার সেই অভ্রভেদী গৌরবে ভর করেই খবরের শুরুতে উজ্জ্বল অক্ষরে নাম ছিল আমাদের। সে গৌরব অবশ্য ভারতের একার ছিল না, পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ পাঁচ দেশের তালিকায় ভারতের সঙ্গে ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও নেপাল, এবং আফ্রিকার দুই দারিদ্র্যদীর্ণ প্রতিনিধি বুরুন্ডি ও কঙ্গোর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ১৮০ দেশের মধ্যে সেরা ফল করেছিল সুইটজারল্যান্ড (বলা বাহুল্য, কেন না, তা না-হলে দাভোসের বিশ্ব পরিবেশ-সম্মেলনে ওই রিপোর্ট পেশ করার প্রশ্নই উঠত না), এবং তার ঠিক গায়ে-গায়েই ছিল ফ্রান্স, সুইডেন, ডেনমার্ক ও মাল্টা। ইয়েল এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশবিজ্ঞানী ও সমীক্ষকদের গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি সেই রিপোর্টে আমাদের পক্ষে এর বাইরে আর একটিই মাত্র লজ্জার বিষয় ছিল – বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সাফল্যের নিরিখে আমরা পেয়েছিলাম ১৮০-র মধ্যে ১৭৮তম স্থান।
কিন্তু সেসব কথা থাক। সারা পৃথিবী জুড়ে কার্বন উদ্গীরণকারী দেশগুলির তালিকায় লালপুঁজি-নীলপুঁজির প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিনিধিরাও কিছু গৌরবজনক জায়গায় নেই – বস্তুত পরিবেশরক্ষায় ভারতের কালিমাক্লিন্ন ছবিটি বিশদে তুলে ধরার পেছনে উভয়পক্ষেরই স্বার্থ যে বিলক্ষণ জড়িত, সে তথ্যও সকলেই কমবেশি জানেন। বিশ্ব বসুন্ধরা দিবসের আগে চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের আসন্ন সংখ্যার পরিকল্পনা করতে বসে আমাদের বরং অনেক বেশি করে মনে পড়ছিল খাঁড়িযুদ্ধের ঠিক পরে-পরে খবরের শিরোনামাএ উঠে আসা সাগরতটে ঘন তেলের আস্তরণে আটকা পড়ে যাওয়া বিপন্ন, মৃতপ্রায় একটি শঙ্খচিলের ছবি – যেন বা বিশ্বজোড়া পরিবেশ ধ্বংসের বেদনাভারে পীড়িত পৃথিবীরই এক মর্মান্তিক প্রতীক হয়ে উঠেছিল তা।
আর তারই পাশাপাশি, আমাদের মনে পড়েছিল আরণ্যক উপন্যাসের মুখপাতে সত্যচরণের জবানিতে বিভুতিভূষণের সেই অমোঘ, মর্মছেঁড়া স্বীকারোক্তি। পলামু জেলার মহালিখারূপ পাহাড় ও লবটুলিয়া বইহারের বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহাল কেটে আবাদ বসানোর চাকরি করতে যাওয়া সত্যচরণ ফিরে আসার সময় বলেছিল, শুনেছি আপন অপরাধের কথা নিজমুখে স্বীকার করলে অপরাধের গুরুত্ব কিঞ্চিৎ লাঘব হয়, তাই এই কাহিনির অবতারণা। উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে, সরস্বতী কুণ্ডীর পাড়ের একদাসমৃদ্ধ বনভূমির ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে সে স্বকৃত অপরাধের জন্য শেষবারের মতো ক্ষমাভিক্ষা করেছিল অরণ্যাণীর আদিম দেবতাদের কাছে।
…সত্যচরণ কি জানতে পেরেছিল, ক্ষমা করবেন না অরণ্যের দেবতারা? সে প্রশ্নের উত্তর উপন্যাসের পাতায় পাওয়া কঠিন হলেও, আজকের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যেন নিঃসংশয় পড়ে নিতে পারা যায় দেবতাদের অব্যক্ত উত্তর। টের পাওয়া যায়, বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির ক্ষুধানিবৃত্তির অন্তহীন আয়োজনে প্রকৃতি ও তার সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তর লগ্ন হয়ে থাকা অরণ্যজীবী মানুষকে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু না-দিলে তার পরিণাম কতদূর ভয়াবহ হতে পারে।…
সত্যচরণ কি জানতে পেরেছিল, ক্ষমা করবেন না অরণ্যের দেবতারা? সে প্রশ্নের উত্তর উপন্যাসের পাতায় পাওয়া কঠিন হলেও, আজকের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যেন নিঃসংশয় পড়ে নিতে পারা যায় দেবতাদের অব্যক্ত উত্তর। টের পাওয়া যায়, বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির ক্ষুধানিবৃত্তির অন্তহীন আয়োজনে প্রকৃতি ও তার সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তর লগ্ন হয়ে থাকা অরণ্যজীবী মানুষকে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু না-দিলে তার পরিণাম কতদূর ভয়াবহ হতে পারে। আরণ্যকের মুসম্মত কুন্তা বা নকছেদি ভকতরা, কিংবা তিস্তাপারের বাঘারু বর্মণরা ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও সেখানকার মাটিতে তাদের পায়ের অনশ্বর ছাপ রয়ে যায় – শতাব্দীর ও-পার থেকে বয়ে আসা বিস্মৃতির সুদীর্ঘ বাতাস তাদের হুতাশ বহন করে ফেরে। সেই হুতাশ তারপর একদিন কীভাবে বনে-বনে দাবানলের হুতাশন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, আজকের নিয়মগিরি তার প্রমাণ।
কিন্তু তার পরেও কথা থাকে। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মুখ হয়ে যখন এককাপড়ে অনশনে বসেন মেধা পাটকর, অরণ্যনিধনের প্রতিবাদে বৃক্ষলগ্ন হয়ে যখন চিপকো আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভাষ্য রচনা করেন মেধারই দূরতম সম্পর্কের বোনেরা, নদীবাঁধের জন্য ভিটে হারানো বুধনি মাঝি যখন বহু বছর পরে আবার তার আপনার ঘরে ফিরতে চায়, বহুজাতিকের ল্যাবরেটরিতে তৈরি উচ্চফলনশীল বীজের চোখরাঙানির বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে অতি সামান্য পুঁজি সম্বল করে দেশি ধানবীজ সংরক্ষণ করে যখন বিকল্প চাষের স্বপ্ন দেখতে থাকেন কেউ-কেউ – আমরা টের পাই, যেন বা একমুঠো লড়াইয়েরই বীজ ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে মানুষের প্রত্যয়ের মাটিতে। তারপর, একদিন জ্যোৎস্নার রাত্তিরে আমাদের বহুশতাব্দীর কৌমলালিত স্বপ্নেরা সেই ধানের বুকে দুধ হয়ে নেমে আসতে থাকে…
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় যাত্রা আসলে আমাদের আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-নদী-নালা-জলা-জঙ্গল বাঁচানোর লড়াইয়ের অসংখ্য কাহিনির কয়েকটিকে একত্র দেখতে চাওয়ারই ইচ্ছে থেকে; যার নামকরণ করতে গিয়ে অনিবার্যত ফিরতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাঁর ‘স্ফুলিঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই আমরা পেয়েছি ‘পীড়িত ধরণীর বেদনাভার’, যে অনির্বচনীয় রূপকল্পটিই আমাদের এই সংখ্যার মূল বিষয়-ভাবনার নামান্তর হয়ে উঠেছে। এই বেদনাভারের কাহিনি ও তাকে অতিক্রম করে জীবনে ফেরার মহাকাব্যের কথক হিসেবে আমরা পেয়েছি সদ্যপ্রয়াত পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষকে, সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিরলস লিখে চলা বর্ষীয়ান সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রকে, সুন্দরবনের ক্ষয়িষ্ণু বনভূমি সংরক্ষণে দুই বাংলা জুড়ে গবেষণা ও জনমত গঠনের কাজে যুক্ত জয়ন্ত বসুকে এবং পূর্ব কলকাতার জলাভূমিরক্ষা আন্দোলনের নিষ্ঠ কর্মী কাজল সেনগুপ্তকে। পরিবেশনিধনের ফলশ্রুতিতে হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন মানুষের মুখ ও তাদের লড়াইয়ের অনুল্লেখিত কাহিনি নিয়ে লিখেছেন সোমেন বসু ও দেবব্রত শ্যামরায়।
রিজার্ভড বগি ‘পীড়িত ধরণীর বেদনাভার’-এর বাইরে এ-সংখ্যায় আরও রয়েছে গল্প, অণুগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, হুইলার্স স্টল, স্টিম ইঞ্জিন এবং অন্যান্য নিয়মিত ও ধারাবাহিক বিভাগ, যেগুলির জন্য সারা মাস অপেক্ষায় থাকেন আপনারা। সেইসব অনুভবী ও নিষ্ঠ পাঠকদের কাছে আমাদের আপাতত একটিই সনির্বন্ধ প্রার্থনা। লেখাগুলি পড়া ও বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, যদি লেখাগুলি নিয়ে আলোচনাও করেন, আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন ও কীভাবে পত্রিকাটিকে আরও ভাল করে তোলা যায় সে-বিষয়ে মতামত বিনিময় করেন, তা আমাদের সত্যিকারের কাজে লাগবে।
ভাল থাকবেন। পাশে থাকবেন…
ঝরঝরে গদ্য স্টেশনমাস্টারের। মূল ম্যাগে ঢোকার আগেই পরিবেশ নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।