দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যিনি জার্মানিকে এক ঐক্যবদ্ধ জবরদস্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন, সেই অটো ফন বিসমার্ক একদা এক সাক্ষাৎকারে রাজনীতি সম্পর্কে এক কালজয়ী উক্তি করেছিলেন। তিনি সেদিন যা বলেছিলেন তার ইংরিজি বয়ানটি এইরকম — ‘Politics is the art of the possible’, অর্থাৎ, রাজনীতি হল সম্ভাবনার শিল্পকলা। উক্তিটি অতি বিখ্যাত হয়েছিল কারণ আধুনিক রাজনীতির এসেন্স-টি এর মধ্যে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছিল। সেই ‘এসেন্স’ বা সারসত্তাটি এরকম যে, তুমি বাস্তবে কতটুকু কী করতে পারো সেইটা শুধু দেখো, কোনটা নীতিসম্মত বা কোনটা হলে খুব ভাল হত সে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমরা যাকে আজকাল ‘রিয়ালপলিটিক’ বলি, তার মূল কথাটা এত সংক্ষেপে গুছিয়ে আর কে-ই বা বলতে পেরেছেন!
কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভাষণ শুনে এই পুরনো কথাটা কিঞ্চিৎ অস্বস্তিময় কৌতুকের সাথে কেন যে হঠাৎ মনে উদয় হল সেটা পরে বলছি, তার আগে অতি সংক্ষেপে একটু দেখে নিই যে, ওই সভায় তিনি এবং সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবত কী কী বললেন। কংগ্রেস পার্টির কেউ কেউ, শ্রীমুখোপাধ্যায়ের কন্যা সমেত, তাঁর এই পদক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আসলে পৃথিবীশুদ্ধু সকলেই জানতেন যে শ্রীমুখোপাধ্যায় ওখানে মোটেই এমন কিছু বলবেন না যাতে তাঁর দীর্ঘদিনের পার্টি প্রত্যক্ষভাবে অস্বস্তিতে পড়ে। বলা বাহুল্য, তিনি তা বলেনওনি। তিনি আমাদেরকে শুনিয়েছেন ভারতের সুপ্রাচীন প্রাজ্ঞ, গ্রহিষ্ণু, সহিষ্ণু ঐতিহ্যের এক সুমিষ্ট শিশুপাঠ্য বয়ান। তিনি বলেছেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা, প্রাচীন রেশম ও মশলা সড়ক দিয়ে সারা বিশ্বের সাথে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের কথা, সমাগত প্রাচীন পর্যটকদের কথা, তক্ষশীলা-নালন্দাদি শিক্ষায়তনে সারা পৃথিবীর জ্ঞানীসমাগমের কথা, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বাণীর কথা, প্রজাপালক রাজধর্মের কথা। যা তিনি বাদ দিয়ে গিয়েছেন তা হল প্রাচীন ভারতে রাজারাজড়াদের ক্রমাগত অর্থহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহের কথা, ব্রহ্মার পা থেকে শূদ্রের জন্মের কথা, একলব্যের আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা নেওয়ার কথা, ধর্মতাত্ত্বিক ভুয়োজ্ঞানের অহংকার ও ঘৃণা-অস্পৃশ্যতার পাপ মাত্র সম্বল করে জ্ঞান ও যুক্তির পথ থেকে সরে গিয়ে অতল কুসংস্কারে নিমজ্জিত এক স্থবির সমাজে পরিণত হওয়ার কথা।
প্রাচীন ভারত সম্পর্কে যদি তিনি এই কটি কথা বাদ দিয়ে থাকেন, তো আধুনিক ভারত সম্পর্কে বাদ দিয়েছেন প্রায় সব কিছুই। অর্থনৈতিক অসাম্যের ব্যাপক বৃদ্ধি, প্রবল দারিদ্র্য ও দুর্নীতি, ধর্মীয় ঘৃণা ও হিংসার প্রবল প্রচার ও প্রসার, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিচর্চার অবনমন, শিক্ষায় ধর্মীয় কলুষের অনুপ্রবেশ, দলিত-নিপীড়ন, মুক্তমন ও গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের খুন বা গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়া। দেশের একমাত্র যে সমস্যাটিকে তিনি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেছেন তা হল, আন্তর্জাতিক সুখানুভূতির সূচকে দেশের স্থান নেমে যাওয়া। কোথা থেকে আসে সুখান্বেষণ!
আশ্চর্যের কথা, কিম্বা হয়ত আসলে তত আশ্চর্যের নয় যে, সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবতও সেদিন প্রায় একই কথা বলেছেন। বলেছেন, ভারত এক বহু ভাষা-মতামত-ধর্ম-সংস্কৃতির দেশ, এবং এটাই ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। তবে তার সঙ্গে এ কথা জুড়তে ভোলেননি যে, এই বৈচিত্র্য নিয়েই সমস্ত ভারতবাসী আসলে ভারতমাতার সন্তান, তাই সে সন্তানের কর্তব্য তাদের করতে হবে, এবং আর এস এস সেই কর্তব্যই পালন করে আসছে। শ্রীমুখোপাধ্যায় বলেছেন, বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতিতে কোনও বিশেষ ধর্মের আত্মপরিচয়কে জাতীয়তার সঙ্গে সমীকৃত করা বিপজ্জনক, এবং শ্রীভাগবত তাতে আপত্তি করার কারণ দেখেননি, কারণ, হিন্দুত্ব তো আর ধর্ম নয়, এ হল সমস্ত ভারতবাসীর জীবনশৈলী! হিন্দুত্ববাদী লেখক এস গুরুমুর্তি সোল্লাসে বলেছেন, দুজনেই তো জাতি-জাতীয়তাবাদ-দেশপ্রেম নিয়ে একই কথা বললেন, তাহলে লিবারেল আর সেক্যুলারদের অসুবিধেটা কোথায় হচ্ছে?
এটা প্রত্যাশিত যে গণমাধ্যম এ ভাষণকে আর এস এস-এর প্রতি তাঁর দেওয়া হুঁশিয়ারি বলে প্রচার করবে, করছেও তাই। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিন্দুত্ববাদীদের সদর দপ্তরে গিয়ে তাঁদেরকে অহিংসা ও সহিষ্ণুতার বার্তা শুনিয়ে এসেছেন, এই কথা মিডিয়া আমাদেরকে জানাতে চাইছে। একই কথা বলছে কংগ্রেসও। মুখপাত্র রণদীপ সিং সূর্যেওয়ালা তাঁর প্রেস বিবৃতিতে বলেছেন, শ্রীমুখোপাধ্যায় তাঁদের সামনে তুলে ধরেছেন ‘সত্যের আয়না’! বলতে পারছেন, কারণ, শ্রীমুখোপাধ্যায় সচেতনভাবেই সে রাস্তাটি খোলা রেখেছেন। কিন্তু, সত্যের আয়নার তলাকার আসল আশঙ্কাটিও আছে ওই প্রেস বিবৃতিতেই। তার তিন নং অনুচ্ছেদে প্রশ্ন করা হয়েছে, আর এস এস কি ভাবছে যে, এই একটিমাত্র অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে হাজির করতে পারলেই তারা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাবে?
বাস্তবিকই, দেশজোড়া সমালোচনা ও অসন্তোষের মুখে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক পরিসর ছাড়িয়ে বৃহত্তর নাগরিক-সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নির্মাণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক আশু তাগিদ বটে। কিন্তু, উল্টো দিকটাও ভাববার। শ্রীমুখোপাধ্যায়েরও কি তাগিদ ছিল না, জীবনের এই শেষলগ্নে এসে জাতীয় ক্ষমতাবৃত্তে একান্তভাবে নিজের জন্য এক বিকল্প পরিসর বানানোর, জাতীয় রাজনীতিতে নতুনভাবে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বাড়িয়ে নেওয়ার? রাজনীতিতে যে অসম্ভব বলে কিছু থাকতে নেই!
আর, এই প্রেক্ষিতেই মনে পড়ে যায় বিসমার্কের সেই কালজয়ী উক্তি। তিনি যদি আর এস এস-এর ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, আর সাংবাদিককুল চেপে ধরত মাতৃভাষা জার্মান-এর বদলে ইংরিজিতে একটি বিবৃতি দেবার জন্য (ভাষাটি তিনি ভালোই জানতেন), তাহলে হয়ত তিনি ওই উক্তিটিই আবার করতেন, একটি নগণ্য পরিবর্তনসহ — ইংরিজির ষষ্ঠ অক্ষরটি জায়গামত ঢুকিয়ে নিয়ে । ‘পলিটিক্স ইজ দ্য ফার্ট অফ দি পসিব্ল্’ ।
Fart of the possible। সম্ভাবনার অপানবায়ু!