প্রসঙ্গ কোবরাপোস্ট : কয়েকটি কথা

শিমূল সেন

 

তার গোড়ায় মিডিয়া ছিল বাকস্বাধীন, মুক্তচিন্তক, লিবারাল চেতনায় আত্মপ্রকাশকামী ইউরোপের বিজয়পতাকা। আধুনিকতা নামের সেই স্বকল্পিত চৌকাঠে পা রাখতে গিয়ে ইউরোপ অনুধাবন করে ফেলে ঘরোয়া কূটকচালির বাইরের অনন্ত দুনিয়ার সম্ভাবনা, যা তার মেধায় তুখোড়, তর্কে দীপ্ত, শাণিত নিজের ভাষ্যে, যার ডাকনাম দেওয়া হল: পাবলিক স্ফিয়ার। সেই পৃথিবীতে কাজ করে বিশ্বাস নয়, যুক্তি, অন্ধ বশ্যতা নয়, প্রশ্ন, যা এঁদো গৃহকোণে আটক থাকে না। সেই পৃথিবী নির্ধারণ করে দেয় তত্ত্ব, মতাদর্শ, রাষ্ট্র-পরিচালনার ঔচিত্যবোধ, রাষ্ট্রবিরোধী রেজিস্ট্যান্সের সঙ্গত সীমারেখা, অথবা সুদূর কলোনিতে ঔপনিবেশিকদের নিপীড়নের মাত্রা। এমন পাবলিক স্ফিয়ারের নবোদ্ভূত নিদর্শন হয়ে রইল ইউরোপীয় শহরে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা কাফেগুলি, যা তর্কসহিষ্ণু, উদার, ও বাগ্মী।

পাবলিকের এই নবলব্ধ ধারণা, স্বভাবতই ছিল মিডিয়ার অবলম্বন। সেই সময়ের হোতা চিন্তাবিদরা সকলেই এই পাবলিক স্ফিয়ার-নির্মাণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হেগেল বলেছিলেন: আদর্শ আধুনিক মানুষের অন্যতম প্রভাতকালীন উপাসনা হল তার সংবাদপত্র-পাঠ। মিডিয়া, যাকে শখ করে বলা হয় লিবারাল ডেমোক্রেসির চতুর্থ স্তম্ভস্বরূপ, অচিরেই হয়ে উঠতে থাকল রাষ্ট্র এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে প্রতিস্পর্ধা। স্বভাবতই এই উদারনৈতিক চৌহদ্দিতে অন্য স্তম্ভগুলির সঙ্গে তার অবধারিত খিটিমিটি, ১৬৬২ সালে ইংলিশ পার্লামেন্ট জারি করল প্রেস অ্যাক্ট, যার উদ্দেশ্য মুক্তচিন্তার হবরখত অনুশীলনের ফাঁক দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের যথেচ্ছ সম্ভাবনাকে আটকানো।

এই ঐতিহাসিক আখ্যান আমাদের জানা। কথাগুলো আবার তুলতে হল সাম্প্রতিকের কোবরাপোস্ট স্টিং অপারেশনের ফলশ্রুতিতে। বাজারে বিবেকী গুঞ্জন উঠেছে, অনাদিঅতীত থেকে মিডিয়ার যে অর্জন, সেই ক্ষমতার প্রতি সপ্রশ্নতাকে তারা বিসর্জন দিয়েছে মুনাফার কথা মেনে, নির্দিষ্ট আদর্শের কাছে বশ্যতায়। এই গোটা ইতিহাস থেকে মিডিয়ার যে ছবি গণমনে আঁকা হয়েছে, তার ভিত্তিতে, মিডিয়া নিষ্পাপ পাবলিক স্ফিয়ারের প্রতিনিধি, যে তর্কে প্রবৃত্ত করে, অনাস্থায় দীক্ষিত করে, যুক্তিতে উস্কানি দেয়। আদর্শ মিডিয়া হবে আয়নার মতো নির্ভেজাল, প্রতিষ্ঠানকে সে প্রশ্রয় দেবে না, বরং নস্যাৎ করবে। কিন্তু, যুক্তিটির সমস্যা হল, ইতিহাসে তো নিছকই ঘটনা থাকে না, কালও থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে: আজকের যে বাস্তবতায় আমরা টিকে থাকি, তা কি আধুনিকতার জন্মলগ্ন-স্পৃষ্ট সময়ের থেকে পৃথক? সময় যদি বদলেই যায়, মিডিয়াকে স্থাণু থাকতে হবে, তার চরিত্র বা আদর্শ পাল্টাবে না, এমন দিব্যি কে দিল?

কোবরাপোস্ট একটি নামী সংবাদসংস্থা, যারা, কয়েক কোটি মানুষের নিত্য লেনদেন রয়েছে, ভারতের এমন ষাটেক বড় মিডিয়া হাউসগুলিকে গিয়ে অফার দেয় টাকার বিনিময়ে মোদীপন্থী পেড নিউজ করার, অধিকাংশই এই প্রস্তাবে সম্মত হয়। নিঃসন্দেহে, এই প্রতিশ্রুতি ফোঁপরা ভারতীয় মিডিয়াকে ভেতর থেকে নগ্ন করে দিয়েছে, তার ব্র্যান্ড ভ্যালুকেও কমিয়ে দিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু মোদ্দা কথা হল: এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে মিডিয়ার বাস্তবতা কী, এবং সেই দুনিয়ায় পেড নিউজের এই কারবার কি অস্বাভাবিক, অপ্রত্যাশিত, অভূতপূর্ব? প্রথমত, সহজ উত্তর: না। কারণ, লিবারালিজমের প্রবল দাপটে মিডিয়ার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, একুশ শতকের উগ্র ডানপন্থী হাওয়ায়, এবং প্রায়-ফ্যাসিবাদী পরিবেশে সেই অভিমুখ পাল্টাবেই। নাজি জার্মানিতে মিডিয়ায় ডিক্টেটরের এই ইমেজ-নির্মাণ শুরু, হালের ইরাক যুদ্ধেও তো মিডিয়া বিকিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধবাজ মার্কিন সরকারের সহানুভূতিতে। চমস্কি তাঁর মিডিয়া কন্ট্রোল বইতে মধ্য আমেরিকায় সরকারি গুন্ডামি আর মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষণা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন: “the picture of the world that’s presented to the public has only the remotest relation to reality. The truth of the matter is burried under edifice after edifice of lies upon this.”

মোদ্দা কথাটা হল, উগ্রতা এই শতকে আমাদের যাবতীয় মনোভঙ্গিকে চালনা করে, যার সুর দেড় দশক আগেই বুশ বেঁধে দিয়ে গেছেন: হয় ওরা আমাদের পক্ষে, নচেৎ বিপক্ষে। মধ্যপন্থী, কিঞ্চিৎ উদার যে মিডিয়া-ইমেজ আমরা কল্পনা করি, এই শতকে এসে তা মস্ত ভুল। বাইনারির নির্মাণ ঘটে যাচ্ছে আকছার, মিডিয়া এর বিশুদ্ধ ব্যাত্যয় হয়ে থাকবে কী করেই বা! ফলস নিউজ, পেড নিউজ, ইয়েলো জার্নালিজম… আমাদের আদর্শবাদী মিডিয়া-কল্পনাকে যা যা সংকটে ফেলে দেয়, তার জন্মই হয় এমন উগ্র, গোঁড়া আবহাওয়ায়। এই পপুলার অথচ কট্টর রাষ্ট্রশক্তিকে বাধ্যতই তখন সমঝে চলে মিডিয়া, তারাও বিশেষ পরোয়া করেন না মিডিয়ার।

ধরা যাক, নরেন্দ্র মোদী ক’টি প্রেস মিট করেছেন গত চার বছরে? উত্তর: শূন্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা বিদেশ সফরে গেলে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যান, এ সব দীর্ঘকালীন প্রথা। মোদী নেন? উত্তর: না। কোনও ইন্টারভিউ দিয়েছেন চার বছরে? উত্তর: হ্যাঁ, তবে দুটি পেটোয়া চ্যানেলকে। অতীতে করণ থাপারের শো থেকে অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে পড়ে ওয়াকআউট করেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ যা-যা সরকারি সিদ্ধান্ত, সবই টুইটার-মারফত সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয় জনতাকে, মিডিয়ার মধ্যস্থতা লাগে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো বড় মিডিয়ার ঝামেলা তো সুবিদিত। আমেরিকায় এত সব কাণ্ডের পর একটি কলেজে পোল নেওয়া হয়, প্রশ্ন: আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন, কোনও বিশ্বস্ত নিউজ সোর্সকে, না ট্রাম্পকে? ভোটদাতাদের মধ্যে ছিলেন ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান, ইন্ডিপেন্ডেন্টদের সব ক্যাটেগরিই। সমীক্ষায় নিরঙ্কুশ জেতেন ট্রাম্প। সারার্থ: ট্রাম্প জনপ্রিয়, অতএব প্রশ্নাতীত। তাঁর আছে গণসমর্থন, সুতরাং এই দক্ষিণপন্থী আবহাওয়ায় ট্রাম্পকে নেহাত অভিযোজনেরই জন্য সমঝে চলবে বড় মিডিয়া।

যুগধর্মে মিডিয়ার স্রোত পাল্টাতে বাধ্য, তার দ্বিতীয় যুক্তি হল, আমরা এই শতকে বেঁচে থাকি অনন্ত ব্র্যান্ড-বাস্তবতায়। অথচ, আগের লিবারাল ডেমোক্রেসিতে আমাদের অস্তিত্বের শর্তই ছিল নাগরিকতা। এক সু-নাগরিক হতে পারা ছিল আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত। অর্থনীতির ধাঁচে ইতোমধ্যে আমূল প্যারাডাইম শিফট ঘটে গেছে, আমরা সরে এসে বদলেছি কনজিউমারে, শপিং মলের চমৎকার জিন্স, সৃজিতের সিনেমা, কফিকাপে চে’র ছবি থেকে ইলেকটোরাল গণতন্ত্রে মোদীর মুখের কোনও দূরত্ব নেই, প্রতিটিই তার গুণমানে, ব্যবহারযোগ্যতায় এক-একটি তুরন্ত, এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড। ২৩৫-৩০’এর সরকার নিয়ে আনন্দবাজার নামকরণ করেনি, ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ?’ সে তো সেই ২০০৬ সালের কথা। হালে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখকে সামনে রেখে যথেচ্ছ অনলাইন প্রচার হয়েছে আমেরিকায়। অত দূরেও যাওয়ার দরকার নেই, সহজ কথাটা এ ভাবেও উঠতে পারে: আজ যে মিডিয়াপৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পেজ থ্রি-তে সিনেমার প্রমোশনাল প্রচার পড়ছি, টিভিতে দেখছি ভাড়া করা রিভিউ, এবং তা বিজ্ঞাপন হিসেবে নয়, খবর হিসেবেই: সেখানে এই প্রবণতা এক দিন গণতন্ত্রের পরিধিতে আক্রমণ শানাতই, কেন না ভোট এবং ফিল্ম দুটির বাজারমূল্যই এক, দুটিই ব্র্যান্ড, দুটোতেই আপনার স্থিত হওয়ার দায় নেই, আপনি ইনভেস্ট করতে পারেন বড়জোর।

যাঁরা কোবরার স্টিং অপারেশনে ব্যতিব্যস্ত, তাঁরা কি প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার বিকল্প বলতে পারবেন এই মুহূর্তে? পারবেন, কারণ সেই আগন্তুক ইতোমধ্যে হাজির– সোশ্যাল মিডিয়া। এবং সোশ্যাল মিডিয়া দাঙ্গায় উস্কানি দেয়, দিনকে রাত করতে পারে, গ্রাহকের মনেজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকার ভোটে কিংবা বসিরহাটের দাঙ্গায়। হোমো সেপিয়েনদের পপুলার ইতিহাস লিখেছেন যিনি, সেই জুবাল নোয়া হারারির বক্তব্য: আমরা ক্রমশ চলেছি এক ডিজিটাল একনায়কতন্ত্রের অভিমুখে। সময়ের রং মিলিয়ে নিয়ে দেশকেও হয়ে উঠতে হয় ডিজিটাল। আপনি যখন ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলেন, তখন ছোট্ট করে লেখা থাকে: এর বিনিময়ে আপনার যাবতীয় তথ্য অ্যাক্সেস করতে পারে ফেসবুক। নাওমি ক্লাইন দেখাচ্ছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তর্ভুক্তির ফলে গড়ে উঠছে এমন বিপুল তথ্য-সাম্রাজ্য, যা পরিচালনা করে রাষ্ট্র, মিডিয়া, কর্পোরেট। এই মিডিয়া মানে স্বভাবতই কোবরাপোস্টের উদ্দিষ্ট মিডিয়া নয়, তার চেয়ে ঢের ক্রূর, প্রবল। আমাদের মনে হয় যেন সেই ইউটেলিটেরিয়ান মডেলের প্যান অপটিকনে বন্দিদের মতো, অসহায়, অন্ধ। সেখানে আপনি এক দুনিয়াব্যাপী যোগসাজশে অনিবার্য আটক। খুব স্বাভাবিক যে গণমিডিয়ার এই বিপুল প্রতাপে অসহায় ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া। কথা হল, সেই সোশ্যাল মিডিয়া, যা কি-না চেনা গণমাধ্যমের সর্বরোগহর, আদতে ভিন্নমতের প্রকাণ্ড কসাইখানা মাত্র, সামাজিক প্রশাসনে ভরপুর, ফলস নিউজের আঁতুড়ঘর। এ’ হেন সোশ্যাল মিডিয়াকে অপাপবিদ্ধ নয়, আরও প্রত্যক্ষ ও জটিল কর্পোরেট জন্মদাগ তার রয়েছে, যার আছে সূক্ষ্মতর রাজনৈতিক দায় ও অভিসন্ধি।

জানলাম, শেখর গুপ্ত টুইটে বলেছেন, স্টিং অপারেশন কোনও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাক্ষ্য বহন করে না। এবং, যথার্থ বলেছেন তিনি। এই যে মিডিয়ার সর্বপুলিশি, এক্সপোজ করে দেওয়ার উদগ্র দায়, একে পঁচিশ দিয়ে গুণ করলেই তাকে বলা হয় ইয়েলো জার্নালিজম। যাঁরা সত্য, এথিক্স ইত্যাদি নিয়ে সঙ্গত কারণেই বেদনাব্যাকুল, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যাক, টাকা নিয়ে খবর করা এবং স্টিং দুয়ের ইতরবিশেষ পার্থক্য সামান্যই, দুয়েরই আঁতুড় এক অভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, গত শতকের মার্কিন সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা। যাঁরা সৎ, নৈতিক সাংবাদিকতা আশা করছেন ভারতের লিবারাল মিডিয়ার কাছে, অথবা গণতান্ত্রিক অভ্যেস আশা করেন শাসকের কাছে, তাঁদের বলার, অর্ণব গোস্বামীর উগ্রতাই এ’ যুগের সংবাদের নিয়তি, অথবা, টাকা নিয়ে খবর করার চক্র। যাঁদের ওই প্রান্তে দাঁড়ানোর ছিল, তাঁরা দাঁড়াচ্ছেন, এবং পক্ষ গড়ে উঠছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই নিষ্ফল অথচ ধ্রুব দ্বৈততাই মিডিয়ার একমাত্র যুগধর্ম, কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনে বোধহয় তার ব্যাত্যয় হওয়ার কথাও ছিল না কখনও।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...