দেবব্রত শ্যামরায়
পবিত্র রমজান মাস শুরুর ঠিক দু’দিন আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের পক্ষে থেকে এক চমকপ্রদ ঘোষণা শোনা গেল, নিজের টুইটার বার্তায় রাজনাথ জানালেন জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে হানাদারি হামলায় আপাতত বিরতি দিতে বলা হয়েছে। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, উপবাসের মাস যাতে নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণভাবে কেটে যায় তা সুনিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ। যদিও এই সংঘর্ষবিরতি সর্বাঙ্গীণ হলেও শর্তসাপেক্ষ কিনা, এই গুঞ্জন ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জম্মু ও কাশ্মীর সফরের ঠিক চার দিন আগে এই সংঘর্ষবিরতি ঘোষিত হল।
… বিভিন্ন মহল থেকে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সন্দেহ এমনকি সরাসরি প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও, এই পদক্ষেপ বিরামহীন হিংসায় বিধ্বস্ত কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কাছে আশার আলো নিয়ে এল। কাশ্মীরি উগ্রপন্থী যারা গত কয়েক বছর ধরে জঙ্গি শিবিরে যোগ দিচ্ছে, তাদের হত্যা এবং এই ঘটনার আনুষঙ্গিক ক্ষতি হিসেবে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি — এর কোনওটাই আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। একাংশ মনে করছে যে কাশ্মীর ভারত রাষ্ট্রকে বাধা দিচ্ছে, এই সংগ্রাম এমন এক উচ্চতায় চলে গেছে যে সাধারণ মানুষ একটা লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে কোনও কোনও মৃত্যুকেও উদযাপন করতে ইতস্তত করছে না। কিন্তু, আমি মনে করি, এই মতামত কাশ্মীরের সংখ্যাগুরু জনগণের অবস্থান নয়। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতি দিল্লির অত্যন্ত খারাপ নীতি ও ব্যবহারের পরেও, সংঘর্ষবিরতির এই সাম্প্রতিক ঘোষণাকে কাশ্মীরের মানুষ সাধুবাদই জানাবে।
উপরের লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল মে মাসের ১৮ তারিখ, কাশ্মীরের ইংরেজি দৈনিক ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এ। লেখাটি যাঁর, সেই সৈয়দ সুজাত বুখারি ছিলেন দৈনিকটির মুখ্য সম্পাদক, দেশের এক বরিষ্ঠ ও সম্মানীয় সাংবাদিক। গত ১৪ই জুন সন্ধে সাতটা নাগাদ, যখন তিনি শ্রীনগরের কেন্দ্রে পত্রিকাটির অফিস থেকে বেরোচ্ছেন, বাড়ি যাবার জন্য গাড়িতে উঠছেন, সামনের রাস্তায় তিন আততায়ী বাইকে এসে হাজির হয় এবং বুলেট-বৃষ্টি শুরু করে। বুখারির মাথা ও তলপেটে আগ্নেয়াস্ত্র খালি করে দেয় তারা। ঘটনাস্থলে বুখারি সহ তাঁর এক দেহরক্ষী মারা যান ও আরেক দেহরক্ষী, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, গুরুতর ক্ষত নিয়ে শ্রীনগরের হাসপাতালে মত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
ঘটনাটি দেশ তথা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তুলে দিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার পাশাপাশি ভারতে সাংবাদিকদের সুরক্ষার প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। গত বছর আমাদের দেশে ১১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন ও ৪৮ জনকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড এখনও আমাদের স্মৃতিতে টাটকা। ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস’ (RSF) দ্বারা নথিবদ্ধ ‘ওয়র্ল্ড প্রেস ফ্রিডম’ তালিকা যা কিনা সারা বিশ্বে তুলনামূলক গণতান্ত্রিক পরিসরের এক সূচক, তাতে ভারতের স্থান এ বছর নিন্দনীয়ভাবে ১৩৮তম, যা পাকিস্তানের চেয়ে মাত্র এক ধাপ এগিয়ে। আমরা অবশ্য এখনও জানি না, বুখারি হত্যা আমাদের পাকিস্তানের চেয়েও নীচে নামিয়ে দিল কিনা। গত কয়েক বছরের সমীক্ষার ভিত্তিতে RSF-এর বক্তব্য, স্বাধীন মত রাখার ‘অপরাধে’ ভারতবর্ষে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মৌখিক নিগ্রহ ও শারীরিক হিংসার মধ্যবর্তী রেখাটি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
সুজাতের হত্যার দায় কোনও জঙ্গি সংগঠন এখনও অবধি স্বীকার করেনি। লস্কর-ই-তৈবা এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে, পাশাপাশি নিন্দাবার্তায় এই লাইনটিও জুড়ে দিয়েছে যে ভারত রাষ্ট্র যাঁদের শত্রুভাবাপন্ন বলে মনে করে অর্থাৎ যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বস্ত, তাঁদের শেষমেশ এই পরিণতিই হবে। বলাই বাহুল্য, স্পষ্টতই এতে বুখারিকে নিজেদের শিবিরের লোক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে। বুখারি অবশ্যই একজন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, এই অর্থে যে তিনি কাশ্মীরের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। গত চার বছর ধরে সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের পরামর্শে নয়া দিল্লি জঙ্গি দমনের নামে নাগরিকদের ওপর যে লাগামছাড়া উৎপীড়ন নামিয়ে এনেছিল, বিক্ষোভকারী নাগরিকদের উপহার দিয়েছিল আংশিক বা পূর্ণ অন্ধত্ব, বুখারি নিজের কলামে ও অন্যত্র তার তীব্র নিন্দা করে গিয়েছেন। এবং এতদসত্ত্বেও, তিনি একথা বিশ্বাস করতেন কাশ্মীরের ‘অচ্ছে দিন’ পাকিস্তানের হাত ধরে চললে আসবে না, বরঞ্চ তা নির্ভর করছে জম্মু ও অবশিষ্ট ভারতবর্ষের সঙ্গে কাশ্মীরের সুসম্পর্কের ওপর। তাই রমজানের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এই অপ্রত্যাশিত সংঘর্ষবিরতির সিদ্ধান্তকে শান্তিপ্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন, পাশাপাশি, উপযুক্ত পরিবেশে হুরিয়তসহ অন্যান্য তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলির সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করার জন্য প্রশাসনকে উৎসাহিত করেছিলেন।
সংঘর্ষবিরতি ও শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রতি বুখারির সমর্থন এবং ‘ট্র্যাক টু কূটনীতি’র সপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টায় প্রমাদ গুনেছে আই এস আই। কাশ্মীরের মানুষ ও ভারত রাষ্ট্রের যেকোনও শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আঘাত করে। তাই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বুখারিকে ‘ভারতের দালাল’ আখ্যা দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় প্রচার চলেছে জোর কদমে। রমজানের মধ্যেও সীমান্তের ওপার থেকে নানা ছোটবড় নাশকতা অব্যহত রাখা হয়েছে। সরকার ও সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে আই এস আই ও তার ‘রাষ্ট্রহীন’ কুশীলবেরা, যাতে এই ঘোষিত সংঘর্ষবিরতি ভেঙে যায়। তাই যখন ১৪ জুন সকালে রাজৌরি জেলায় নিজের গ্রামে ঈদের ছুটিতে ফিরে চলা সৈনিক আওরঙ্গজেবকে হত্যা করল হিজবুল মুজাহিদিন, সেই ঘটনাটিকেও একই প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। হয়তো শেষমেশ সুজাত বুখারির মতো আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত সাংবাদিককে হত্যা করে কাশ্মীরের জনগণকে এই বছর ঈদের সেরা উপহার দিল আই এস আই।
শুধু সাংবাদিক নয়, কাশ্মীরের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম যে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কৌম ‘আদাবী মারকাজ কার্মারাজ’, বুখারি তার সদস্য ও সভাপতি ছিলেন। ইংরেজি, উর্দু, ও কাশ্মীরি — এই তিন ভাষায় নিরন্তর লিখেছেন। মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় কাশ্মীরি একটি ভাষা হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের স্কুল পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাশ্মীরের সমাজ ও সংস্কৃতিকে তিনি হাতের তেলোর চেয়েও ভালো চিনতেন, তাই তাঁর লেখালেখিতে এক চূড়ান্ত মানবিক ভারসাম্য ছিল, যা কাশ্মীরি উগ্রপন্থা ও রাষ্ট্র কারও কাছেই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি কাশ্মীরে ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদ প্রতিনিধি ও পরে ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ করেছেন, বা বিগত এক দশক ধরে তিনি যখন নিজস্ব দৈনিক ‘রাইজিং কাশ্মীর’ প্রকাশ করে চলেছেন, পুরো সময়কাল জুড়েই তাঁর কাজে তাঁর এই অবস্থান ও আপোষহীনতার চিহ্ন স্পষ্ট। যে সত্য প্রকাশে একনিষ্ঠ ছিলেন বুখারি, সেই সত্যের রঙ পুরোপুরি সাদা নয়, কালোও নয়, বরং তা কিছুটা ধূসর, এবং প্রকৃত প্রস্তাবে বহুস্তরীয়। কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে, অভিজ্ঞতা, বোধ ও সংবেদনশীলতা দিয়ে যে সামান্য ক’জন মানুষ এটা বুঝতেন, সুজাত বুখারি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। সুজাতের হত্যা নিঃসন্দেহে কাশ্মীর ও ভারতীয় গণতন্ত্র উভয়কেই আরও রক্তাক্ত, আরও রিক্ত করে গেল।
ISI-i merechhe? sure?
হত্যার মোটিভ সেদিকেই আঙুল দেখাচ্ছে। ইন্টেলিজেন্সের খবরও তাই।
hmm…. intelligence to bolbe naturally… kintu kashmir-er moto ekta bohumatrik somosyay bodhhoy puro nishchit na hoye emon statement deoya thik na. aar motive-er katha jodi bolen, apni-i bolechhen tini sob pokkheri biragvajon chhilen…