প্রবুদ্ধ বাগচী
এটি একটি বিতর্কের এক পক্ষ। একই সাথে পড়ুন শতাব্দী দাশের লেখাটি। বিতর্কে অংশ নিন। -- স্টেশন মাস্টার
বেশ কয়েকমাস আগে রাজ্য পুলিশের এক মাঝারি মাপের আধিকারিক কথায় কথায় বলছিলেন, আমাদের দেশে নাকি দেশের আইন কানুন (law of the Land) বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধ্যানধারণা ও সচেতনতা নিতান্তই কম। কথাটা যে ভুল তা নয়। কারণ, আমাদের এই ভূখণ্ডে সাক্ষরতার হার যাই হোক, মোটামুটিভাবে মাঝারিমানের শিক্ষিত নারীপুরুষের সংখ্যা যথেষ্টই কম। আর, আমাদের বেশিরভাগ আইনই রচিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের ছায়ায় — ফলে আইনের বইপত্র, রায়, আইনি চর্চা সবই ইংরিজি ভাষাকেন্দ্রিক। এমনকি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদালতের বিচারপতিকে এখনও ইংরিজি ভাষায় ‘প্রভু’ বলে সম্বোধন করতে হয়। আদালত কক্ষে বিচারপতি ও আইনজীবীদের বিচিত্র এক পোশাক পরে থাকতে হয়, যা রীতিমতন হাসির ব্যাপার।
কিন্তু আদালত ও আইনচর্চার এই যে একটা শক্তপোক্ত বেড়া এর ফলে একেবারে সাধারণ স্তরের মানুষ যেমন পুরো বিষয়টা থেকে নিজেদের বিযুক্ত রাখতেই পছন্দ করেন, অন্যদিকে, আরেকদল, যারা নিজেরা খানিকটা জানেন বোঝেন তাঁরা অনায়াসেই ঢুকে পড়তে পারেন এই চৌহদ্দিতে। ‘পুলিশে ছুঁলে আটাত্তর ঘা’ এই চলতি প্রবাদবাক্য আসলে তো একটা সামাজিক বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত করে! যে ‘আটাত্তর ঘা’য়ের কিছুটা আসে আইন বিষয়ক অজ্ঞতা থেকে, কিছুটা আসে আইন প্রক্রিয়ার ব্যয়বহুল উপচার এবং তার এক প্রবাদপ্রতিম দীর্ঘসূত্রিতা থেকে। কিন্তু যে সমাজে সমস্তরকম বৈষম্যের ভরাট আয়োজন সেখানে একদল শিক্ষা ও অর্থের জোরে আইনি প্রক্রিয়ায় অনায়াসে ঢুকতে পারবেন ও তার থেকে প্রতিকার আদায় করে ঘরে ফিরবেন এবং অন্য আরেক দল সেই বৃত্তের বাইরে মানহারা দাঁড়িয়ে থাকবেন, এ তো প্রায় চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। আইনের চোখে হয়তো সকলেই সমান, কিন্তু সামাজিক ভারসাম্যের বেলায় তো এই আপ্তবাক্য খাটে না!
এই পর্যন্ত ঠিকই আছে, কিন্তু আমরা আমাদের প্রসঙ্গটা এবার ঘুরিয়ে নিতে চাইব অন্যদিকে। গত কয়েকদশক ধরে ‘হেজিমনি’ শব্দটা খুব শোনা যায় — সোজা বাংলায় এর মানে এক ধরনের আধিপত্যবাদ, আর সেটা কোনও অবস্থানগত কারণে। বিশ্বের তেল উৎপাদক দেশগুলি তাদের অবস্থানগত কারণে বিশ্বরাজনীতিতে এক ধরনের আধিপত্য চালায়, মার্কিন দেশ নিজেদের আর্থিক সমৃদ্ধির জোরে একরকম আধিপত্য বিস্তার করে, দেশের মধ্যে কর্পোরেটরা নিজেদের লবির জোরে সরকারি নীতি নির্ধারণে একরকম আধিপত্য খাটায়। একইভাবে দেশের বেশ খানিকটা উচ্চশিক্ষিত ও আর্থিক বিচারে সচ্ছল হিসেবে আমি তুমি সে ও সখা একরকম পরোক্ষ হেজিমনি তৈরি করতে পারি ও করি। আর সেই সূত্রেই চলে আসে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতার কথা, যা হয়তো আরেক আধিপত্যবাদেরই গল্প। কেমন সেটা একটু খুলে বলা যাক।
আমাদের সামগ্রিক আইনব্যবস্থার মধ্যে কতগুলো নিহিত ভাবনা ও ভাবাদর্শ রয়েছে — যেমন, কোনও নিরপরাধ যেন সাজা না পায়, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে কোনও নির্যাতন হলে তা আইনের বিচারে গুরুতর অন্যায় যে কারণে পুলিশ হেফাজতে গৃহীত কোনও জবানবন্দি আদালতগ্রাহ্য নয়, যেমন কোনও ফৌজদারি মামলায় কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হয়, পুলিশ হেফাজতে বা জেল হেফাজতে বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত প্রত্যেকে কিছু অধিকার ভোগ করেন, এমনকি শ্রমের বিনিময়ে তাদের মজুরি দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলে আমাদের বিশ্বে পরিচয়। সেদেশের নিয়মকানুনের মানবাধিকার, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, সাম্যের অধিকার এগুলো স্বীকৃত হবে এ তো সহজ সত্য! কিন্তু আইন যেহেতু সমাজবহির্ভূত কোনও স্বয়ম্ভূ বিষয় নয় তাই সমাজের নানা বাস্তবতা, ঘাত প্রতিঘাত আইনের দর্শনের মধ্যেও ছায়া ফেলে যায়। সেই সমাজসত্য জানায়, গরিব মানুষরা বিচারব্যবস্থার কোনও সুযোগ প্রায় পান না যতটা পান সম্পন্ন মানুষরা। এটা একদম সাদা কালোর বিভাজন, আদর করে তাকে যে নামেই ডাকি। এখন যেহেতু সমাজের চাপ ও ছাপ আইনের শরীর নির্মাণ করে তাই আমাদের চেনা সমাজে যে নারীপুরুষ বৈষম্য ও তারই মধ্যে পুরুষদের বেশ কিছুটা সামাজিক কৌলীন্য যা তাদের চালিত করে নারীদমনে যা বদলে যায় নিপীড়ন ও নির্যাতনের কালিমায়। এই বাস্তবতা কম বেশি সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে কিছুটা বা বাতাসের মতোই। সমস্ত ধর্মই যেহেতু পুরুষ-প্রণীত এবং সেখানে নারীদের অবস্থান অপমানের তলে তাই আমাদের মতো অনেকটা ধর্ম-আশ্রিত সমাজে ঘরেবাইরে সর্বত্রই নারীকে ছোট করে দেখা, তাদের ওপর কিছু অবদমনের চাপ ও পরোক্ষে নির্যাতনের অনুমোদন সব ধর্মেই কম বেশি আছে। তার ওপর জাতিভেদদীর্ণ হিন্দু সমাজে পণ দেওয়ানেওয়া, তার কারণে বধূনির্যাতন একেবারে এক প্রত্যক্ষ বাস্তব। এইসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশের আইনসভা নারীদের পক্ষে কিছু আইন তৈরি করেছেন গত চার দশকে — যেমন, বধূনির্যাতন প্রতিরোধী আইন (১৯৮৩), যাকে অনেকেই চেনেন ৪৯৮/এ নামে, আছে পারিবারিক হিংসা থেকে নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার আইন (২০০৫)। আর সামগ্রিকভাবে নারী নির্যাতনের প্রতিরোধে একটা আইন আগেই ছিল তফসিলী জাতি ও উপজাতিদের জন্য হিংসা প্রতিরোধে আইন আর ২০১২তে ‘নির্ভয়া কাণ্ড’র পরে ঢেলে সাজানো নারীনির্যাতন প্রতিরোধ আইন (২০১৩)। এগুলির প্রতিটিই নিশ্চয়ই সাধু উদ্দেশে রচিত, অন্তত আইনপ্রণেতারা তেমনই মনে করেন।
কিন্তু এইখানে এসে ভয়ে ভয়ে কিছু কথা। ওইসব আইনের ধারা উপধারাগুলি একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় দেশের প্রচলিত আইনের দর্শনের সঙ্গে এই আইনগুলির বিস্তর তফাৎ। যেমন গোড়ার দিকে ৪৯৮/এ ধারায় অভিযোগ পাওয়ামাত্র আপাত অভিযুক্তদের সকলকে জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করা হত, কোনও তদন্ত না করেই। সাধারণ ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে এমন হয় না। পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনে প্রথমে কেবলমাত্র অভিযোগকারিণীর বক্তব্যই লিপিবদ্ধ করা হয়, অন্যপক্ষকে কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় না — যতক্ষণ না পর্যন্ত আদালত সেই সুযোগ অনুমোদন করেন। তফসিলী জাতি, উপজাতিদের জন্য সুরক্ষিত আইনে এবং সদ্য চালু হওয়া নারীনির্যাতন প্রতিরোধী আইনে অভিযুক্তকে নিজের অপরাধ অপ্রমাণ করতে হয় যা আমাদের আইন ধারার সাধারণ প্রবণতা নয়। বরং এই অভিমুখ আমাদের মনে করায় কুখ্যাত আফস্পা আইনকে, যেখানে সুরক্ষাবাহিনীকে যে কোনও কাউকে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা আছে, মনে করায় সাম্প্রতিক কালের ইউ এ পি এ আইনকে যেখানে জামিন না দিয়ে বিনা বিচারে ছয় মাস অবধি আটকে রাখার অনুমোদন আছে। কিন্তু চূড়ান্ত নিপীড়নমূলক ওই শেষোক্ত আইনগুলি যত নিন্দিত, প্রথমগুলি নয়। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যায় সাম্প্রতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধী আইনে ‘আড় চোখে কোনও মহিলার দিকে তাকানো’ (Stalking), ‘কারও পেছনে অসদুদ্দেশে ধাওয়া করা’ (chasing) এই ধরনের কিছু ধারা রয়েছে যা একেবারেই ধূসর ও অস্পষ্ট শুধু নয় একেবারেই সাবজেক্টিভ — কারণ এইসব ঘটনার কোনও প্রামাণ্যতা থাকে না। না থাকলেও এগুলি রাখা হয়েছে কারণ এই আইনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য নারীসুরক্ষা, আর তার প্রধান অন্তরায়, ধরেই নেওয়া হয়েছে, পুরুষ। তাই তাদের সম্ভাব্য অপরাধী ধরেই এইসব ধারা উপধারার নির্মাণ। এটা পরিষ্কার যে সামাজিক বাস্তবতার কাছে নতজানু হয়ে এই আইনগুলি এক ধরনের পক্ষপাতে ঝুঁকে থাকে।
২.
আগেই এই কথা বলা হল যে, আইনের সুবিধে নেওয়ার সক্ষমতার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটা বড় প্রাকার। সাধারণভাবে কোনও মহিলা এই ধরনের ঘটনার শিকার হলে থানা, পুলিশ, আইন, আদালত, আইনজীবী ইত্যাদির জন্য যে ব্যয় হয় — খুব সাধারণ ঘরের নিম্ন আয়ের মহিলাদের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। কাদের সম্ভব? কোনও নির্যাতিতা মহিলা যদি নিজে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ও স্বাবলম্বী হন অথবা তার বাবা-মায়ের পরিবার যদি সচ্ছল ও একটা বিশেষ সামাজিক উচ্চতায় অবস্থান করেন তবে তাঁরা এইসব আইনি প্রতিকারের কথা ভাবতে পারেন, অন্যথায় নয়। ‘নারীনির্যাতন প্রতিরোধ আইন’টি বিবাহিত অবিবাহিত সমস্ত নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেই আইনেও প্রতিকার চাইতে গেলে অভিযোগকারীর আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির সঙ্গে আইনি প্রতিকার একেবারেই সমানুপাতিক। কারণ, রাস্তাঘাটে দুর্বৃত্তদের হাতে লাঞ্ছিত হলে একেবারে সাধারণ মেয়েরা তার প্রতিকারে সোচ্চার হতে পারেন না তার একটা কারণ যদি হয় এইসব আইনের খবর তাদের স্তর অবধি পৌছায়নি অন্যটা হল নিজের বেইজ্জতির খবর স্থানীয় থানায় গিয়ে নথিভুক্ত করানো ও তার পরের ‘হ্যাপা’ পোহানোর মতো জোর তাদের সাধ্যে কুলোয় না। এইসব ক্ষেত্রে আমজনতাকে সচেতন ও সহায়তা করার জন্য অনেক অসরকারি সংস্থা আছে, তাদের কাজকর্মের পরিধিও একটা নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনে দেশের সব জেলাসদরে একজন করে নারী সুরক্ষা আধিকারিক রয়েছেন — কিন্তু একজন প্রত্যন্ত গ্রামের নিপীড়িত মহিলার পক্ষে কি সম্ভব একা বা অন্য নির্ভরযোগ্য কারও সঙ্গে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে জেলাসদরে এসে তার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা বা সহায়তা চাওয়া? এই রাজ্যে কলকাতা লাগোয়া ছোট জেলা হাওড়ায় সবথেকে দূরবর্তী ব্লক থেকে জেলা সদরে আসতে যাতায়াতের গাড়িভাড়াই লাগে ষাট-সত্তর টাকা, সময় লাগে এক পিঠেই তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা। একদম গরিব ঘরের মেয়েরা পারবেন? পারছেন কি? আবার পুরনো নিয়ম অনুযায়ী বধূনির্যাতন প্রতিরোধ আইনে (৪৯৮/এ) অভিযোগ করা মাত্র মহিলাটির স্বামী ও তার পরিবারের অন্যরা গ্রেফতার হয়ে যেতেন (কিছুকাল হল আইনের এই ধারা সংশোধিত হয়েছে) ফলে ওই মহিলা যদি নিজে স্বাবলম্বী না হন তাহলে ওই ভেঙে যাওয়া পরিবারে তিনি থাকবেন কী করে? অথবা ওই বধূর নিজের পরিবারের অবস্থাও যদি সচ্ছল না হয় তাহলে ওই মেয়েটি কী করবেন? তার ওপর যদি তার কোনও সন্তান থাকে এবং এই বিপর্যয়ের দায় সেই শিশুটিকেও বয়ে বেড়াতে হয় — তারই বা কী হবে? কী হত?
না, আমরা এইসব প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে চাই না। বরং বলতে চাইব এইটাই — আরও পাঁচটা আইনি প্রক্রিয়ার মতোই নারীবিষয়ক পক্ষপাতময় আইনগুলির সুবিধাপ্রাপক সেই সব মহিলারাই যারা নিজেরা আর্থিকভাবে সবল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনেক কিছুর খবর রাখতে পারেন, বুঝতে পারেন — তথ্যকে ক্ষমতার উপাদান বলা হচ্ছে ইদানিং, এখানেও সেই তথ্য হয়ে উঠছে তাদের পায়ের তলার মাটি। আইন তাঁদের সামনে যে ঢালাও প্রতিকারের উপায় খুলে দিয়েছে তার প্রতিটি প্রান্ত থেকে, তাকে ব্যবহার (?) করে তাঁরা নানাবিধ সুবিধে পেয়ে আসছেন — এই বিষয়ে খুব একটা মতান্তরের পরিসর নেই।
কিন্তু মুশকিল হল, কারও হাতে গুলিভর্তি বন্দুক তুলে দিলে সেই বন্দুকের গুলি সুনির্দিষ্ট অপরাধীর পায়েই লাগবে এর কোনও নিশ্চয়তা কোনওকালেই ছিল না এখনও নেই। পুলিশবাহিনী থেকে মাওবাদী, সামরিক জওয়ান থেকে সন্ত্রাসী জঙ্গি কেউই এর বিপজ্জনক অপব্যবহারের ব্যতিক্রম নয়। তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি কেবলই দিগভ্রষ্ট হতে থাকে ও কেড়ে নিতে থাকে নিরপরাধীর প্রাণ। বস্তুতপক্ষে নারীপ্রজাতি সমাজের এমন কোনও সংরক্ষিত অংশ নন যে তাঁরা মানবপ্রজাতির নেতিবাচক প্রবণতাগুলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হচ্ছে — হয়ে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে। অর্থাৎ, নারীসুরক্ষার আইনি বলয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে আইনি কামান, তাতে যদি একজন প্রকৃত অপরাধীর সাজাও হয়, অন্তত দশজন নির্দোষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভারতীয় আইনের মূল দর্শন তো এমন নয়?
আরও আক্ষেপের কথা, আরক্ষা বাহিনীর বেপরোয়া গুলি বর্ষণে যদি সাধারণ নির্দোষ মানুষ হতাহত হন তাহলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অধীনে রাষ্ট্রের পক্ষে তার তদন্ত হয়, দোষীকে চিহ্নিতকরণ ও শাস্তিনির্দেশও কমবেশি হয়। এমন কিছু ঘটলে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় মানবাধিকার সংগঠনগুলিও সোচ্চার হন, সক্রিয় হন — পাল্টা আইনি প্রতিকারের দাবিতে আদালতে আসেন। দেশের মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন এই অবিচারের নিরসনে। কিন্তু একজন পুরুষ যদি সম্পূর্ণ অকারণে তার স্ত্রী-র দ্বারা হেনস্থা হন, তাকে মিথ্যে মামলার জালে জড়িয়ে বিপন্ন করা হয় তখন কিন্তু কোনও মানবাধিকার কমিটি বা কমিশন আগ্রহী হন না এই অবিচারের প্রতিকারে — তাঁদের বিচারে এটা ব্যক্তি পরিসরের বিষয়। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে সেটা গ্রাহ্য নয়? ‘হেজিমনি’ কথাটাকে আবারও ফিরিয়ে আনি। আইনি পরিষেবার সুযোগ ও তাকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক গণ্ডিতে প্রাগ্রসর মহিলারাই এগিয়ে আছেন — আর এই সুবিধেসুযোগ পাওয়ার একচেটিয়া অবস্থান এইসব আইনগুলির নিরিখে ক্রমশ তৈরি করছে এক স্পষ্ট অথচ নিঃশব্দ আধিপত্যবাদ, তার নানামাত্রিক আগ্রাসী সত্তাকে ধারণ করেই।
৩.
এই পর্যন্ত এসে যারা এই প্রতিবেদনে নারীদ্বেষের ছোঁয়াচ পাচ্ছেন বলে আশঙ্কিত তাঁদের জন্য সবিনয়ে কয়েকটা জরুরি তথ্য। ইচ্ছে করলে যে কেউ এগুলো একটু খুঁজেপেতে নিতে পারবেন। বধূনির্যাতন বিষয়ক বহু বিতর্কিত ও আলোচিত ৪৯৮/এ ধারা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট তার একটি রায়ে বলেছেন, এই আইনের (৪৯৮/এ) ব্যাপক অপব্যবহার ক্রমশ একটি ‘লিগ্যাল টেররিজম’-এর জন্ম দিচ্ছে যা একেবারেই অবাঞ্ছিত (সিভিল আপিল নম্বর ৪৩৯৯/২০০৫)। বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টগুলি তাঁদের পর্যবেক্ষণে একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে এই অবস্থার অবসান চেয়েছেন। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মিথ্যা অভিযোগের শিকার নিরপরাধ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অসহায় অবস্থায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পূর্বতন ‘ডাউরি অ্যাক্ট’ পরিবর্তন করে ১৯৮৩ সালে ৪৯৮/এ আইনটি তৈরি হয়েছিল — ২০০৫-এ করা কাউন্সিল অফ সোস্যাল রিসার্চ-এর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে এই ধারায় দায়ের করা অভিযোগের নব্বই শতাংশের বেশি ভুয়ো ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এইসব নানা সমীক্ষার সূত্রেই সুপ্রিম কোর্ট বলছেন, বারবার যদি নেকড়ের নকল কান্না শোনা যায়, তাহলে সত্যি সত্যি কখনও নেকড়ে এসে পড়লে তার থেকে বাঁচবার সাহায্য ও সহায়তা পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে (If the cry of Wolf is made too often as a prank, assistance and protection may not be available when the actual wolf appears)। এইসব পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়ার যে সারবত্তা আছে তার প্রমাণ, গত কয়েক বছরে এই আইনের ধারা বারবার সংশোধন করা হয়েছে যার অভিমুখ ছিল অপব্যবহার আটকানো।
যদি পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধী আইনটির কথা বিচার করি তাহলে দেখব এই আইনটির কথা ভাবাই হয়েছিল ৪৯৮/এ আইনের একটা যোগ্য বিকল্প হিসেবে। কারণ ৪৯৮/এ একটি ফৌজদারি আইন হওয়ায় এতে আপাত অভিযুক্তরা হেফাজতে থাকলে তার ছাপ গোটা পরিবারের ওপর পড়ে এবং যিনি অভিযোগ করেছেন তিনিও ব্যতিক্রম নন। তার পরিবর্তে পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধী আইন একটি সিভিল আইন যেখানে পারিবারিক হিংসা হলে সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষে একটা মিটমাট করে দেওয়ার অবকাশ আছে বা আইনে দোষী প্রমাণিত হলে কারও সাজা হচ্ছে না ফলে পরিবারগুলির পুনর্বাসনের একটা ব্যবস্থাও থাকছে। কিন্তু এই আইনের কিছু কিছু ধারা নিয়ে গোড়া থেকেই কিছু আপত্তি ছিল। যেমন, মৌখিক বা আবেগগত নির্যাতন (Verbal and Emotional abuse) বা মহিলাদের পক্ষে মর্যাদাহানিকর আচরণকেও গার্হস্থ্য হিংসার মধ্যে ধরে নেওয়া হয়েছে যা একেবারেই সাবজেক্টিভ বিষয়। কোন কথায় কে কী মনে করবেন বা করেছেন এটা একটা ধূসর এলাকা যার মধ্যে অপব্যবহারের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। উপরন্তু, এই আইনে ‘হিংসার শিকার’ প্রমাণিত হলে স্ত্রী তার স্বামীর নিজস্ব সম্পত্তি, সঞ্চিত অর্থের ভাগ পেতে পারেন — এটা একদিকে যেমন সাংবিধানিকভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকারকে খর্ব করে, অন্যদিকে আইনি রাস্তায় এক ধরনের ‘তোলা’ আদায়ের পথ খুলে দেয়। এই তোলা আদায় কথাটা হয়তো শুনতে ভাল নয় কিন্তু এই প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী মুকুল আনন্দ। তাঁর কথায়, এই আইনি পরিসর ব্যবহার করে বহু মহিলা তাঁদের স্বামীদের সরাসরি হেনস্থা করছেন। দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শিব নারায়ণ ধিংড়া একটি সাক্ষাতকারে বলছেন, সম্প্রতি ৪৯৮/এ ও পারিবারিক হিংসার আইন স্ত্রীদের হাতে তুলে দিয়েছে সেই অস্ত্র যা দিয়ে তাঁরা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অনায়াসে হেনস্থা করতে পারেন। এইসব পর্যবেক্ষণ যে নিছক কথার কথা নয় তা টের পাওয়া যায় যখন খেয়াল করা যায় ইতিমধ্যেই এই আইনে বেশ কিছু সংশোধনী এসেছে, সর্বশেষটি গত বছর (২০১৭) এপ্রিলে, যার উদ্দেশ্য অপব্যবহার কমিয়ে আনা। অর্থাৎ অপব্যবহারের সংবাদটি মোটেও উড়ো খবর নয়!
পারিবারিক হিংসা ও বধূনির্যাতন প্রতিরোধ আইনের বাইরে আরও দুটি “ড্রাকোনিয়ান” আইন আছে। একটি হল তফসিলী জাতি ও উপজাতিদের ওপর হিংসা নির্যাতনবিরোধী আইন ও শেষেরটা “নির্ভয়া কাণ্ড”র পরে নতুন চেহারায় সংশোধিত ‘নারীনির্যাতন প্রতিরোধী আইন’। স্পষ্ট করে বলে দেওয়া দরকার এই দুই আইনের উদ্দেশ্য ও অভিমুখ নিয়ে আমাদের কোনও সামান্যতম আপত্তি নেই। সামাজিকভাবে দুর্বলতম শ্রেণিকে সুরক্ষার জন্য বাড়তি আইন নিশ্চয়ই প্রয়োজন, প্রয়োজন প্রতিদিনের নারীনির্যাতনের প্রবণতাকে কমিয়ে সমস্ত নারীর সুরক্ষা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা। আইনের জুজুর সঙ্গে অপরাধের হার কমা বাড়ার সাধারণত কোনও সম্বন্ধ থাকে না তবু আইন নিশ্চয়ই থাকা প্রয়োজন এবং তার পরিসর বেড়ে ওঠাই একান্ত অভিপ্রেত। কিন্তু সমস্যা দুটো। প্রথমত, এই আইনগুলি নারীপুরুষের সাম্য নিশ্চয় করে না, পরিবর্তে তাঁদের মুখোমুখি করে দেয় একটা রিংয়ের ভিতর। পরের কথাটা হল, আইন মেনে প্রতিকার পাওয়ার পথ এত দামী ও বন্ধুর যে সেই পথে এগোতে পারেন মুষ্টিমেয় তাঁরাই যারা আবার অনায়াসেই তাঁদের সংকীর্ণ স্বার্থে এইসব আইনের অপব্যবহার করতে পারেন ওইসব ফাঁকফোঁকর কাজে লাগিয়ে। এই কটু সত্যটা বোধহয় স্বীকার করা ভালো।
‘সেভ ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন’ নামক এক অসরকারি সংস্থার মুখপাত্র শ্রী অমিত লাখানি ঠিক এইখানেই সংশয় প্রকাশ করছেন। শেষোক্ত আইন দুটি বিষয়ে তাঁর আশঙ্কা ‘ধর্ষণ করার চেষ্টা (attempt to rape), অসদুদ্দেশে তাকানো (stalking), যৌন উত্তেজনাপূর্ণ ছবি বা কার্টুন দেখানো (voyeurism) এইসব অভিযোগে গ্রেফতার করার সংস্থান নতুন এক হেনস্থার রাস্তা খুলে দিচ্ছে।’ ওই প্রতিষ্ঠানটি এই বিষয়ে একটি সর্বভারতীয় হেল্পলাইন চালান, তাঁরা গড়ে প্রতিদিন সাড়ে সাতশো ফোন পান মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে হেনস্থা করার, সারা বছরে সংখ্যাটি বোধহয় হেলাফেলার নয়।
সমস্ত উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি ও কাশ্মীরে চালু থাকা আফস্পা আইন অত্যন্ত নিন্দনীয়, ইউ এ পি এ আইন সংবিধানবিরোধী — এগুলির অবশ্যই পুনর্বিবেচনা দরকার। টাডা আইন সংসদে আইন করে বাতিল করা হয়েছিল, বাতিল হয়েছিল মিসা, নাসা এইসব দমনমূলক আইন, এসমা আইনের প্রয়োগ এখন নিয়ন্ত্রিত। তাহলে আরও যে সব আইন অপব্যবহার হচ্ছে সেগুলির কী হবে? এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, লালগড় আন্দোলনের একেবারে শুরুতে রাজ্যের পুলিশবাহিনী ছিতামণি মুর্মু নামক এক নির্দোষ আদিবাসী রমণীর ওপর নির্যাতন করে তাঁকে অন্ধ করে দেয়, ছত্তিশগড়ে নিরপরাধ সোনি সোরি নামের আদিবাসী যুবতী শিক্ষিকাকে পুলিশ নিছক মাওবাদী সন্দেহে চূড়ান্ত শারীরিক নিপীড়ন করে — এই দুটির কোনও ক্ষেত্রেই কিন্তু তফশিলী জাতি উপজাতিদের ওপর হিংসা প্রতিরোধী আইন প্রয়োগ করা হয়নি। নির্ভয়া কাণ্ডের পর আইনের রক্তচোখ যতই তীব্র হোক সারা দেশে নারীবিষয়ক অপরাধের যে খতিয়ান ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় তার সঙ্গে তা সমানুপাতিক নয়। তাহলে এইসব আইন, তুমি কার জন্য? কাদের জন্য?
আবারও ফিরে আসি সেই ‘হেজিমনি’র কথায়। আইনের সুযোগ নিচ্ছেন সম্পন্নতর শ্রেণির মহিলারা, তাকে ভুল পথে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধি করছেন তাঁরাই। কারণ, শ্রেণিসমাজে অবস্থানের ভিত্তিতে তাঁরা যে কোনও প্রতিষ্ঠানে মাতব্বরি করতে পারেন — চাইলেই তাঁরা তাঁদের পরিবার-জীবনসঙ্গীকে ‘ফাঁসিয়ে দিতে’ পারেন ৪৯৮/এ অথবা পারিবারিক হিংসা বা অন্য কোনও নির্যাতন প্রতিরোধী আইনের ধারায়। এই আশঙ্কা ও আধিপত্য দিয়ে সুস্থ সমাজ সুস্থ পরিবার গড়ে ওঠার স্বপ্ন অলীক — বড় জোর নারীবাদ নিয়ে দু চারটে দামী সেমিনার হতে পারে! পড়ে মরুক গা সেইসব পুরুষরা যারা ইউ এ পি এ কিংবা আফস্পা অথবা ৪৯৮/এ বা পারিবারিক হিংসা আইনের বলি! আসলে চাঁদের একটা পিঠ দেখা যায়, সেই পিঠটাই চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে — কিন্তু অন্য পিঠে যে কেবলই কলঙ্ক যা শুধু জাগিয়ে তুলতে পারে ‘চোখের জলের জোয়ার’।
শতাব্দী দাশ এবং প্রবুদ্ধ বাগচীর লেখা দুটো লেখাই পড়লাম। এ সব লেখার পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর কথা বলতে হয়। কেননা সমস্যাটি আমার কাছে অনেকটা ডিম আগে , নাকি মুরগি আগের মতই জটিল লাগে। গৃহ অশান্তি, নির্যাতন, প্রতারণা আছে বলেই আইন প্রণয়ন করা। আবার এই আইনের অপব্যবহারও হচ্ছে। নির্যাতনকারী এবং নির্যাতিতদের পক্ষে ও বিপক্ষে আইনের সুযোগ নেওয়া এবং দেওয়ার জন্যে ফড়িয়া এক শ্রেণী কাজ করে। এটা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে আইন সম্পন্নদের দুধেভাতেই সন্দেশ হয়ে গলে যায়।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে মিথ্যে যৌতুক, অত্যাচার , নির্যাতন মামলা করলে শাস্তির বিধান আনা হয়েছে।
দুটি লেখাই গুরুত্ব বহন করছে। শুভেচ্ছা লেখকদ্বয়কে।