সৌভিক ঘোষাল
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ মাস আগে নির্বাচন-উত্তর সমঝোতার মধ্যে দিয়ে বিজেপি-পিডিপি জোট জম্মু ও কাশ্মীরে ক্ষমতায় এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষায় এটা ছিল কাশ্মীরের বিকাশের জন্য এক অভূতপূর্ব সুযোগ। সাড়ে তিন বছর পর ক্রমপ্রসারিত সন্ত্রাসের পরিস্থিতির কথা বলে এই জোট থেকে সরে এল বিজেপি, এবং পাশাপাশি কাশ্মীরে রাজ্যপালের শাসন জারির মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীর বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আপাতত নিজের হাতে রাখল।
কাশ্মীরে বিজেপি-পিডিপি শাসনের এই পর্বে আমরা রাষ্ট্রের তরফে যে পরিমাণ আগ্রাসন দেখেছি, তাতে রাজনৈতিক সমাধানের সদিচ্ছা খুব বেশি দেখা যায়নি। বুলেট ও পেলেট-এর যথেচ্ছ ব্যবহার, সাধারণ মানুষকে আর্মি ট্যাঙ্কের সামনে হিউম্যান শিল্ড হিসেবে ব্যবহার-সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনাবলি, জঙ্গি দমনের নামে শতাধিক সাধারণ মানুষের হত্যা — সবই আমরা এই পর্বে দেখেছি।
অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁর জমানায় কাশ্মীর সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে ‘কাশ্মীরিয়াৎ জামুরিয়াৎ ইনসানিয়াৎ’-এর কথা বলেছিলেন। কাশ্মীরিত্ব গণতন্ত্র ও মানবতা — এই ত্রয়ী ধারণার কোনওটাই মোদী-শাহ জমানায় রক্ষিত হয়নি। কাশ্মীরিয়াৎ-এর কথা তোলায় স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বিজেপি-আরএসএস সাইবার আর্মির আক্রমণের মুখে পড়েছেন। একমাত্র সেনাবাহিনীর যথেচ্ছ দমন পীড়নকেই কাশ্মীর সমস্যার উত্তর হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসা দূরে থাক, জটিলতা বেড়েছে এবং কাশ্মীর উপত্যকার সাধারণ মানুষও ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছেন।
জম্মু-কাশ্মীর সরকারের শরিক হলেও মজার ব্যাপার হল গোটা কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপির একজনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। বিজেপি বিধায়কেরা সবাই জম্মু বা লাদাখ থেকে জিতে আসা। ফলে কাশ্মীর উপত্যকার সংঘর্ষ থেকে বিজেপির সেখানে জনভিত্তি হারানোর বিশেষ ভয় নেই। বরং অশান্ত কাশ্মীরকে দেখিয়ে সে অবশিষ্ট ভারতে এক ধরনের জনসমর্থন আদায় করতে চায়।
লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্কট ততই বাড়ছে। এমত পরিস্থিতিতে কাশ্মীরকে ঘিরে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধুয়ো তোলা আদতে এক ধরনের পলিটিক্যাল বেল আউটের প্রচেষ্টা।
বিজেপির আমেরিকাপন্থী ও আমীরপন্থী নীতিমালা তার গত চার বছরের শাসনে দেশে ব্যাপক অসন্তোষের মুখোমুখি হয়েছে। ডিমনিটাইজেশন, আধার, ক্যাশলেস ইকনমি সহ নানা ডিজিটাল সন্ত্রাস, জি এস টির অতিকেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক মদতপুষ্ট পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্ক লুঠ, প্রস্তাবিত শ্রম আইন সংস্কারের যে সব ব্যাপার সে একের পর এক সামনে এনেছে, তা নানা স্তরের জনগণের ক্ষোভকে ক্রমেই বাড়িয়েছে।
দলিত মুসলিমরা একযোগে তার গো-রাজনীতি আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাঁদের ও জনগণের সব অংশের বিশেষত কৃষকদের পালটা প্রতিরোধের সামনে পড়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচন ও উপনির্বাচনে বিজেপি ভালোরকম পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে। বিজেপি তাই লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তার পলিটিক্যাল বেল আউট খুঁজছে এবং কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা দেশজুড়ে চারিয়ে দেওয়া তার সচেতন লক্ষ্য।
এই কারণেই কাশ্মীরের গণতন্ত্রের লড়াই বাকি ভারতের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে সংযুক্ত। কাশ্মীরে রাজ্যপালের বকলমে কেন্দ্র তথা সেনাশাসন জারির মধ্য দিয়ে বিজেপি দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তোলার চেষ্টা করবে। সে বিষয়ে পালটা সতর্কতা অতি জরুরি।
কাশ্মীর সমস্যার যে কোনও সমাধান দাঁড়িয়ে আছে সব পক্ষের খোলামেলা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার ওপর। সেক্ষেত্রে দরকার ছিল সুজাত বুখারির মতো মধ্যপন্থীদের যাঁরা কাশ্মীরে সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবেন। বুলেট পেলেট গানের সন্ত্রাস সেই আলোচনার পরিবেশকে বিষিয়ে দিচ্ছে। কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ তাই কেন্দ্রীয় শাসন থেকে সেই শক্তির অপসারণ যারা জ্বলন্ত কাশ্মীরকে দেখিয়ে বাকি ভারতে ভোট বৈতরণী পার হতে চায়। কাশ্মীরে প্রাথমিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই দেশজোড়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে তাই নানাভাবেই সংযুক্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ফ্রন্টে এবং আসন্ন নির্বাচনে এই লড়াই সাধারণ মানুষ কীভাবে লড়েন, এখন সেটাই দেখার।