ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
‘Here lies one who spared neither man nor God; Waste not your tears on him, he was a sod; Writing nasty things he regarded as great fun; Thank the Lord he is dead, this son of a gun.”
এই কথাক’টা লিখে গেছিলেন শ্রীযুক্ত খুশওয়ন্ত সিং, তাঁর এপিটাফ হিসাবে।
সাংবাদিকেরা এমনই! সাংবাদিকতার ইতিহাস এখনকার মতো কালিমালিপ্ত না-হলেও সাংবাদিকদের আমরা– মানে ইংরিজি-কইয়ে শহুরে সাধারণ মানুষ-– কখনওই বেশ একটা ‘আপনার জন’ ভেবে বসিনি। একদিকে যেমন তাঁদের ঝাঁ-চকচকে উদ্ধত স্মার্টনেস আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অন্যদিকে তেমন নিন্দুকের নানান রটনা প্রভাবিত। ফলে, তাঁদের একটু দূরে-দূরেই রেখে এসেছি– নিরাপদ দূরত্বে যাকে বলে। এঁদের নিয়ে যতটা বিস্ময় আমাদের, সে-অনুপাতে ভক্তিজনিত জিজ্ঞাসা– জিজ্ঞাসার যে ধরনটা আমাদের ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাভাবিক– অনেকটাই কম। ফলে মনীষীজীবনী-অনুপ্রাণিত বাঙালি সাংবাদিকের জীবনকে– তাঁর বৃত্তের সেলিব্রিটিদের সম্বন্ধে একশো কৌতূহল থাকলেও দূর থেকে নমস্কার জানায়।
সম্প্রতি হাতে এল বাংলায় এই সময়ের (এটা কোটেশন মার্কেও রাখা যেত) সবথেকে খ্যাতনামা সাংবাদিক শ্রী সুমন চট্টোপাধ্যায়– যাঁকে সাধারণ বাঙালি ‘দাড়িওয়ালা সুমন’ ও ‘দাড়িওয়ালা’ শব্দের প্রায়ানিবার্য অপভ্রংশশোভিত সুমন নামে জানে– তাঁর আত্মজীবনী– My Date with History : A Memoir। বইটি প্রকাশিত হয়েছে গত বইমেলার কিছু আগে, রূপা পাব্লিকেশনস থেকে। চারশো পঁচানব্বই টাকা মূল্যের প্রায় তিনশো পাতার এই বইটি– এককথায় বলতে গেলে– সুখপাঠ্যের কিছু বেশি।
অনেক গুণী মানুষের ঢঙে আমিও ভেবেছিলাম যে এই বই ওপর ওপর পড়ে বাজিমাত করে চলে যাব, এবং একটি রিভিউ নামিয়ে দেব। কিন্তু পড়তে গিয়ে যা বুঝলাম, তা হল এই বই একবার পড়তে শুরু করলে ফেলে রাখা সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ছে, শেষ এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল অ্যালেক্স হেইলির ‘রুটস’ পড়তে বসে। সে সেই ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। এক কথায়, তাঁরই পূর্বতন নিয়োগকর্তাদ্বারা প্রকাশিত একটি মুখ্য ইংরিজি সংবাদপত্রের ট্যাগলাইন ধার করে বলতে হয়, এ-বই unputdownable!
কন্যা টুপুর যদিও তাঁকে খোঁটা দিয়েছে ill-timed nostalgia-র, তবু এ-কথা না-বলে আমাদের উপায় থাকে না– সরল অথচ সূক্ষ্ম রসিকতামিশ্রিত ভাষায় অত্যন্ত সুলিখিত এই বইটির পাতায় পাতায় স্মৃতিচারণার, কখনও কখনও স্মৃতিকাতরতারও, অভিজ্ঞান। এই বই ঘটনাবহুল বটে, তবে ঘটনাসর্বস্ব কখনওই নয়।
সুমনবাবুর লেখার প্রসাদগুণে ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখতে পাই। এই প্রসঙ্গে দুটো বিশেষ অংশের কথা বলতে চাইব। এক, তাঁর বারাণসীর পরিত্যক্ত আত্মীয়গৃহে প্রত্যাবর্তনের বর্ণনা। প্রখ্যাত, পোড়-খাওয়া সাংবাদিক সুমন এখানে প্রকৃত নিজের শৈশবে ফিরে যান, আর শেষে সুধীর মিশ্রের ‘ইয়েহ ওয়হ মঞ্জিল তো নহিঁ’-র মতন ধাক্কায় ফিরে আসেন বর্তমানে। আর এক হল বাবরি মসজিদের ধ্বংসের ঘটনা। সাংবাদিক সুমন এখানে ডায়েরির মতন রিপোর্ট দেন বটে, কিন্তু রচনার অন্তরালে তাঁর ব্যথিত, শঙ্কিত সাধারণ মুখটি আমরা দেখে ফেলি।
কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যায়, দিল্লিবাসের সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রচুর লোভনীয় প্রস্তাব এলেও সুমনবাবু যে কখনওই পাকাপাকিভাবে কলকাতা ছেড়ে প্রবাসী হবার কথা ভাবেননি, সে নাকি কেবল কলকাতায় ‘বাঘ’ হয়ে থাকবেন বলে। দিল্লির মাহৌলে অনেক বাঘের বিচরণ নাকি তাঁর না-পসন্দ ছিল। একে এই প্রতিযোগিতার চাপ, তদুপরি দিল্লিতে বাংলাভাষার কাগজের সাংবাদিক মানেই তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ফলত কলকাতার সেরা হয়ে থাকাকেই তিনি সজ্ঞানে বেছে নিয়েছেন, জনশ্রুতি এমনই।
তবে এই বই পড়ে আমার প্রথমেই যে ধারণাটা মনে এল, তা হল– কলকাতার পাট চুকিয়ে দিল্লিবাসের ভাবনাকেই কখনও আমল দিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কলকাতা নিয়ে তাঁর এত স্মৃতি, আর সেই স্মৃতির প্রতি তাঁর এতটাই মমতা তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে উঁকি দিয়েছে, তার থেকে মনে হয় অন্য কোথাও দিয়ে ঘাঁটি না-গাড়ার তাঁর যে বাসনা, তার মূলে রয়েছে এই শহর। এই শহর, যেখানে তিনি চোদ্দ বছর বয়স থেকে লড়াই করছেন। প্রথমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, পরবর্তীতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদে।
‘…nostalgia is the suffering caused by an unappeased yearning to return’। কথাটা মিলান কুন্দেরার ফরাসি নভেল ‘ইগনোরেন্স’ থেকে ধার করলাম। সুমনের লেখায়, বিশেষ করে সূচনার চারটি অধ্যায়ে এই বেদনার সুর বেজেছে অর্কেস্ট্রার সাবলেয়ারের মতন। সেই বেদনা যার সূত্রপাত পিতামাতার থেকে পাওয়া দেশভাগের হতাশায়। বাবার কড়া শাসনের কথা লিখতে গিয়েও, ‘মায়ের ছেলে’ সুমন লিখে রাখছেন বাবার মন্তব্য– ‘the partition was never inevitable’। গুরুদের কথা বলতে গিয়ে গৌরকিশোর ঘোষের সম্বন্ধে অনেকটা লিখলেও হামদি বে-র বেলায় তিনি যেন আরও একটু ব্যক্তিগত। প্রসঙ্গত, কৈশোরে আজকাল কাগজে ‘বে অফ বেঙ্গল’ কিছু কিছু পড়ে থাকলেও হামদি বে-র মতন প্রায়-সর্বজ্ঞ মানুষদের কথা সুমন আমাদের জানালেন বলে তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ রইলাম। হামদির মৃত্যুশয্যায় গৌরবাবু ও সুমনের তাঁকে দেখতে যাবার বর্ণনা নিছক একটি ঘটনা বলে বর্ণিত হল না সুমনের কলমে। এমন শ্রদ্ধা যিনি দেখাতে পারেন, তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।
এই বইয়ের নানান অধ্যায়ে রাজনীতির ভিন্ন মেরুতে থাকা মানুষের কথা অবলীলায় বর্ণনা করেছেন সুমন। সেটা বিষয় নয়, যতটা বিষয় রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতন মানুষের আস্থা আদায় করতে পারা। এর মধ্যে প্রণববাবু ও প্রিয়বাবু, বিশেষ করে দ্বিতীয়জনের সঙ্গে সুমনের সম্পর্ক ছিল প্রায় আত্মীয়ের মতন। তাঁর প্রিয়দার মৃত্যুর পর সুমনের লেখা স্মৃতিচারণ আমরা কাগজের পাতায় পড়েছি। তবে যা লক্ষ্যণীয় তা হল– এঁদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এঁদের দোষত্রুটিকেও আড়াল করেননি তিনি। এই বইতে আমরা দেখছি, রাজীব গান্ধীর গ্রাম-পরিভ্রমণের সময় দোভাষীর ভূমিকায় প্রিয়বাবুর অতিকথনের বর্ণনা। দেখছি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি তাঁর অবিমিশ্র শ্রদ্ধা।
তবে ষাট অতিক্রম করে, এত ঘাটের জল খেয়ে, অর্ধেক জীবন সাংবাদিকতায় কাটিয়ে আজ ‘কোবরাপোস্ট’-কাণ্ড দেখে কী প্রতিক্রিয়া তাঁর, তা জানার আগেই বইটি প্রকাশ পেল। যে পেশা তাঁকে দিয়েছে তাঁর অর্জিত যা-কিছু, সেই পেশারই বহু নব্য ব্যবসায়ীদের দিকে তাকালে ‘চোখের কোণে এই সমূহ পরাভব’, এঁদের নিয়ে কী ভাবনা তাঁর? ফলে আপাতত এই ইচ্ছা অপূর্ণ রইল আমাদের। তবে এতদিনের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় এমন পদস্খলন কোনও সাংবাদিকের মধ্যে তিনি দেখেননি, বা সমস্যা এত গভীর হবার আগে এমন কোনও সর্বনাশের আঁচ তিনি পাননি, এই কথাটা আমরা মানলাম না। আমরা আশা রাখব, সর্বভারতীয় স্তরে Scroll বা Wire যেমন নির্ভীকভাবে সাংবাদিকতার কাজ করছে, আমাদের বাংলাভাষায় তেমন কাজ প্রথমবার সুমনবাবুই করে দেখাবেন।
আপাতত আমরা তাঁর আরও একটি বইয়ের আশায় থাকি।
একটি অত্যন্ত সুলিখিত গ্রন্থ-সমালোচনা, একটি সুখপাঠ্য বইয়ের।
অত্যন্ত মনোজ্ঞ আলোচনা! শেষে লেখক যে প্রশ্নটি রেখেছেন তা যথাযথ। কোবরাপোস্ট-এর মতো ঘটনা গণতন্ত্র ও তার চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের ভেঙে পড়া ঘোষণা করছে কিনা, সুমনবাবুর মতো বিদগ্ধ সাংবাদিকের কাছ থেকে জানার ইচ্ছেটা রয়ে গেল।
বইটার বিক্রি বাড়িয়ে দেবেন দেখছি।