আহমেদ খান হীরক
আমি যে মইরা গেছি তার পহেলা হদিশ দেয় রমজান। কোন জানি এক অপিসের পিয়ন সে। একদিন আতিপাতি আমারে খুঁইজা বাহির কইরা কয়– যাক তুমি তাইলে বাঁইচা গেছ!
মরার কথা শুনলে কেমন স্বস্তি লাগে, কিন্তু বাঁইচা থাকার কথায় ডর আইসা ভর করে। আমার মুখ শুকায়া যায়। বুকের ভিত্রে কেউ না বুইঝা য্যান তিন চাইরটা লাকরি ঠুইসা জ্বালায়া দেয়। রমজান কয়, খবর পাক্কা! পেপারে তুমার ছবিও উঠছে তো! তুমি মইরা গেছ, বুঝলা!
বুঝলা বললেও ঠিক বুইঝা উঠতে পারি না। রমজান খেইপা গিয়া বলে, এমুন ভ্যাবলার লাহান বইসা না থাইকা গতরটা এট্টু টান দাও। খোঁজ খবর নাও। তুমি মইরা গেছ না বাঁইচা আছ এইটা কিলিয়ার হওয়ার দরকার আছে!
আমি কই খোঁজ নিতে যাব বুঝি না। বলি, আর কি! তুই তো পেপারে দেখছোসই! এইতেই তো কিলিয়ার, না? কুন ছবিটা দিছে রে? টিয়া কালারের শার্ট পইরা যেইটা আকবরের ফুনে তুলছিলাম?
‘আর আকবর! সে কি আর বাঁইচা আছে নাকি!’ ফোঁস কইরা একটা শ্বাস ছাড়ে রমজান।
আমারে অবাক হইতে হয়– আকবর মরছে?
‘মরছে না আবার! কালভাটের তলায় বডি পাওন গেছে। মাছে খাইছে হারামির মুখ-গর্দান-বুক। প্যাটের নিকট গুলির তিনটা ফুটা!’
শুনতে বেশি খারাপ লাগে না। তাও অভ্যাসের তোড়ে বইলা বসি, আহারে!
রমজান ফেনায়। বলে, প্যাটের ভিত্রে একটা শোইলে বাসাও বানছিল এ কয়দিনে! শোইলটা বড় আছিল। কেজি খানেকের তো হইবোই।
‘পরে কি পাইছিলি নাকি?’
‘কী?’
‘শোইলটা!’
‘নাহ। পলায় গেল না হারামিটা! পিছলা মাছ। এইগুলার ভিত্রে বাইলাই ভালো। কিন্তু দাম কি দেখছোস, কিনোনই যায় না!’
‘বাজারে উঠে নাকি এখন?’
‘উঠে না আবার! ঢাকার বাজারে কী ওঠে না? এত্ত বড় বড় শোইল। কালো কালো।’
‘আর বাইলা?’
‘বাইলাও উঠে… মেলা দাম!’
‘বাইলা মাছ মাইয়াটা খাইত খুব। গেরামে থাকার টাইমে। হের মা শাক টোকাইত আর আমি মাছ ধরতাম। খালি বাইলা উঠত ওই টাইমে। বাইলা মাছের মতন ভ্যাবদা কুনো মাছ নাই! বড়শিতে মুখ দিয়া চুপ কইরা বইসা থাকে বিকার ছাড়া!’
‘পেপারে তুমার ওই টাইমেরই ছবি দিছে! কেমন চ্যাংড়া ট্যাংরা আছিলা তখন!’
ওই টাইমের কথা মনে হইতে কেমন খা খা লাগে। গেরাম আছিল, শাক আছিল, বাইলা আছিল! মাগার পয়সার মা-বইন ছিল না! রমজান পিচিক কইরা থুক ফালায়া খানিকক্ষণ ঘাসের দিকে তাকায়া থাকে। ঘাসের ডগার সাথে তার থুক লেপ্টায়া পইড়া যাইতে যাইতে যায় না। আমিও সেই দিকে তাকায়া থাকি। রমজান ঘাড় নাড়ায়া বলে, এইবার এট্টু হেলদোল কইরা দেখো! মইরাই তো গেছ!
কিচ্ছু করার ইচ্ছা জাগে না। কিন্তু রাইত হইলে তো দেখি আকাশ নাইমা আসতেছে বুকের উপর! আদারে বাদারে জোনাক পোকা জ্বইলা জ্বইলা হারামিগিরি করে। মাঝে-মইধ্যে বনবিড়াল চোখ ফোটায়া রাখে। বাতাস হইলে কী এক ফুলের ঘেরাণ আসে! শিউলি হইতে পারে, নাও পারে। মাইয়াটা ফুল ফুল কইরা জীবন দেয়। সে কইতে পারত আর কি! এই কয়দিন আগেও রাস্তা থেইকা গোলাপ টোকায়া কানে গুঁইজা আকবরের ফুনে ছবি তুলছে! আমারে জড়ায়া ধইরাও তুলছিল একটা। বেশি ফাইন হয় নাই সেইটা!
কিন্তু সেই টাইমে কি আমি কুনো ছবি তুলছিলাম! গেরামে তখন কারই বা আর ফুন আছিল?
শেষে গঞ্জে গিয়া পেপার খুঁজি, পাই না।
মানুষজন আমারে টিটকারি মারে। পেপার দিয়া আমি কী করতাম সেইটা তারা ভাইবাই পায় না। খুঁজতে খুঁজতে আমিও আর ভাইবা পাই না পেপার দিয়া কী করার আছিল আমার!
সন্ধানে নাকি বাঘের চোখও পাওন যায়! আমি চাইরটা কি পাঁচটা পেপার পাইয়াও যাই কেমনে কেমনে জানি! কিন্তু পেপারে কুনো ছবি নাই। আমার মরার খবরও নাই। রমজানরে আছারিবিছারি গাইলাইতে সাধ হয়। কিন্তু রমজানরে আর পাই কই!
গুঁড়ে পিঁপড়া লাইগা থাকে। সেই পিঁপড়া ঠোঁট ফুলায়া দেয় আমার। হারামি একেকটা! একটু বরফ লাগাইতে পারলে আরাম হইত! কিন্তু আমি যে মইরা গেছি তার তো কোনও গ্যারান্টি নাই! রমজানও আসতে দেরি আর দেরি করে! মুড়ি খাইতে খাইতে ইচ্ছা কইরা কয়েকটা পিঁপড়া খাইয়া নেই! পিঁপড়াগুলা প্যাটে গিয়া কী করবে ভাইবা উঠতে খলবলায়া হাসি আসে ভিত্রে ভিত্রে!
রমজান আসে গজবের খবর নিয়া। মাইয়া আর তার মায়েরে নাকি ধইরা নিয়া গেছে! এইবার কি আর নিস্তার আছে?
রমজানরে বলি, তাইলে এই আগান-বাগান ছাড়তে হইব! হ্যারা কুত্তার আভারত! শুঁইকা শুঁইকা ঠিক আসব এইবার!
রমজান খ্যা খ্যা কইরা হাসে। চুতমারানির মুখে একমুঠা পিঁপড়া ঢুকায়া দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এত পিঁপড়া এই টাইমে কই পাব?
রমজান বলে, তুমার তো ফায়দাই হইছে, না?
মা তুইলা গাইল দিই রমজানরে। রমজান থমকায়া বলে, এই লাইগাই তুমার সাথে কেউ চলে না বাল! তুমি কিছু বুঝো? তুমার পরিবাররে ধইরা নিয়া গেছে তুমার লাশ চিনার জইন্য, এইটা বুঝবার পারছ?
‘আমার লাশ কই পাইল?’
‘আরে কইলাম না মইরা গেছ তুমি? পেপারে ছবি আসছে, নাম আসছে!’
‘বাল আসছে! পেপার দেখি নাই নাকি?’
‘সব পেপারে থাকব ছবি? তুমি মিনিস্টার নাকি যে মরলে সব পেপারে নাম-ছবি আইসা ভইরা যাইব!’
আমি চিন্তা নিয়া বইসা থাকি কিছুক্ষণ।
পরে মনে হয় এইটা নিয়া চিন্তার জরুরত তো নাই!
রমজান বলে, তুমার বউ মাইয়া তুমার লাশ চিনতে পারছে!
আমি ভ্যাবলার মতন বইসা থাকি।
রমজান বলে, তুমি মর্গের ভিত্রে লাওয়ারিশ মইরা ছিলা!
আমি ভ্যাবলার মতন বইসা থাকি।
রমজান বলে, তুমার বউ মাইয়া তুমারে চিনতে পারছে!
আমি ভ্যাবলার মতন বইসা থাকি।
কই থেইকা কে জানে রমজান বাইলা মাছের তরকারি নিয়া আসছে। চাইরটা মাছের মইধ্যে তিনটা হারামিটাই খায়। আমি সুরুয়া আর একটা মাছ মাখায়া ভাত খাই। বাইলা মাছের ওই স্বাদ অবশ্য আর নাই!
রমজান বলে, কাইল বাদ আছর তুমার জানাজা! গোরের ব্যবস্থাও হইছে! তুমি যাইবা নাকি একবার?
আমি বলি, ওরা কয়টা গুলি মারছে?
রমজান কিছু বলে না। হটপট ডোবার পানিতে ধুইয়া নিয়া হাঁটা দেয়। কিছুদূর গিয়া সিগ্রেট ধরায়। হারামিটা বলছিল তার কাছে নাকি সিগ্রেট নাই!
পরের দিন যাইতে যাইতে মেলা রাইত হইয়া যায়। জানাজা মিস হইয়া যায়। গোরে মাটিও দিতে পারি না। রেললাইনের উপ্রে গিয়া দাঁড়াই আন্ধারে। কাঠ-কাগজের বস্তিবাড়িটা চোখের সামনে ল্যাঙচায়া দাঁড়ায়া আছে। টিনের দরজা বন্ধ। ভিত্রে মাইয়াটা নিশ্চয় ঘুমায়া আছে মারে জড়ায়া! আমি গিয়া ডাকলে কি চমকায়া উঠব খুব? বলব, আব্বা তুমি না মইরা গেছ?
অনেকক্ষণ বিলাইয়ের মতন বইসা থাকি দরজার কাছে। ঘোলা আলো পইড়া আছে এখানে-ওখানে। বইসা থাকতে থাকতে মনে হয় বিলাই না আমি আসলে বইসা আছি বাইলা মাছের মতন। বাঁইচা থাকা আর মরার মধ্যিখানে বড়শি গিইল্যা বাইলা যেমন থাকে বেআওয়াজ ঘাইহীন, আমারও তো তেমনই দশা! ঘোলা আলোয় নিজের হাত-পাও বেরঙা লাগে। মরা মাইনষের শরীল এমন হইতে পারে।
ঝমঝম কইরা একটা ট্রেন চইলা যায় কোনদিকে জানি! ট্রেন গেলে ঘরটা কাঁইপা ওঠে খুব। মাইয়াটা পহেলা পহেলা ডরাইত এই আওয়াজে! এখন সইয়া গেছে। সবই আসলে সইয়া যায় আগে-পরে।
আমি উইঠা এইবার দরজায় টোকা দেই আস্তে আস্তে। দিতে চাই না তাও দিই। কিন্তু ভালোমতো টোকা পড়ার আগেই আরেকটা ট্রেন কত্থেইকা কই জানি যাইতে থাকে… যাইতেই থাকে! চারদিকটা ঝমঝমাইতে থাকে। দরজা কাঁপে, ঘর কাঁপে, কাটনের চালা কাঁপতে কাঁপতে উইড়া যাইতে চায়!
ট্রেনটা ঘ্যাচাং ঘ্যাং ঘ্যাচাং ঘ্যাং শব্দ তুলতে তুলতে বলতে থাকে– বাঁইচা আছি! বাঁইচা আছি! বাঁইচা আছি!
কিন্তু আমি এত সাহস নিয়া এই কথা বলতে পারি না। কে জানে, আমি হয়তো আর বাঁইচা নাই!
কে জানে আমরাই হয়ত আর বেঁচে নেই। অসাধারণ লাগলো।
সত্যি… ওই লাইনটার রেশ কাটতে চায় না…