শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা এই স্মৃতিচিত্রটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'আজকাল' পত্রিকায়, সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮ সালে। পরে 'উলুখড়' পত্রিকা তাদের শরৎ ১৪১৯ সংখ্যায় লেখাটির পুনর্মুদ্রণ করেন।
গ্রামদেশে দেখেছি, বাঙালি দুটি ব্যাপারকে বড় পুজো বলে। একটি হল, সারা দেশ জুড়ে বর্ষার মুখে হাল চষে মাটি লদলদে করে, উবু হয়ে তাতে ধান রোয়াকে। আরেকটি হল, কলাবউ স্নান করানো থেকে দশমীর সন্ধ্যায় ভাসান দেওয়া অব্দি কয়েক দিন ধরে দুর্গাপুজোকে।
অমাবস্যা কেটে গিয়ে প্রতিপদ থেকেই দেবীপক্ষের শুরু। শুরুর আগে ভরা অমাবস্যায় পিতৃপক্ষে গঙ্গায় কোমরজলে দাঁড়িয়ে করজোড়ে মন্ত্র পড়ে স্বর্গত মা-বাবা, তাঁদের মা-বাবা, আবার তাঁদেরও মা-বাবাকে স্মরণ করে হাতের কৃষ্ণতিল, তুলসী আর কুশের আংটি গঙ্গায় ফেলে দিয়েছি।
মন্ত্রের মানে বুঝিনি। কারণ সে শিক্ষা পাইনি। যিনি মন্ত্র পড়াচ্ছিলেন, তিনি ঘাটে দাঁড়িয়ে। মাথায় ছাতা। মুখে মন্ত্র। মা-বাবার নাম বলতে পারলাম। ঠাকুরদা, দাদামশায়ের নাম বলতে পারলাম। কিন্তু ঠাকুরমা-দিদিমার নাম বলতে পারিনি, কারণ জানি না। আবার তাঁদেরও মা-বাবা, মানে প্রপিতামহ-প্রপিতামহী– তাঁদের নাম তো কোন বিস্মৃতির অতলে।
হিন্দু ঠিক ধর্ম নয়। বরং বলা ভালো, একটি ধারাবাহিক অমরলতা। বহতা মানবলতা। বড় করে অনেক জায়গা জুড়ে ধান চাষ করতাম এক সময়ে। তখন এক প্রবীণ চাষি ধান সম্পর্কে বলেছিলেন আমাকে– ধান হল গিয়ে অমরলতা!
এই স্মরণ এবং প্রণাম জগৎ ও জীবনের সঙ্গে মানুষের ধারাবাহিকতার যোগ। মাকে মনে করতে গিয়ে, বাবাকে মনে করতে গিয়ে দেখি– ওঁরা কত অল্পে সুখী ছিলেন। নিজেদের জন্য বিশেষ কিছুই চাইতেন না।
আমার এখন যা বয়স, তার চেয়ে কম বয়সে মা চলে যান। মৃত্যুর পরে কোথায় চলে গিয়েছেন! আর কোনও দিন দেখা হবে না।
বাবার ছবি টাঙিয়ে রেখেছি। সে ছবি কিছু ফিকে হয়ে এসেছে। তাতে চন্দনকাঠির সুগন্ধি চোকলা দিয়ে গাঁথা মালা। মাঝে মাঝে গুঁড়ো সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে ফের সেই মালা ফটোতে দেওয়া হয়।
মনে মনে প্রণাম করতে গিয়ে বাবার পা, মায়ের পা মনে করার চেষ্টা করি। শাড়ির লাল পাড়ের নীচে মায়ের ভারি, ঘিয়ে রঙের পা। আমাদের বালক বয়সে তিনি আলতা পরতেন। পুকুর থেকে চান করে ফিরলে বারান্দায় তাঁর পায়ের জলছাপ পড়ত। ঘরে ঢুকে সেই জলছবি কোথায় মিলিয়ে যেত।
বাবার পা ছিল পাতলা। পাম্পশু পরতেন। শীতকালে পা থেকে মাথা অব্দি সরষের তেল মাখতেন। রোজ হেঁটে কোর্টে যেতেন। হেঁটেই ফিরতেন।
ওঁদের বিয়ের পর প্রথম-জীবনে কেনা একটি টেবিল আজও আমার ছোট ভাইয়ের বাড়িতে আছে। কালো রঙের। এই টেবিলটা নিয়ে বাবা শীতকালে মিস্ত্রি নিয়ে পড়তেন। ফি-বছরই টেবিলটার পায়া-চারটি লগবগে হয়ে পড়ত। বাবা আর মিস্ত্রি মিলে টেবিলটাকে চিত করে তার পাঁজরে ছোট ছোট কাঠের তাপ্পি মারতেন। পেরেক দিয়ে। আর লগবগে পায়ার গায়ে কাঠের ঠেকো লাগানো হত। কাজটা হয়ে গেলে টেবিলটা আবার উপুড় করা হত। তার ওপর চেপে বসে বাবা দুলে দেখতেন, টেবিলটা আর লগবগ করে কি না। না-করলে সে কী তৃপ্তি! সেই টেবিলের ওপর মা সারা মাসের চাল-ডাল, সরষে-হলুদ, গুড়-চিনি-নুন-লঙ্কা রাখতেন। এখন দেখছি, টেবিলটার ওপর রয়েছে কালার টিভি-র বিশাল বাক্স। পিসবোর্ডের খোল। টিভি বস্তুটি মা-বাবা দেখেননি। রেডিও শুনে গেছেন। বাবা কোনও দিন সিনেমা দেখেননি। কিন্তু দেশভাগের পর ঢাকা থেকে যে সব সিনেমার কাগজ বেরোত, তার দু-একখানি আমি বাড়িতে কিনে এনেছি। যে-বাবা জীবনে কোনও দিন সিনেমা দেখেননি, তাঁকে দেখেছি, ওপারের সিনেমার কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছেন।
অবাক হয়ে জানতে চেয়েছি, কী পড়ছেন, বাবা?
বাবা বলেছিলেন, সিনেমা তো এক মস্ত ফাঁকি। আমি পড়ছি জায়গাগুলোর নাম।
–মানে?
–ঢাকা, পটুয়াখালি, খুলনা– এই সব জায়গার নাম আছে। চেনা জায়গা তো– তা-ই পড়তে গিয়ে আনন্দ হচ্ছে।
–আর কিছু নয়, বাবা?
বাবা হেসে ফেলেছিলেন। বুঝিস না কেন, আমার জন্ম যে পটুয়াখালিতে। খুলনার দৌলতপুর কলেজে পড়েছি এফ এ। তারপর বি এ করি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ছাপার হরফে জায়গাগুলোর নাম পড়লে স-ব মনে পড়ে যায়।
হয়তো ওইভাবেই ছিল বাবার তর্পণ।
মা সিনেমায় যেতেন বড়দার সঙ্গে। বড়দা তখন কলেজে পড়েন। মফস্বল শহরে। বড়দা মায়ের প্রথম সন্তান। মায়ের ১২-১৩ বছর বয়সে বড়দা হন। আজ থেকে ৮০-৮১ বছর আগে অমনই হত। আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বড়দা মাকে নিয়ে সন্ধের শো-এ হেঁটে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন। দেখে মনে হয়েছিল, তার দিদিকে নিয়ে কোনও ভাই সিনেমা যাচ্ছে। এইভাবেই মাকে মনে পড়ে। এইভাবেই বড়দাকে মনে পড়ে। তিনিও আর নেই। এই মহাজগতের কোথায় চলে গেছেন!
মাকে নিয়ে আমি কলকাতায় সিনেমা দেখতে গিয়েছি। উত্তেজনার দৃশ্যে মা উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। একটা ছবি দেখেছিলাম– তাতে প্রভাদেবী মা। তাঁর ছেলে, জহর রায়। প্রভাদেবী কার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। তা-ই পুলিশ এসেছে তদন্ত করতে, তখন জহর বলছেন, আমার মা সব পারে। এই দৃশ্যে মা আর বসে থাকতে পারলেন না। ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হলের অন্ধকারের ভেতর দিয়ে মাকে নিয়ে এলাম। বাড়ি এসে ডাক্তার ডাকতে হল। তিনি মেপে বললেন, ব্লাডপ্রেশার বেড়ে গেছে। এখন মনে হয়, মা কত ছেলেমানুষ ছিলেন। কল্পনাপ্রবণ ছিলেন। বাবার চোখে সিনেমা ছিল এক মস্ত ফাঁকি। ইলিউশন। মায়া।
তর্পণ করতে গিয়ে মায়ের এই সব কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আরেকটি ছবি। দেশভাগের বেশ আগে আমাদের বালক বয়সে দেখেছি, প্রায় বাড়িতেই জেল-খাটা যুবক থাকতেন। তাঁরা এই জেলে যাচ্ছেন, আবার বেরিয়েও আসতেন। তাঁদের অনেকেই পরে আর বিয়ে করেননি। চাকরিও পাননি কোনও দিন। ওঁরা কেউ কেউ ভালো গান গাইতেন। সাঁতার কাটতেন। রোগীর মাথার পাশে বসে থাকতেন সারা রাত। এঁদেরই একজন মাকে বিকেলবেলা গান শোনাতেন। বাংলা ছায়াছবির গান। ডায়ালগ-সমেত।
মনে আছে, আমাদের বাড়ির উঠোনে টগরফুল ফুটে আছে। জ্যোৎস্না উঠেছে। তিনি মুক্তি ছায়াছবির গান গাইছেন। ডায়ালগ বলছেন। মা শুনছেন। কখনও আনন্দে মায়ের মুখ হেসে উঠছে। কখনও দুঃখে জল এসে যাচ্ছে চোখে।
এই ছবিটিকে আমি মাঝে মাঝে মনে করি। তর্পণ করি।
আমাদের সামনেও ছবি দাঁড়ালো, সহজ সরল বাবা-মায়ের মুখ আর বাংলা ভাগের বেদনা। অনুষঙ্গে বেঁড়ে ওঠা সময়কার নানা উপকরণ। আজ সেইসব দিন সতত সুখের, মনে পড়া মুখ বেদনার। আপন সংস্কৃতির বাংলাও আজ স্মৃতি। দাগ কাটলো লেখা। আগে পড়িনি