দেবর্ষি চক্রবর্তী
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ক’দিন ধরে চলা আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের শেষে ফের ২০১৪-১৫ সালের হোক কলরব আন্দোলনের মতই কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারের পিছুহটা সারা রাজ্যের এমনকি রাজ্যের বাইরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নজর কেড়েছে। অনেকের কাছেই আন্দোলনের বিষয়টি প্রতিভাত হয়েছে কেবলমাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে রাজ্য সরকার এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের মতান্তর হিসেবে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই আন্দোলন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ’টি বিভাগে এই বছর প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে কিনা সেই প্রশ্নের থেকেও অনেক গভীরে নিহিত ছিল। এই আন্দোলন ছিল স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলন, স্বতন্ত্রতা রক্ষার আন্দোলন এবং একই সঙ্গে গোটা রাজ্য জুড়ে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে শিক্ষার যে মাফিয়াকরণ ঘটে চলেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও একটি বিভাগে ছাত্র ভর্তির জন্য প্রবেশিকা হবে কি হবে না তাই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী কে? রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী? তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদ্য অপসারিত রাজ্য সভানেত্রী? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য? নাকি সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপক এবং অধ্যাপিকারা? যাদবপুরের জুলাই বিদ্রোহের মূলে আছে এই প্রশ্ন। প্রশ্নটা কেবলমাত্র পরীক্ষা নেওয়া বা না নেওয়ার মধ্যে সীমিত নয়। বরং পরীক্ষা হবে কি হবে না তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কার সেইটেই আসল প্রশ্ন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষাকে আমাদের রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পছন্দ করেন না। তার কারণ তিনি নিজে কখনও মুখ ফুটে না বললেও আমরা বুঝি যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দল শত চেষ্টা করেও ছাত্রদের মধ্যে কোনও সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করতে পারছে না গত সাত বছর ধরে এবং তার থেকেও বড় বিষয় অন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেরকম ছাত্র ভর্তির সময়ে তার দলের ছাত্র সংগঠন কিছু আয় করতে পারে, সেটা প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকার ফলে হচ্ছে না। তাই ২০১৭ সালেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে এসে তিনি জানিয়েছিলেন যে যাদবপুরের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়। অতএব, ওটি রদ করতে হবে। এখন দুর্নীতির সর্বজনগ্রাহ্য যে সংজ্ঞা তাতে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এটাই মনে করেন যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তিকে কেন্দ্র করে গোটা রাজ্য জুড়ে যে অরাজকতার পরিবেশ গত কয়েক বছরে সৃষ্টি হয়েছে সেখানে যাদবপুর একটি ব্যতিক্রম। যাদবপুর সহ গুটিকয়েক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এই রাজ্যে বেঁচে রয়েছে যেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, অন্তত টাকা দিয়ে সিট কেনা যায় না।
কিন্তু আমাদের রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মনে করেছেন যে এই ব্যতিক্রম থাকার কোনও প্রয়োজন নেই যাদবপুরের। যেভাবে অন্য সব যায়গায় ছাত্রছাত্রীদের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কাছ থেকে আসন কিনে ভর্তি হতে হয়, এখানেও সেই ব্যবস্থা লাগু করা প্রয়োজন, অতএব তার অঙ্গুলিহেলনেই শুরু হল অচলাবস্থা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জুন মাসের ন’তারিখে স্বাভাবিকভাবেই প্রবেশিকা পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হল, তারপরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ তৎপর হল, এটা প্রমাণ করতে যে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে টালবাহানা শুরু হল। ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয়ে কর্মসমিতির সভার বাইরে অবস্থানে বসলেন, প্রায় তিনদিন অবস্থান চলার পর কর্মসমিতি সিদ্ধান্ত নিলেন যে প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে। কিন্তু কায়েমিস্বার্থের চক্র এত সহজে পরাজিত হতে রাজি হল না। তারা ফের অচলাবস্থা তৈরি করল প্রবেশিকা কমিটিতে। বিতর্ক শুরু হল প্রবেশিকা পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে, শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা নিয়ে। কিছু মানুষ চেষ্টা করলেন যাতে বাইরের কোনও সংস্থাকে দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পরিচালনা করা যায়। সব মিলিয়ে যখন অচলাবস্থা তুঙ্গে তখন আবার কর্মসমিতির বৈঠক বসল চার জুলাই এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হল এবারের মতো প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ঘটনাক্রমের সঙ্গে যুক্ত করুন বারবার করে সরকার এবং তার মন্ত্রীর নানা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া যে তারা যাদবপুরে প্রবেশিকা চাইছেন না। কবর থেকে খুঁড়ে বের করে আনা হল একাশি সালের আইনের একটি ধারা, অথচ সেই আইনেরই অন্য একটি ধারাকে অগ্রাহ্য করে মাত্র সাতদিনের মধ্যে বদলে দেওয়া হল আগের কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত, যেখানে আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে চারমাসের আগে কোনও অবস্থাতেই কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত বদল করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা তৈরির পাশাপাশি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেল আঠারো হাজার ছাত্রছাত্রীর জীবন। তাঁরা রোজ নতুন নতুন পরীক্ষার সূচি জানতে পারছেন, কোনওদিন শুনছেন পরীক্ষা হবে, কোনওদিন শুনছেন হবে না। এই অবস্থায় কর্মসমিতি এবং উপাচার্যের উপরে চাপ তৈরি করতে ছাত্রছাত্রীদের সামনে অনশন ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না। তাই সেই ডেভিড গোলিয়াথের যুদ্ধের মতো এক অসম যুদ্ধে, যেখানে একদিকে কর্মসমিতি, উপাচার্য, সরকার সবাই, তার বিরুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে, শিক্ষাক্ষেত্রকে দুর্নীতির করাল ছায়া থেকে মুক্ত করার জন্য ছাত্রছাত্রীরা অনশনে বসল।
পরবর্তী ঘটনাবলি সকলেরই জানা। কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা ফিরে এল, এর তুলনা সাম্প্রতিক আন্দোলনের ইতিহাসে মেলা ভার। এই লড়াই কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বিবেচনার ভার ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দিলেও এই কথাটা স্বচ্ছন্দে বলা চলে যে এই আন্দোলন গোটা রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধে একটি বিশাল বড় প্রত্যাঘাত। সারারাজ্যে আজকে শিক্ষাক্ষেত্র চালাচ্ছে একটি মাফিয়া গ্যাং, যারা নিজেদের একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচয় দেয়। পরিস্থিতি এতটাই লজ্জাজনক যে খবরের কাগজে কোন কলেজে কত টাকায় আসন পাওয়া যায় তার তালিকা বেরিয়ে পড়ছে, মুখ্যমন্ত্রীকে ছুটতে হচ্ছে কলেজে কলেজে, পুলিশকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হচ্ছে যে কেউ আসন বিক্রি করলে যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শিক্ষা দফতর থেকে নয়, স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে চলছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। আর তার সঙ্গে দলীয় স্বার্থ কায়েম রাখার জন্য প্রত্যেক দিন নিত্যনতুন আইন এনে খর্ব করা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার, উপাচার্যকে পরিণত করা হচ্ছে দলদাসে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই অব্যবস্থার রাজ্যে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাই রাজ্য সরকার সচেষ্ট হয়েছে তাকে ধ্বংস করতে। কিছুতেই রাজ্য সরকারের মৌরসিপাট্টা স্থাপন করা যাচ্ছে না সেখানে তাই প্রত্যেকদিন নিয়ম করে শিক্ষামন্ত্রী মুণ্ডপাত করেন রাজ্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আইন এনে সেখানে ছাত্রছাত্রদের ইউনিয়ন তৈরির অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারপরেও যখন ছাত্র আন্দোলনকে শেষ করা যাচ্ছে না তখন তাঁরা প্রবেশিকা প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেখানকার শাসকদল ঠিক যেভাবে দিল্লির অন্যতম প্রতিবাদ, প্রতিরোধের কেন্দ্র জেএনইউকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়েছে, ঠিক সেই পথেই হাঁটছে রাজ্য সরকার, মাত্রাগত তফাৎ ছাড়া অন্য পার্থক্য নেই দু’য়ের মধ্যে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই আক্রমণের উলটোদিকে যে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের চিত্র হাজির করেছে সেটি এককথায় অভূতপূর্ব। হোক কলরব আন্দোলনের পর থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আর কেবলমাত্র ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রও। পণপ্রথা, বধূহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপাচ্ছে কে? যাদবপুর। বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কে? যাদবপুর। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে কারা? যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা। বর্বরের দল লেনিন মূর্তি ভাঙতে আসলে মূর্তি আগলাচ্ছে কে? যাদবপুর। যাদবপুর তাই ছাত্র আন্দোলনের সীমা ছাড়িয়ে, ক্যাম্পাসের চার গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে প্রায় ডি-ফ্যাক্টো বিরোধী শক্তিতে আজ পরিণত হয়েছে যারা সমানতালে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো লড়ে চলেছে। এই যাদবপুরকে ধ্বংস করা তাই শাসকের অবশ্য কর্তব্য। তাই আইন এনে স্ট্যাটুট বাতিল করে স্বাধিকার কেড়ে নেওয়া। তারপরে ইউনিয়ন তুলে দেওয়া। তারপরেও দমাতে না পেরে প্রবেশিকা বানচাল করার চেষ্টা করা।
তাই এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেরকম প্রবেশিকা পরীক্ষা ফিরে এল, তেমনি এই বার্তা সরকারের কাছে গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের প্রশ্নে লড়াই এখনও চলছে। সমাজের কাছে এই বার্তা গেল যে, ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ হলে উল্টোদিকে যেই থাকুক না কেন, তাকে রুখে দেওয়া সম্ভব। তাই আগামীদিনে শুধু মুখের কথায় নয়, প্রতিটি কলেজে কলেজে গড়ে তুলতে হবে দুর্নীতি প্রতিরোধী মঞ্চ। গড়ে তুলতে হবে শিক্ষারক্ষার্থে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য।
বস্তুবাদী ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সমাপতনে বিশ্বাসী না হয়েও বলা চলে, ১৯৬৮’র সরবোর্ন, বার্কলের সঙ্গে কোথাও যেন মিশে যাচ্ছে ২০১৮’র যাদবপুর। ছাত্র আন্দোলন সমাজের বিবেকের কাজ করে। ভুল হলেও করে, ঠিক হলেও করে। সফল হলেও করে, অসফল হলেও করে। ১৮’র যাদবপুর ৬৮’র সরবোর্নের মতোই শিক্ষা দিয়ে গেল শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বললে, ছাত্রশক্তির উপর আন্দোলন দাঁড়িয়ে থাকলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।