যশোধরা রায়চৌধুরী
আঠেরো বছরের ছেলেমেয়েদের ওয়াটস্যাপ থেকে ওয়াটস্যাপে ঘুরছে উপরোক্ত এই বচন। যা আমি ব্যবহার করলাম শীর্ষে। সত্যজিত রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটি যেন আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে আসছে। উদয়ন পণ্ডিতের সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা ছেলেমেয়েদের মধ্যে এখন খুব জনপ্রিয়। কী ঘটল কেন ঘটল পশ্চিমবঙ্গে, যা এই পরিস্থিতি এনে দিল?
সম্পূর্ণ অনধিকারীর কটা কথা নিবেদন করছি নিজগুণে ক্ষমা করবেন হুজুর মাইবাপ। আমি না যাদবপুরের ছাত্রী, না শিক্ষাজগতের কেউ। তবু কেন আমি বিচলিত? কেনই বা, বাম বা ডান কোনও রাজনৈতিক হেলে থাকার বাইরেও আমি বা অধিকাংশ সামান্য হলেও চেতনা-চিন্তা সম্পন্ন মানুষ বিচলিত? বিচলিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নীতিতে, পার্টি-অন্তপ্রাণ একঝাঁক বুদ্ধিজীবীর আচরণে?
শুরুর প্রশ্নটা কলা বিভাগের ছটি বিভাগের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে। দিন ঘোষণা হয়ে গেছিল। টাকা জমা হয়ে গিয়েছিল ১৭০০০ ছাত্রের। সব কিছুর পরও প্রশ্ন উঠল, কলাবিভাগে প্রবেশিকার প্রয়োজন নিয়ে। এবং উত্থাপন করা হল, কেবল উচ্চমাধ্যমিকের নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির দাবি, কেননা পরীক্ষাপ্রক্রিয়া নাকি স্বচ্ছ নয়। অথচ কোনও স্পষ্ট কারণ দর্শানো হল না। কলাবিভাগের প্রবেশিকায় যাদবপুর বহুদিনই অন্যরকমভাবে ছেলেমেয়েদের মেধা বিচার বিবেচনা যাচাই করে আসছিল। সেটা ভুল কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল না। আর সেখানেই হীরক রাজ্যের আবছা ছায়া দোদুল্যমান যেন।
কয়েকটা বিষয় মিলেমিশে যাবার আগে আলাদা করে বলি, যা আমার মাথায় ঘুরছে কদিন ধরেই… নানা জায়গায় নানা কিছু পড়ে যা আলোচনায় উঠে আসছে বার বার।
এক, গায়ত্রী স্পিভাক একবার বলেছিলেন, হিউম্যানিটিজ টিচারস আর দ্য ইনস্ট্রাকটরস অফ দ্য জিম অফ দ্য মাইন্ড। শরীরের জন্য যেমন জিম, মনের ব্যায়ামের জন্য কলা-অধ্যয়ন। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজতত্ত্ব, এই বিষয়গুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার বিবর্তনের সূত্র। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি যেমন প্রয়োজন সমাজের তেমনই প্রয়োজন লিবারাল আর্টসের চর্চা, সাহিত্য অথবা ইতিহাস-সমাজতত্ত্বের চর্চা। সমাজের সুস্থতার জন্যই। আর, বলাই বাহুল্য, এই চর্চাই প্রশ্ন করতে শেখায়। শেখায় উত্তর খুঁজতে। নির্দ্বিধায় সব কিছু মেনে না নিতে। একুশে আইনের দিকে আঙুল তোলে। ব্যঙ্গ করে, শ্লেষ করে। ভেতরে তাকাতে সাহায্য করে যাকে রাজকীয় ভাষায় বলে ইনট্রোস্পেকট করা। শেখায় অন্যভাবে পৃথিবীটাকে দেখতে। তাই কি ক্রমবর্ধমান একাধিপত্য আর কণ্ঠরোধী সমাজে ব্রাত্য এই প্রশ্ন করতে শেখানো অধ্যয়ন রীতি আর প্রশ্ন তোলা ছাত্রকুল?
ইকনমিক টাইমসে (১০ জুলাই) প্রকাশিত রিমি বি চ্যাটার্জির লেখা ‘লেস হিউম্যান দ্যান হিউম্যান’-এ রিমি বলেছেন, সারা পৃথিবীতেই কলা বা আর্টস বিষয়গুলোকে উপেক্ষার প্রবণতা লক্ষণীয়। সর্বত্র, সরকারি অনুদান কমে আসছে হিউম্যানিটিজ বা কলাবিভাগের অধ্যয়ন অধ্যাপনার ক্ষেত্রগুলোতে। সংকীর্ণ হয়ে আসছে পরিসর। কলাবিভাগের শিক্ষকদের সে দিন গিয়াছে। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান তাঁরা পান না। ছেলেমেয়েদের মগজকে তথ্যের ডেটাবেস বা কারখানা বানাবার পরিবর্তে সৃজনশীল চিন্তাভাবনার আলো হাওয়া বওয়ানোর কঠিন যে চ্যালেঞ্জ তাঁরা নিয়েছেন, হিউম্যানিটিজ শিক্ষকরা পান না তার যথার্থ কোনও মূল্যায়ন। এমনিতেই তো, আর্টসের ছাত্রছাত্রীদের বহুদিন ধরেই ‘অকেজো’ বা দ্বিতীয় সারির ছাত্র বলে চিহ্নিতকরণ যেমন করছে আমাদের সমাজ। টাকা রোজগারের ক্ষমতা গজায় এমন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিক্ষা ছাড়া সব অন্য ধারার লেখাপড়াকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে।… তার পাশাপাশিই যেন এই ফান্ডিং কমিয়ে দেওয়া বা হিউম্যানিটিজ শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞাও জুড়ে আছে।
দুই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষাপদ্ধতির তথাকথিত অবজেক্টিভ সারল্যের খোঁজ। সারা পৃথিবীর মতোই আমাদের ভারতেও, প্রযুক্তি বা অন্যন্য রোট লার্নিং-এর সঙ্গে যুক্ত জ্ঞানের পরীক্ষাপদ্ধতি তৈরি হচ্ছে এম সি কিউ ভিত্তিক এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন বা যন্ত্রের সাহায্যে খাতা দেখার সুবিধে মাথায় রেখে। একই পদ্ধতি মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে নেবার ফলেই তৈরি হচ্ছে ৯৯৯ পাওয়া এক এক স্টার ছাত্র। জ্ঞানকে আত্মস্থ করা বা বিশ্লেষণ করতে শেখার বদলে মান্যতা পাচ্ছে হু হু করে তথ্য জমা করে খাতায় উগরে দেওয়ার প্রবণতা।
উল্টোদিকে কলা বা হিউম্যানিটিজের যা প্রয়োজন, অন্তত এই আলোচনার পরিসরে গত কুড়ি বছর ধরে যাদবপুর যে ধারণার বশবর্তী হয়ে নিয়েছে প্রবেশিকা পরীক্ষা, তা কিন্তু ছাত্রের মনে রাখার ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল নয়, মনের মধ্যে চিন্তাভাবনার ক্ষমতাটার ব্যবহার, বিশ্লেষণী দক্ষতা, মৌলিক ভাবনার ওপর দাঁড়ানো এক পরীক্ষা ব্যবস্থা। তাই দর্শনের পরীক্ষায় নীতি-অনৈতিকের সাবজেক্টিভ উত্তর দিতে বলা হত, যদি পরিবারের দুই বোনের একজন অসুস্থ হয় অন্যজন অবহেলিত হয় তাহলে সে পরিস্থিতি যাচাই করে তার নৈতিকতা অনৈতিকতা ভাবতে বলা হত। তাই ইংরেজির পরীক্ষায় টিভি সিরিয়াল, সিনেমা বা বাংলা সাহিত্য নিয়েও উত্তর দিতে বলা হত। একে “সাবজেক্টিভ সুতরাং নির্ভরযোগ্য নয়” বলে বাতিল করা মানে, কলাভিত্তিক বিষয়ের সঙ্গে বুদ্ধি বিবেচনা চিন্তা কল্পনা ইত্যাদির যোগটাকে অস্বীকার করে তাকে অন্য যে কোনও বিজ্ঞান প্রযুক্তির মতো বিষয়ের সঙ্গে তুল্যমূল্য ভাবা। বা মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের স্তর অব্দি যে “কার্যকরী শিক্ষা”র ব্যবহারভিত্তিক কাঠামো আছে তার সঙ্গে সমান ভাবা।
তিন। এই সব প্রবণতাগুলো খারাপ, এবং বহুধা বিস্তৃত। কিন্তু এসবের পাশাপাশি যাদবপুরে আরও একটা কী বিপজ্জনক প্রবণতা আমরা পাচ্ছি? যা একেবারেই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে প্রোথিত? বর্তমান সরকারের এই ধারণাটা, যে যাদবপুর অতিরিক্ত অটোনমি বা স্বায়ত্ত পেয়ে এসেছে এ যাবত। এবার তার ডানা একটু ছেঁটে দেওয়া হোক। সেটা হবে কী উপায়ে? একজিকিউটিভ কাউন্সিল বা কর্মসমিতির ভেতরে যাঁদের নিজেদের লোক হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের দিয়ে উপরোক্ত প্রবেশিকা পরীক্ষা পদ্ধতি, যেটা কুড়ি বছর ধরে পালিত হয়ে এসেছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হোক।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিলেন এই অ্যাজেন্ডা নিয়ে যে শিক্ষাক্ষেত্রে “নিজেদের লোক” বসানো ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনের বিরুদ্ধে একটা সুরাহা করা হবে। তাঁরা এসে থেকেই যা যা করে চলেছেন তাতে কী বোঝা গেল? আইন কানুন স্ট্যাটুট ইত্যাদি পালটে তাঁরা আরও বেশি বেশি করে “নির্বাচিত প্রতিনিধির” বদলে “মনোনীত প্রতিনিধি” বসাতে চাইছেন, অর্থাৎ আরও বেশি করে নিজেদের লোক বসাতে চাইছেন। নানা আইন পালটে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বায়ত্ত কমাচ্ছেন সরকার। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটেছে। ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষক সমিতির অথবা ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিস্টেমেটিকালি এই কাজগুলো করার ফলে যেটা দাঁড়াল সেটা হল পদে পদে এই ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। আজ প্রবেশিকা নিয়ে হয়েছে, কাল অন্য কিছু নিয়ে হবে।
চার। আজ যেটা শেষ খবর তা হল প্রবেশিকা ফিরে এসেছে। এর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য ছাত্রদের। এবং প্রতিবাদী শিক্ষকদেরও। ব্যাপার এই দাঁড়ায়, যে, প্রবেশিকা তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্ররা অনশন শুরু করে জুলাইয়ের প্রথমদিক থেকেই…, ৪ জুলাই যেদিন শিডিউল্ড প্রবেশিকা ছিল, সেই দিনটির আশপাশ থেকেই তীব্র হতে থাকে আন্দোলন। প্রবল আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়ে এক দল শিক্ষকও সরে দাঁড়ান। জুটাবা, যাদবপুরের শিক্ষকদের যে ইউনিয়নটি তথাকথিত বামপন্থী সেটি তো বটেই, একের পর এক কলাবিভাগের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকরা প্রত্যেকে প্রবেশিকা তুলে দেবার পর ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেরা যুক্ত থাকতে অস্বীকার করেন।
বিপুল চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, যদিও তিনি পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন। তথাপি, আচার্য অর্থাৎ রাজ্যপালের দ্বারস্থ হবার পর রাজ্যপালের উত্তর ছিল এটাই যে কর্মসমিতি যাই বলুক, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা উপাচার্যের অবশ্যই আছে।
অমসৃণ হয়ে উঠছে ক্রমশ গোটা শিক্ষাব্যবস্থার পথ ও পদ্ধতি। ক্রমশই তীক্ষ্ণ ও তীব্র হচ্ছে সরকার পক্ষের আস্ফালন। দুঃখের বিষয় ব্যক্তিরোষ, আক্রমণে সিদ্ধহস্ত এনারা। সেদিন অনুব্রতবাবু শঙ্খবাবুকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন, আমরা “লোকে তো কত কিছুই বলে” বলে তা দেখতে অস্বীকার করেছিলাম। আজ অন্য এক মণ্ডল-স্যার যাদবপুরের শ্রেষ্ঠতা অথবা উৎকর্ষের প্রশ্নে ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি এবং চৌধুরী ডিনাস্টিকে “এরা বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রকে একচেটিয়া অধিকারে রেখেছেন” বলে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়ে এটাই বোঝাচ্ছেন যে তাঁরা ব্যক্তি আক্রমণের পথেই হাঁটবেন। যুক্তি নেই, যুক্তি লাগে না যেন। এই প্রবণতা ভয়ানক। হয়ত রোগলক্ষণ। হয়ত শান্ত মাথায় তর্কে থাকাই একমাত্র অস্ত্র এখন।
স্পষ্ট, লিখিত কোনও আপত্তি, কোনও অভিযোগ নেই যাদবপুরের এই কুড়ি বছর ধরে পরীক্ষিত প্রবেশিকা পদ্ধতির বিরুদ্ধে। কেউ কখনও বলেনি এই পদ্ধতি অস্বচ্ছ বা এতে ছাত্রের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। তবু, অস্বচ্ছতার হালকা অভিযোগ এনে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় দিন ঘোষণার পরেও ১৭০০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে যে বিভ্রান্তি বা নৈরাশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তার দায় কে নেবে? এ তো সম্পূর্ণ অরাজকতা!
এত কিছুর পরেও, এইবারের মতো ছাত্রদের অকুণ্ঠ অভিনন্দন থাকল এই ক্ষেত্রে অন্তত জয় হাসিল করে প্রবেশিকা পরীক্ষাকে আগের মতোই বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তবে এই লড়াই শুধু আজকেই শেষ হবে না। স্বায়ত্ত ও স্বাধীনতা, বিদ্যার ক্ষেত্রকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা এগুলো খুব খুব জরুরি প্রশ্ন এবং বিতর্ক, লড়াই চলতেই থাকবে।
যথাযথ লেখা! ধোঁয়াশা সরিয়ে মুল প্রশ্নের দিকে চোখ ফেরানো গেল।
সুন্দর লেখা। স্পষ্ট, সরাসরি, ভণিতাহীন। খুব ভালো লাগলো।