শঙ্কর সান্যাল
কৌশলটা বদলে গিয়েছে। বড় দাঙ্গার বদলে ছোট ছোট ঘটনা ঘটিয়ে স্রেফ পিটিয়ে খুন করে দাও একজন কিংবা দু’জনকে। ফলত একদিকে যেমন বড় দাঙ্গার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, অন্যদিকে তেমনই বিজেপির জন্য ভোটের মেরুকরণ এবং সংঘ পরিবারের সংখ্যালঘু বিরোধী অ্যাজেন্ডা— দু’টোই সমানভাবে চরিতার্থ হচ্ছে। যদি ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যা বা ২০১৩ সালের মুজফফরনগর দাঙ্গার মতো কোনও বড় ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের ওপরে চাপ বাড়বে, জাতীয় ক্ষেত্রে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুজরাত গণহত্যার মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি স্মরণে আছে গৈরিক শিবিরের। ওই ঘটনার পরে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাদের দেশে ঢুকতে দিতেই রাজি হয়নি বৃটেনসহ একাধিক ইওরোপীয় দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং বিস্তর পরিকল্পনার পরেই এই কৌশল। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্মগ্রহণই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা নিয়ে ভোটের জন্য জন্মলগ্ন থেকেই মেরুকরণের পথে হেঁটেছিল সংঘের রাজনৈতিক শাখা জনসংঘ। ১৯৮০ সালে জনসংঘ ভেঙে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠনের পর থেকে তারাও একই পথের পথিক।
বস্তুত ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে একটিও বড় দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত কেবলমাত্র গরু সংক্রান্ত ঘটনায় গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে। গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ হলেন মুসলিম। বাকি ১৬ শতাংশ দলিত ও অন্যান্য জনজাতির মানুষ।
গণপিটুনির রাজনীতি
প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে। সোশ্যাল মিডিয়ার মঞ্চকে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গুজব। সেই গুজব ডালপালা মেলে দ্রুত এমন চেহারা নিচ্ছে যে মানুষ পথে নেমে আসছে। তারপরে শিকারকে ঘিরে চলে চূড়ান্ত নির্মম পিটুনি। উত্তরপ্রদেশের হাপুরে কাশেমকে তাঁর প্রেমিকার সামনেই পিটিয়ে মেরে ফেলে উন্মত্ত গোরক্ষক বাহিনী। মৃত্যুর আগে কাশেম জল খেতে চেয়েছিলেন। বদলে তাঁর মুখে মুত্রত্যাগ করে দেয় গৈরিক বাহিনী। গোটা ঘটনাই ঘটেছিল পুলিশের সামনে। এমনকি গোরক্ষকরাই কাশেমের মৃতদেহ হিঁচড়ে এনে পুলিশ ভ্যানে তুলে দিয়েছিল।
গুজব কেবল যে গরু সংক্রান্ত তা নয়। ছেলেধরার গুজব হতে পারে, পানীয় জলে কিংবা দুধে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার গুজব হতে পারে। মসজিদে অস্ত্র মজুত করা হচ্ছে— এমন গুজবও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। গুজবের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় ফোটোশপে তৈরি জাল ছবিও। যাতে গুজবের একটা প্রামাণ্য দিক নির্দেশ করা যায়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনতা বাড়ি ছেড়ে নেমে আসবে পথে। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা পুঁজি করে। সংখ্যাগুরু হিন্দু জনতার মানসে ঘৃণা জন্মানোর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটটি কিন্তু লাগাতার প্রচারে নির্মাণ করে দিচ্ছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। যেমন রাজস্থানের আলোয়ারে দুধ ব্যবসায়ী পহেলু খানকে পিটিয়ে যে গোরক্ষকরা খুন করেছিল, তাদের ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে তুলনা করে ভাষণ দেন বিজেপি নেতা বিপিন যাদব। পহেলুকে খুনে যিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন, তিনি আরএসএস নেত্রী কমলদিদি। ঝাড়খণ্ডের আলিমুদ্দিন আনসারির খুনিদের মালা পরিয়ে নিজের বাড়িতে সংবর্ধনা জানান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিনহা। শাসকদল এবং সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি ঘৃণার প্রবাহ নামিয়ে আনেন, স্বাভাবিক কারণেই তাতে আমজনতা প্রভাবিত হবে। গুজবে কান দিয়ে যাঁরা পথে নেমে আসছেন, তাঁরা হয়তো সবাই গণপিটুনিতে অংশ নিচ্ছেন না, কিন্তু সমর্থন জানাচ্ছেন অকাতরে। আসলে সংঘীদের মূল উদ্দেশ্য হল একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সাময়িক গণ হিস্টিরিয়ার জন্ম দেওয়া। এর ফলে একদিকে যেমন সংখ্যালঘু, দলিত কিংবা জনজাতির মানুষ পরিব্যাপ্ত আতঙ্কের দিন কাটাবেন, অপরদিকে তেমনই গর্বোদ্ধত জয়োল্লাসে মেতে উঠবে সমাজের একাংশ। আপাতত এটুকুই প্রয়োজন গৈরিক শিবিরের।
এই স্বল্পমাত্রার সাম্প্রদায়িক হিংসা কিন্তু বিজেপি বা সংঘ পরিবারের আবিষ্কার নয়। ১৯৩৪ সালে জার্মানির ক্ষমতা দখল করার আগে ফ্যাসিস্টরা এই একই ধরনের স্বল্পমাত্রার হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে গিয়েছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আবার ইজরায়েল গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে আরবদের ওপরে একই কায়দায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাত ইরগুন কিংবা লেহির মতো জায়নবাদী সংগঠনগুলি। ভারতের সম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে ২০০৪ সালে লেখা বইটিতে পল ব্রাস বলছেন, প্রতিটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার পিছনে একটি সিসটেম বা ব্যবস্থা কাজ করে। এই ব্যবস্থাটিকে ব্রাস বলছেন, ইন্সটিটিউশনাল রায়ট সিসটেম বা প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা ব্যবস্থা। আসগর আলি ইঞ্জিনিয়র দেখিয়েছেন, ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটানোর পিছনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি কী ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। একেই তিনি ম্যাক্রো লেভেল ম্যানেজমেন্ট বলছেন। যতটা সম্ভব বিশ্বাস্য করে গুজব ছড়ানো, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জনগণের গুজবজনিত প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ এবং তা দেখে গুজবের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ, ক্রুদ্ধ জনগণকে পথে সংহত করা, অস্ত্র এবং জ্বালানি মজুত করা এবং শেষ পর্যন্ত আক্রমণকারী জনতার মধ্যে একটি স্বতস্ফুর্ততা গড়ে তোলা।
আপাত বিচ্ছিন্ন গণপিটুনির ঘটনাগুলিতে ২০১৫ সালে নিহত হয়েছেন ৮৪ জন এবং ২০১৬ সালে ৯০ জন। গোহত্যা থেকে শুরু করে ছেলেধরা, এমনকি ডাইনি বলে অভিযোগ তুলে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রের যাযাবর গোসাবি জনজাতির পাঁচজনকে পিটিয়ে মারা হয় ছেলেধরা অভিযোগে। আদৌ গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিটি কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখার দায় নেই উন্মত্ত জনতার। তাদের সম্বল কেবল বাতাসে ভেসে আসা গুজব। যদি কোনও বড় মাপের দাঙ্গায় শ‘খানেকও মানুষ নিহত হত, তাহলে তার অভিঘাত হত সুদূরপ্রসারী। কিন্তু স্বল্পমাত্রার হিংসায় সেই অভিঘাত তৈরি হয়নি, হয়ও না। অথচ মেরুকরণ এবং আতঙ্কিত করা, দু’টি কাজই বজায় থাকছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। আসগর আলি ইঞ্জিনিয়রের কথায়, মাইক্রো লেভেল ম্যানেজমেন্টেই এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব। জম্মুর কাঠুয়ায় আসিফা নামের যে শিশুটিকে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করার পরে খুন করা হল, তার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী অর্ধ যাযাবর বাখেরওয়াল জনজাতিদের দলটিকে কাঠুয়া থেকে বিতাড়ন করা। আতঙ্ক ছড়ানোর এটাও একটি রাস্তা, যা গণপিটুনির থেকে কোনও অর্থেই কম ভয়াবহ নয়। “ঘটনা ঘটাও ফায়দা ওঠাও”— ফ্যাসিস্টদের যাবতীয় কর্মতৎপরতার মধ্যে এই চূড়ান্ত নৈরাজ্যবাদী উপাদান সব সময়েই বর্তমান থাকে। এই ধরনের যে কোনও ঘটনার ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া, দু‘টি অভিঘাতই তাদের লাভবান করে। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় সাদা চমড়াদের হাতে গণপিটুনিতে ৪০৮৪ জন কালো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্রশাসন ছিল নির্বিকার। এই স্বল্পমাত্রার সন্ত্রাসের ফলে মজুরি ও অন্যান্য সুবিধার দাবিতে কালো শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল পুঁজিপতি শ্রেণি।
প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা ব্যবস্থা
গণপিটুনি বা স্বল্পমাত্রার হিংসার সঙ্গে বড় মপের দাঙ্গার অনেকগুলি মৌলিক প্রভেদ থাকলেও মৌলিক মিলও রয়েছে। মূলত দু‘টি ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা ব্যবস্থা বা ইন্সটিটিউশনাল রায়ট সিস্টেম কাজ করে। ফ্যাসিস্ট সংগঠন এক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে। ভারতে আরও একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই খুব সুকৌশলে ব্যবহার করা হয় “বহিরাগত তত্ত্ব”টি। আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকেই বলে আসছে মুসলিম এবং খৃস্টানরা ভারতের ভূমিপুত্র নয়, বহিরাগত। হিন্দুত্ব সম্পর্কে আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার প্রণীত তাত্ত্বিক গ্রন্থ “উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড”-এ স্পষ্টই এই বহিরাগত তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, জার্মানিতে হিটলার ইহুদিদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলেন, ভারতে মুসলিমদর সঙ্গেও সেই ব্যবহারই করা উচিত। সুতরাং ভারতে যতবারই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, ততবারই সামনে চলে এসেছে এই বহিরাগত তত্ত্বটি। গণপিটুনির ক্ষেত্রেও এই বহিরাগত তত্ত্বটিকে সমানভাবে কাজ করানো হয়। শুধু বদলে যায় ভূগোল, দেশের বদলে সামনে চলে আসে গ্রাম বা মহল্লা অথবা শহর। মুসলিমরা যেমন ওদের তত্ত্ব অনুযায়ী বহিরাগত, সেই রকমই ছেলেধরাও বহিরাগত, গরু পাচারকারীও বহিরাগত। সুতরাং চূড়ান্ত অমানবিক এবং ভয়ঙ্কর নির্মমভাবে গণপিটুনি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি জুতসই অ্যালিবাই পাওয়া যায়। দাঙ্গা এবং গণপিটুনি, দু’টি ক্ষেত্রেই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই উন্মত্ত জনতা তদন্ত বা বিচারের বিশেষ তোয়াক্কা করে না। এ ব্যাপারে যে মানসিকতা কাজ করে তা হল, রাষ্ট্রের প্রতি তাদের চরম বিশ্বাসহীনতা এবং পেশিশক্তির প্রতি পরম আস্থা। যে ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়েছে, আদৌ সে ছেলেধরা কিনা, গোহত্যাকারী কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বা সময় থাকে না। দ্রুত একটি ফয়সালা করে দেওয়াটাই তখন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। একইভাবে মসজিদের মধ্যে অস্ত্র মজুত করা হয়েছে কিনা, সবরমতী এক্সপ্রেসে কারা আগুন লাগালো, দুধে বিষ মেশানো হয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখার সময় থাকে না। মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ আর গণধর্ষণ।
গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? হ্যাঁ, গণপিটুনি বা স্বল্পমাত্রার হিংসার পক্ষে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। দেশজোড়া গণপিটুনির ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে একবারও মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুখ না খোলার অর্থ যে সমর্থনের বার্তা দেওয়া, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের কেষ্টবিষ্টুরা প্রতিদিনই উগড়ে দিচ্ছেন ঘৃণা, আরও ঘৃণা এবং চরম ঘৃণা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেই হিংসার প্রেক্ষাপটটি সুনিপুণভাবে নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। গণপিটুনিতে খুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীমশাই মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেন, তখনই বার্তা রটে যায়— হাম সে টকরানা নামুমকিন হ্যায়! গণপিটুনিগুলির অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ পৌঁছয় শিকারের মৃত্যুর পরে। হাপুরে কাশেমকে মারা হয়েছিল পুলিশের উপস্থিতিতেই। হাজারিবাগে আলিমুদ্দিন, দাদরিতে আকলাখ, আলোয়ারে পহেলু খান নিহত হওয়ার পরেই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয় গণপিটুনির পরেও যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের। অনিবার্যভাবেই পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির সবচেয়ে নিবর্তনমূলক ধারাগুলি প্রয়োগ করে। দাদরিতে আকলাখ নিহত হওয়ার পরে তাঁর বাড়িতে মজুত মাংস, গোমাংস কিনা দেখার জন্য ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠিয়েছিল পুলিশ। কেন, ভারতে কী গোমাংস বাড়িতে রাখা বেআইনি? কিসের অ্যালিবাই খুঁজেছিল রাষ্ট্র? এই অদ্ভুত আঁধারে বিচারের বাণী সত্যিই নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
এক বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি নাকি…
একথা নিশ্চিত যে, ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবলভাবেই বিপণ্ণতার মুখে। আর এই বিপণ্ণতার জন্য সর্বাংশে দায়ী রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের পরিচালক হিসাবে নির্বাচিত শাসকদল। একই সঙ্গে বিপণ্ণ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। প্রতিনিয়ত বিচারবিভাগের ওপরে খবরদারির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ঘৃণার উদগীরণ এ দেশে একটি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রেক্ষাপট ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে। শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যশ্রেণির মধ্যে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি সামাজিক ইন্টালিজেন্সিয়ার প্রধান ধারক এবং বাহক হওয়ায় মতাদর্শগতভাবে তথাকথিত হিন্দুত্ব একটি জায়গা করে নিয়েছে। মধ্যশ্রেণির হাত ঘুরে এই মতাদর্শই পৌঁছে যাচ্ছে নিম্নবিত্ত বলয়ে অবস্থানকারী শ্রমজীবী মানুষের কাছে। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ এবং ক্রোধ পরজীবী পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে সংহত হওয়ার বদলে তীব্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। ফলে মেরুকরণ যত তীব্র এবং প্রবল হবে ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য। সাম্প্রদায়িকতা যত তীব্র এবং প্রবল আকার নিচ্ছে আসলে ততই লাভ হচ্ছে পুঁজির। ফ্যাসিবাদ আদতে তো ধনতন্ত্রেরই জারজ সন্তান। সাম্প্রদায়িক হিংসার বধ্যভূমিতে জহ্লাদ হিসাবে নিয়োগ করা হচ্ছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ এবং সমাজবিরোধী বলে পরিচিত সামাজিক ঘৃণার পাত্র যুবকদের। প্রসঙ্গত গুজরাত গণহত্যায় কিন্তু সরাসরি অংশ নিয়েছিল বন্ধ কাপড় মিলের শ্রমিক, পরিচিত সমাজবিরোধী এবং আশ্চর্যজনকভাবে ভীল সম্প্রদায়ের মানুষ।
বিজেপি ক্ষমতায় এলে হিন্দুত্ববাদীদের লম্ফঝম্প বৃদ্ধি পায়, ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তারা কিঞ্চিত স্তিমিত হয়ে যায়। পাওয়ার পলিটিক্সের এটাই নিয়ম। কিন্তু তারা মরে যায় না। তাদের তৎপরতা গোপন এবং আধাগোপন প্রক্রিয়ায় চলতেই থাকে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচার, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ যদি নিরন্তর এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো না যায়, তাহলে ভারতের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে এক চরম ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।