সোমেন বসু
ভর সন্ধের ভরা বর্ষার পাঁচমাথা। তখনও ত্রিফলার যুগ আসেনি, আসলেও যে খুব ইতরবিশেষ হত তা না। সন্ধেগুলোতে উত্তর কলকাতার নিজস্ব টোন সিপিয়া। বারিধারার আড়ালে তাতে এখন ঘষা কাচের আস্তরণ। ভিজছে মানুষ, বাস, ট্রামলাইন, রাজপথ, সুভাষ বোস, ট্যাক্সি, ট্রাফিক গুমটি, গোলবাড়ি, হরলালকা, ঘোড়া, ঘোড়ার লেজ…। আনন্দে, বিরক্তিতে, স্বাভাবিকতায়, অসহায়তায়। তখনই বিধান সরণীর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা মিছিল। ছোট্ট। জনা পঞ্চাশ। হাতে হাতে মশাল। জ্বলছে। বৃষ্টির সঙ্গে লড়তে লড়তে। নিভতে নিভতেও নিভছে না। লড়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার, জিতে যাবার অদম্য স্পৃহায়, জেদে। নাচছে যেন। সবার সামনে একটা বিরাট লাল ঝাণ্ডা। নড়ছে পতপত। গাড়িঘোড়া, ট্রাফিক, বিরক্তি, মানুষ, আনন্দ স্তব্ধ লহমায়। হতভম্ব বিস্মিত জোড়া জোড়া চোখ সব ফুটপাথ থেকে, দোকানের ছাউনির তলা থেকে, থেমে যাওয়া যানবাহনের জানালা থেকে স্থির। অবিশ্রান্ত জলের ছাঁট লেগেও লাগছে না তখন। আমি দেখছি মশালগুলো এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত পাঁচমাথা পার করে আরজিকরের রাস্তাটার দিকে। কেউ কি নিভে গেল? হেরে গেল বাঁচার যুদ্ধে? না নিভুক… প্লিজ… লড়ে যাক… জিতে যাক শেষতক…। শব্দও আসছে একটা, স্লোগানের, কিন্তু হঠাৎ থেমে যাওয়া বাসগাড়ির প্যাঁ পোঁ-র গুম ধরা নীরবতা আর বৃষ্টির অঝোর শব্দ ছাপিয়ে খুব ভাঙতে পারছি না শব্দগুলোকে। আসে যায় না তাতে কিছু। ঘষা কাচের পুরুত্ব বাড়লেও আমি দেখতে পাচ্ছি জীবনের আনন্দে আবিল নৃত্যরত অগ্নিশিখাগুলো মোটের ওপর সবাই ঢুকে পড়ছে আরজিকর রোডের আলো-আঁধারিতে। দেখতে পাচ্ছি সিপিয়ার মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে ছিটকে আসা নিয়নে আর বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে থেকে থেকে জ্বলজ্বলিয়ে উঠছে লাল পতাকাটা। উদ্দাম রক্তের নাচন যেন….
বুড়নের কথা মনে পড়ে বর্ষার কথা উঠলে। আজকের এই নিরঙ্কুশ কমপ্লেক্স কালচার ছিল না তো আমাদের বেড়ে ওঠার কালে। তখন রাজীব, রজত, সাগর, বুম্বাদের সঙ্গে বুড়ন, পটকা, ফেলারাও থাকত। বেড়ে ওঠার সঙ্গী হয়ে, খেলার মাঠের সাথী হয়ে, নানা নিষিদ্ধ কাজের শরিক হয়, আমাদের সুপ্ত শ্রেণিসচেতন বাবামায়ের অনিবার্য শিরঃপীড়া হয়ে। থাকত ওদের বাড়িগুলোও। দোতলা তিনতলার মাঝে হঠাৎই একটা টালির চারচালা। জোর বৃষ্টি হলে সেই বাড়িগুলোর খোলা দরজা দিয়ে দেখা যেত আধডোবা তক্তপোষের ওপর হাড়ি বা কড়াই বুকে নিয়ে জনতা স্টোভ জ্বলছে, একপাশে জড়ো করে রাখা তেলচিটে কাঁথা বালিশ। অনেকেই ছিল, তবু বুড়নের সঙ্গে সখ্যতাটা খানিক বেশি ছিল আমার। আমার যথেষ্টই আতুপুতু-করা মা দুটো জিনিস জেনে গেছিল। ছেলের বৃষ্টি ভিজলে জ্বর হয় না, আর ছেলে ছাতা হারিয়ে ফেলে। অতএব ভেজাতে কোনও আপত্তি নেই। ছাদে, রাস্তায় গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি জমা জলে ছপছপ করতে করতে, ফুটবল নিয়ে মাঠে… মোদ্দা কথা বৃষ্টি নামলে ভিজতে হবেই। হ্যাঁ ফুটবল। যাদের বর্ষায় ফুটবলের অনুষঙ্গ নেই তারা তো বঞ্চিতই জীবনে… তাই না? আমাদের সমাজে মেয়েদের অনেক দুর্ভাগ্যের মধ্যে এও এক। ঝিলের কাদা মাঠে থপথপিয়ে ছপছপিয়ে ফুটবল পেটানো, আছাড় খাওয়া, ভূত হওয়া…! সে খেলায় ক্লান্তি ছিল রেফারি, আর বাড়ির লোক। সাধারণভাবেই প্রথমজনের আগেই দ্বিতীয় জনেদের সশব্দ অবয়ব ফুটে উঠত মাঠের ধারে। আমাদেরই… মানে আমি-রাজীব এদের। আর আসত বুড়নের মা। বাবা ছিল না ওর। এসে বলত দোকানের মালগুলো ভিজল কিনা দেখলি না একটু। একটা ছোট পানবিড়ির গুমটি ছিল ওদের বাজারে। সকালে ওর ডিউটি, সন্ধে থেকে মায়ের। বৃষ্টি নামলে ও দোকান মোকান কোনওরকমে বন্ধ করে ছুটত মাঠে। কাঠের তক্তার ফাঁকা দিয়ে প্লাস্টিক চুঁইয়ে জল ঢুকে ভিজিয়ে দিত টিকটিকি লজেন্সের ঠোঙা, চানাচুরের বয়াম, সিগারেটের প্যাকেট। আমরা তখন সিক্স-সেভেন-এইট। ফোরের পরে বুড়ন আর স্কুলে যায়নি। তখনও ড্রপ আউট শব্দটা জানতাম না।
আর সেই যে টানা সাত-আট দিন বৃষ্টি হল। আশির দশকের মাঝামাঝি বোধহয়। ঠিক সালটা মনে নেই। কী আনন্দ। বাবার অফিস যাওয়া হচ্ছে না। খিচুড়ি হচ্ছে মাঝেমাঝেই। স্কুলের তো বালাই নেইই। টিভিতেও কী একটা খেলা হচ্ছিল সে সময়ে। ক্রিকেট। শাস্ত্রী-শ্রীকান্ত-কপিল-গাভাসকারদের যুগ তখন। আমাদের উঁচু জায়গাতেও বাড়ির তলায় জল জমেছিল একটু মনে আছে। এবং সেই জলেই জীবনের প্রথম জোঁক দেখা। বাবা দেখাল একদিন সকালে ডেকে। মধুগড় এমনিতেই নিচু জায়গা। একটু বৃষ্টিতেই জল জমে। সেই ফূর্তির সময়েই বাবা একদিন সন্ধেবেলা এসে বলল মধুগড় থেকে সব লাইব্রেরিতে উঠে এসেছে। বুড়নকে দেখলাম। মা আর বোনেদের সঙ্গে বসে মুড়ি খাচ্ছে। রাতের খাবার। বোধহয়। না বোধহয় না… নিশ্চয়ই। আমাদের সে রাতে খিচুড়ি পাঁপড়ভাজা। মশলা পাঁপড়।
এখন ভিজি ফ্ল্যাটবাড়ির বারোয়ারি ছাদে। মেয়ের সঙ্গে। লাফাই দুজনেই। তারপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর মধ্যে দিয়ে কালো আকাশের দিকে চোখদুটো চারিয়ে দিলেই ঘষা কাচ আর এত বছরের চলন্ত ওয়াইপার ছাপিয়েও নজরে আসে মশালের লকলকে আগুনগুলো নাচতে নাচতে বাঁচতে বাঁচতে জিততে জিততে এগিয়ে যাচ্ছে দৃপ্ত। বুড়ন, আমি জানি, তুই… তোরা… আছিস ওই মিছিলে! আমিও হাঁটব রে একবার। পা মিলিয়ে তোদের সাথে। সঙ্গে থাকবে প্রিয় বৃষ্টি আমার… যাবতীয় ক্লেদ, গ্লানি ধুইয়ে দেওয়ার জন্য। আর প্রিয়তর ওই অগ্নিশিখাকে লড়ে বাঁচতে জিততে শেখানোর জন্য…
আহা, বুড়ন। স্মৃতিকাতরতায় আমরাও ডুবলাম।
তার আগে শুরুর অংশে, উত্তর কলকাতা। কেবল এইসব স্মৃতিকথার আগে, কিংবা কারো কারো কবিতায়, উত্তর কলকাতা চাক্ষুষ না হয়েও আপন ঠেকে।
অন্তর থেকে লেখা। এই অন্ধকার সময়ে আলোর মতো লেখা। বাহবা দেব না, উপলব্ধির মধ্যে ধরবার চেষ্টা করি বরং।