সুমিত পতি
অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অবিশ্রান্ত নয়নজোড়া খালি খুঁজে চলেছে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়া আঁচলের গৌরব। তাকে কোনওদিন বলা হয়নি আঁচলের গল্প—
কী করে বলি, জলমগ্ন রাস্তায় তোর আঁচল পেয়েছি কুড়িয়ে
ফেরত দেব? ঠিকানাও জানি
মন চায়নি; কুড়িয়ে পাওয়া সাতরাজার ধন
সোনার চেয়েও দামি, বৃষ্টির মতোই অকৃত্রিম।
গড়ে, ভেঙে, ভাঙতে গিয়েও গড়তে চেয়ে বর্ষা নামে আমাদের গ্রামে, ছাতিমতলা দিয়ে লাঙল নিয়ে যায় ওরা ক’জন– হাল না নামলে ঘরের ভেতর ঘর ঢুকে যাবে, সংসার চলবে কেমনে? তবুও দু’ কলি ভাবনার বুকে প্রাণ দিতে চেয়ে সংসারের ভেলা ভেসে যায় বৃষ্টিপাত বিষয়ক গল্পে; সুজন সখা উঠে পড়ো সংসারের কাগুজে ভেলায়, দেখবে টলতে টলতে পৌঁছে গেছ অভীষ্টে, যেখানে জরা, মৃত্যু, শোক কিছুর আর কোনও চিহ্ন নেই।
বৃষ্টি নামলেই আজও কারও কারও স্পর্শেন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেন মেঘ দেখলে ময়ূরের আহ্লাদ। রুখা আমাদের প্রান্তর, দু’ দুটো তো দু’ দুটোই ধান পাওয়া যাবে তবুও চাষা আর মাটির গল্প কোনওদিন শেষ হবে না। চাষের কাজে যে আনন্দ, চষা মাটির অদ্ভুত মন কেমন করা গন্ধ, দুপুরে কাজে বিশ্রাম দিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মেখে মেইয়্যা-মরদ পাশাপাশি বসে ফুড়কি ছাতুর বেসাতি দিয়ে ভোরে রাঁধা ভাত গলাধঃকরণ– সেও এক অদ্ভুত মজা। বর্ষার আনন্দে কানালির খেতে ধান রুইতে রুইতে পদু খুড়া জোরে জোরে গাইছে–
খ্যাপা, পর কি আপন হবে রে
শেষের দিনে স্বজন বিনে…
ঠিকই তো স্বজনেই তো সুজনের দুঃখ বোঝে শেষমেশ। কবির চোখে বর্ষা নিয়ে আসে পদ্যময় পৃথিবীর সংবাদ আর চাষার কাছে গদ্যময় সংসারের আখ্যান। বর্ষা তেমনভাবে না নামলে চাষাবাদে অনিশ্চয়তা, তখন ভাগচাষি বলাইয়ের মতো অনেকের আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ নেই– সেবার বৃষ্টি নেই, বলাইয়ের মন খারাপ, মদ ধরে, বৌয়ের সাথে মনোমালিন্য বাড়ে। বৌ রাগ করে বাপের বাড়ি যায়। বৌকে খুব ভালোবাসত বলাই। এর আগে কতবার বলাই বৌকে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে ঘরে ফিরিয়েছে– সেবার অনিশ্চয়তার বর্ষা কেড়ে নিল বলাইকে। বৌ আকাশ পাতাল ফাটিয়ে কাঁদল, নিথর বলাইয়ের দিকে চেয়ে গোয়ালে বাঁধা গরুদুটিরও চোখে জল, দেওয়ালে ঠেসানো হালটাও যেন শোকে মাটিতে গড়াগড়ি খেল– মাটিও যেন অস্থির হল।
অস্থিরতা বাড়ছে দিন দিন। যতবার কান্নাকে বৃষ্টির সাথে মিশিয়ে লুকোতে যাই নিজেকে ততই কান্নাভেজা হয়ে ওঠে তোমার-আমার ঘর-দোর-সংসার। কান্না দিয়েই বানিয়েছি পায়ের নুপুর; অসময়ে বৃষ্টি নামলে বাজবে তোমার পায়ের পাতায়, চোখের পাতায় নেমে আসবে ঘুম— ঠিক এক দশক আগে আমরা যেমন ঘুমোতাম নিশ্চিন্তে। ঘুমোতে ঘুমোতেই বিশ্বাসঘাতক আমি আর তুমি, সকাল হলেই যে যার মতো আঁকড়ে ধরেছি নৌকার হাল, দুজনেই ভাবছি— ‘অসময়ের মেঘ ঝরাবে শ্রাবণধারা…’।
কথা ছিল সেবারের শ্রাবণে ঘর আলো করার, ঘরে আমার নিয়ত অন্ধকার, বুড়ি মা দাওয়ায় বসে স্বপ্ন বোনে, আমি জ্বেলে দিই সন্ধ্যাতারা। অভাবের ঘরে স্বপ্ন জ্বলে, খড়ের চালে কেউ আজও মেঘদূত লেখে। কালিদাস সেজে নিজের ভালোলাগাকে নিজেই করেছি হত্যা। ষড়যন্ত্র নয়, ভুল মানুষমাত্রই হয়, কাউকে না পাওয়া ভুল নয়, ষড়যন্ত্র নয়, অক্ষমতা নয়, কাউকে না পাওয়া মানে মন থেকে না চাওয়া।
মন থেকেই আজ চাইলাম শ্রাবণের প্রেমে গভীর আশ্রয়। মন চাইলে আকাশ ছোঁয়া যায় লহমায়, বৃষ্টি নামানো যায়, সুর তোলা যায় বন্ধ্যা জায়গায়। আমাদের বন্ধ্যা জমিতে সুর ফলাতে চেয়েই রোপণ করলাম ‘কথা’। আগামী বর্ষায় ‘কথা’ ক্রমশ ‘কথকতা’ হয়ে গড়ে তুলবে নব সংসারের ভাবনা। মিটে যাবে মনের কোণে যত সন্দেহ; মত্ত দাদুরির ডাকে ঝিঁঝি ডাকা সন্ধ্যাপ্রহরে জ্বলে উঠবে ভালোবাসার সূর্য; দূরে কোথাও ভিনদেশি বিবাগী পথিক গেয়ে চলবে আনমনে বর্ষার জাতীয় সঙ্গীত— ‘অব কে শাওন ঘর আজা…’ আর টলোমলো কচুপাতায় ঝরে ঝরে পড়বে ভালোবাসার ঝর্ণাধারা…।