রুখসানা কাজল
মনখারাপের বিশ্রী বৃষ্টিতে মেখে যাচ্ছে চরাচর। আমার চোখের সামনে সমানে কেঁদে যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা। ভেজা মাথায় ছোট্ট মেয়েটি মায়ের সাথে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি ভেঙে। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। উথাল পাথাল দুলে যাচ্ছে বুড়ো পেঁপে গাছের সাথে হাস্নুহেনার অবুঝ ডালপালা। বুক বাঁচাতে মাটিতে শুয়ে পড়েছে সন্ধ্যামালতীর ঝোপঝাড়।
মা তুমি কাজ পেলে না। আমরা এখন কী খাব মা! ওমা, আমরা কী খাব মা?
কুমড়োবিচি ভাজা খেতে খেতে ছোট্ট মেয়েটি নেমে যাচ্ছিল। দুটি বিস্কিট দেব বলে ভেতর থেকে এসে দেখি দোতলার বাঁক পেরিয়ে একতলার সিঁড়ি ছুঁয়েছে মা মেয়ের ভেজা নগ্ন পা। আমি হাত বাড়িয়ে ডাকতে গিয়ে হাত টেনে নিলাম। ভয়ে। মায়ের চোখে স্পষ্ট আগুন। আধভেজা আঁচল মাথায়। যেন মেঘনারী। বিদ্যুৎ বাণে পুড়িয়ে দেবে বিশ্ব বৈভবের একচোখো নিষ্ঠুর নির্ণয়।
পনেরোর কিশোর। রাত ফুরোলেই বায়োলজি এক্সাম। ইউট্রাসের গঠন আঁকছে। হাত থেকে পড়ে যায় পেন্সিল। বৃষ্টির তাণ্ডবের সাথে আবার মার খাচ্ছে মা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ যেন প্রতিবাদের চমক দেখাচ্ছে প্রকৃতিকে। মাকে বাঁচাতে ছেলেটি নিজেই মার খায় উদ্যত ক্রাচের। শেষে রুখে দাঁড়ায়। বনেদিয়ানার গৌরবকে ভেঙে দিয়ে মধ্যরাতে ছুঁড়ে ফেলে লম্পট পিতাকে।
মায়ের কপাল জুড়ে রক্তাভ ছাপ। পৃথিবীর সব সাহস দুহাতে বেঁধে, ছেলেটি বুকে তুলে নেয় মাকে, মা, মা এই শেষ। আর নয়। বি ব্রেভ মাম!
সৃষ্টিছাড়া অবিরাম বর্ষা। পলিথিনের তেরপল বেয়ে ঝরে পড়ছে সাদা বৃষ্টির অজস্র জলধারা। মুখ শুঁটকো ঠিকাদার কাজ দেখছে ঢাউস ছাতা মাথায় নিয়ে। হাতুড়ির আঘাতে টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ছে আস্ত ইটগুলো। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে তারস্বরে গান গাইছে পরান মিয়া, ওরে নীল দরিয়া! আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া–
পরান আসলে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছে সেই করুণ দৃশ্য। মহাজনের ঘরে অসহায় মায়ের অবাধ্য বিসর্জন। সেদিনও বৃষ্টি ছিল এমন। সেদিনও ছিল বর্ষাকাল। ঘোলা জ্যোৎস্নায় মিনমিন করছিল আকাশের চাঁদ। মহাজনের বারান্দায় বাপের সাথে ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় ছোট্ট পরান কাঁদছিল, ও বাপ, মায়েরে ডাকি আন তুই। বাড়ি যামু না আমরা? আমার যে খিদে লাগিছে বাপ! বাপ! ও বাপ!
মা আসে। পরানকে কোলে তোলে না। কথা বলে না। হেঁটে চলে অন্য মনে। পথ জুড়ে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নার ভেজা ছায়া। চিরল পাতার বাঁশঝাড় ভিজে জরোজরো। সেই বাঁশঝাড়ে টিটিম টিটিম করে ডাকছিল কোন পাখি।
হা হা করে কেঁদে ওঠে পরানের মা, আমি চইল্লাম। চইল্লাম গো পরানের বাপ। আর তো পারি না। শইলে যে সয় না গো আর!
এক হাতে শিশু পরান অন্য হাতে চালের পুটুলি। বৃষ্টি জ্যোৎস্নায় ছুটে যাচ্ছে মা। কাছেই বর্ষায় ক্ষেপে ওঠা ক্ষুরধার নদী। অবরুদ্ধ হাহাকারে প্রেমহীন সেই অগাধ জ্যোৎস্নায় অসহায় বাপ উবু হয়ে বসে কেঁদে ওঠে, আল্লারে ও আল্লা! আমাগের ক্যান প্যাট দিলি রে আল্লা! ক্যান খিদে দিলি, ক্যান মানুষ নামের নামানুষ বানালি রে ও বেবদ আল্লা!
ঘড়িতে চারটা বেজে পনেরো মিনিট। ঘরে ঢুকতেই ভাঙচুরের শব্দ। চিৎকার, গালাগালি। ও বাড়ির অন্য মা দ্রুত নিজের রুমে ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের মতো ছেলের বউকে। ড্রাইভার চাচা এবার সময়ের হিসাব দেবে। অফিস, মিটিং, আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকান। থইথই বৃষ্টি। রাস্তা ডুবে সাগর হয়ে গেছে। স্টিল জ্যাম। দেরি তো হবেই!
সত্যিমিথ্যের কথকতা। আসলে এই ঝোড়ো বর্ষায় ঘুরে ঘুরে বই কিনতে কী যে আনন্দ লাগে বউটার। বইগুলো তখন রিমঝিম সুরে কথা বলতে শুরু করে। বইয়ের আড়ালে গোলাপবালা হাতের আভাস। তাতে দুপুর দুপুর মা গন্ধ।
বড় কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসে। কেঁপে উঠে বউটি। বালক ছেলেটি এসে জড়িয়ে ধরে, ডোন্ট অর্যি সুইটহার্ট। উই উইল লিভ দিস প্লেস ওয়ানডে। লুক আয়াম য়্যুর ডালিম কুমার মাম!
মাথার ভেতর স্বপ্ন জমে অংকুর ছড়ায়। পাতা গজায়। লতিয়ে উঠে অদম্য উল্লাসে। ভেসে চলে সাদা ফ্লোর। যেনো নুহের নৌকা! বউটি ভাবে, বন্দর আর কত দূর!
বৃষ্টি জল হাওয়া মেঘ মেখে উঠে আসে মায়েরা। জলজ। পিচ্ছিল। পরাজিতের চিরায়ত বেদনায় মুহ্যমান। তারা ডাকে। শ্বাস ফেলে হাত রাখে ভরন্ত বুকে, প্রমিথিউস। বাবা, বাবাই–
মানুষের ঘরেই আগুন রেখেছিল প্রমিথিউস! মায়েদের মানস সন্তান।