মেঘদূত বলতে মাথেরন মনে পড়ে

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

কাদায় সেভাবে না খেললেও বর্ষায় তো ফুটবল হয়েছেই। ফলে অন্তত হাঁটুতে ছড়ার দাগ। এদিকে মাঠের বদলে উঠোন বলে মাঝেমধ্যেই বুড়ো আঙুলের নখের আধখানা উড়ে গিয়ে কাজলস্যারের ভয়ে বুক ঢিপঢিপ। ‘স্কুলের শু কোথায়?’ মিনমিন করে বুড়ো আঙুলের ব্যান্ডেজ দেখিয়ে নিস্তার পেলেও মোটা কাচের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে। কাজলস্যারের মন্দ্রকণ্ঠ। অথচ সেই স্যারই জীবনবিজ্ঞানে গাছের পাতা-কুঁড়ির গল্প বলার সময় পরম মমতায় ছিঁড়ে আনতেন টগরগাছের অঙ্গ। বেতটা তখন টেবিলে রেখে যেতেন। এইরকম একদিন, সকালে মেঘজল ঠেলে স্কুলে পৌঁছে শুনি আগের দিন স্কুলের বাথরুমে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন স্যার। তখন আমরা কেউই স্কুলে ছিলাম না। আমাদের ছুটি হয়েছিল সেদিন।

বৃষ্টির দিনে, সালটা ১৯৮২ হবে, এশিয়াডের ডকু দেখাচ্ছে নবীনায়। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে অথ স্বাগতম্‌… আনন্দমঙ্গলমঙ্গলম্‌। অতনুদা কত সিনেমা দেখিয়েছে। এখন মেঘলা দিনে নবীনায় সিনেমা দেখতে যাবার কথা মনে পড়ে। জায়ান্টস অফ ব্রাজিল! গ্যারিঞ্চার পায়ের কাজটা দ্যাখ্‌! পেলের বাবা, বুঝলি? কৃশানুর মতন না পা দুটো? চব্বিশ-উনত্রিশের সামনের বাঁদিকের সিটে বসলে স্পষ্ট দেখা যায় মুখে জল দিয়ে ঝেড়ে-ওঠা শহরের বিবর্ণ-উজ্জ্বল মুখ, নবতৃণদলের মতন। গ্যারিঞ্চা নাকি অপাহিজ হয়ে গেছেন ততদিনে। সুপারম্যানেরও নাকি ঐরকমের কেস। অপাহিজ। অতনুদা বলেছিল। অবসর নিলে দৈত্যেরা অপাহিজ মানুষ হয়ে যায় কিনা, সে প্রশ্নটা সময়মতো করে ওঠা হয়নি।

বর্ষারম্ভের আগে চব্বিশ নম্বর বস্তিতে সাধনাদি-বিমলদার বাড়ি আর তার পাশের কমিউনিটি পায়খানা আর আরও কয়েকটা বাড়ির পর আমাদের নিজস্ব খোয়াইয়ের ওপার থেকে আসত কালবৈশাখী। আমাদের বাড়ির কমন পায়খানার অবস্থা ছিল সঙ্গীন। সেখানে ঢুকতে ভয় পেতাম আরশোলা আর মাকড়সার দৌরাত্ম্যে। বরং চব্বিশ নম্বরের ওই বাঁধানো ধানের গোলার মতন পায়খানা দেখে মনে হত কত ভালো আছে ওরা। আর মা-ও মাঝেমধ্যে বাবাকে বলত– এভাবে আর থাকা যায় না। আমি ছেলেদের হাত ধরে বস্তিতে গিয়ে থাকতে পারলেও সুখে থাকতাম। সেদিন এমনি মেঘের ঘটা… পরে একজন বলেছিল, আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার পথে তার মনে হয়েছে ‘বাতাসে তোমার স্পর্শ, যেন পরম আদরে ঘুম আসছে’। খুব বানিয়ে বলেছিল। বা, সত্যিই বলেছিল হয়ত, পরে যেটা বদলে গেছে।

ঝড় শুরু হলে দমকা হাওয়ায় যখন কাকচিল এলোমেলো হয়ে যায় ওই চব্বিশ নম্বরের পারে, তখন দেবব্রত বিশ্বাসের ম্যাজিক রিয়ালিজমকে সত্যি বলেই মনে হতে থাকে। লোহাসিঁড়ির আড়াল থেকে আবার এসেছে আষাঢ়। ‘আষাঢ়’-এর উচ্চারণ নিয়ে পীযূষদার মাতামাতিকে বাড়াবাড়ি মনে হলেও আমাদের পাশের আর সামনের ঘরের টিনের চালে শুনেছি কীভাবে উচ্চারিত হয় আষাঢ়, যখন তার ফাঁকেফোঁকরে হাওয়া ঢুকে তাকে ছিন্নমূল করে দেবার চেষ্টা করে। রহিয়া রহিয়া… মন্দ্রের পঞ্চম থেকে মুহূর্তে মধ্যের পঞ্চমে উঠে সামনের এবড়োখেবড়ো শত বাড়ির ওপর কালোছায়ার চাদর বিছিয়ে মাঠ তৈরি হলে তার ওপর আছড়ে পড়ত ছেলেবেলার বৃষ্টি।

শহুরে মানুষ তিলপ্রমাণ অভিজ্ঞতার ওপর ছবির পাহাড় গড়তে জানে। জলে ভেসে যাওয়া সাদার্ন এভেন্যু দিয়ে স্কুলফেরত হেঁটে আসতে চলতি বাসগাড়িসম্ভূত ঢেউয়ের ধাক্কায় মনে হত পুরীর সমুদ্রও বুঝি এইরকম হবে। সমুদ্রের ছোঁয়া পেতে ঝিনুক নয়, জলমগ্ন রাস্তাই তাই প্রধান অবলম্বন। যখন স্ন্যাপার পঁয়ত্রিশ ক্যামেরায় ছবি তোলার অধিকার হয়েছে, তখন তা নিয়ে জলরাস্তায় বেরিয়েছিলাম একবার। মেঘদূতকে যারা আহাম্মক বলে ডাকে, তাদের ছবি তুলব বলে। রোম্যান্টিসিজম আর কাকে বলে! ছবি তোলার মুহূর্তে আমার দিকে মুখ করেই গামছা তুলে রোম্যান্টিসিজমের ওপর পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল একজন। কী হাসি তার! খুব দুঃখ পেয়েছিলাম এমন ব্যবহারে।

মেঘদূত বলতে মাথেরন মনে পড়ে। পশ্চিমঘাটের ধোঁয়ামেঘ পাহাড়, আর তার গললগ্ন কালো মেঘপুঞ্জ। নেরল থেকে ধরা গাড়ির প্রাণপণ চেষ্টায় ভাঙা আর সরু আর খাড়াই রাস্তার দুরুদুরু কাটিয়ে চোখ যখন পড়ল, আর সরানো গেল না। ঘোড়ার নাদির গন্ধ আর ট্যুরিস্টদের জন্য কোলাপুরির দোকান ছাড়িয়ে সামনে শুধুই মেঘমাশ্লিষ্টসানুম। একটা গোটা দিন ওই প্রকাণ্ড ভূতুড়ে বিশাল একটা বাংলোঘরে আমি আর আমার গিন্নি। বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েকমাস, আর বিরহ প্রচুর, কারণ সে বম্বেবাসিনী ততদিনে, এক বছরের জন্য।

এর মধ্যে একদিন মন দিয়ে বৃষ্টি দেখার চেষ্টা করছিলাম। খুব ভালো করে ভেবে দেখলাম, সেই চেষ্টাটা সময়ের ও প্রবৃত্তির অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যদি খুব ভেবেই লিখতে হয়, তাহলে যতটা বানাতে হয় ততটা বানাওয়ট না-থাকাই শ্রেয়। মনে হল। আমাদের চারিদিক বজ্রপ্রবণ হয়ে উঠছে। সরকারবাহাদুর তা জেনেছেন।

তবে একদিকে বিধ্বংসী বোমার আড়ত, আর একদিকে আকাশ কালো করে চতুর্দিক মাতিয়ে বৃষ্টি এলে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই কথাটাতে ভুল নেই কোনও। যদিও গোলাপী মেঘ বৃষ্টি আনে ভয়ঙ্কর, তবু এদিকে অপেক্ষায়, গেরিলাসন্ধানী। এইসব বৃষ্টি ও বোমার নিচে বেঁচে থাকা, প্রতিরোধের সুড়ঙ্গ-আয়োজন দেখব বলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...