বিপুল চক্রবর্তী
এখনও তবে আশা
এখনও তবে গান
আষাঢ়ে এল আষাঢ়
ওগো নতুন ধান
গতবছর ঠিক এই দিনে (৫ আষাঢ়, ১৪২৪) ওপরের চারটি লাইন লিখেছিলাম।
আজ সকালেও এমনকী ভেবেছি যে, এমনটা লেখা বোধহয় আর সমীচীন নয়– আষাঢ় বুঝিবা ক্রমশ স’রেই যাচ্ছে! কিন্তু, কিছু সময় বাদেই ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা’ আকাশ ভীষণ ধমকে উঠে জানান দিল যে, আষাঢ় আজও আষাঢ়েই আছে। এল, বৃষ্টি এল।
বৃষ্টি এল। আমারই মতো যেন অপেক্ষায় ছিল ছাতে আর বারান্দায় ঝিমুতে থাকা টবের গাছেরা। মুহূর্তে, কোন্ এক অলৌকিক যাদুকরী ইশারায় মেতে উঠল তারা– মেতে উঠল হাওয়ায় হাওয়ায়। অনাদিকাল থেকে বয়ে আসা হাওয়া আর বৃষ্টি, কী যে এক স্পর্শ তার। বৃষ্টি ভিজছি আর ভাবছি যে, আমাদের অনেক অনেক বিষাদের মাঝে তবু আজও এই এক আনন্দ– আষাঢ়ের এই বরিষণধারা।
অনুশ্রী গান ধরেছে : ‘বহু যুগের ওপার হ’তে আষাঢ় এল…’। গান গাইতে গাইতে শেড্-এ থাকা টবগুলো ও খোলা আকাশের নিচে সাজিয়ে রাখছে। আবার বেশি ভিজে যাওয়া কিছু টব সযত্নে সরিয়ে আনছে নিশ্চিন্ত শেড্-এ। শেড্-এর-ও দরকার আছে বৈকি।
পিঁপড়েরা তাই গর্ত থেকে বেরিয়ে সার বেঁধে চলেছে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে, কাঁধে-পিঠে খাদ্য আর ডিম। দু’টো বুলবুল পাখি সেই থেকে শান্ত হয়ে ব’সে আছে পাশের বাড়ির কার্নিশের নিচে ভুলবশতই খুলে রাখা একটি জানলার পাল্লায়। খানিকক্ষণের জন্য জব্বর আশ্রয় পেয়েছে তারা। চড়ুইরাও এদিক-সেদিক ঠিক সেঁধিয়ে আছে। মাঝেমাঝেই কিচিরমিচির শব্দ তুলে জানান দিচ্ছে তার।
তাতা স্কুল থেকে ফেরেনি এখনও। তাতা আমাদের ছেলে, এই শহরের একটি স্কুলের মিউজিক টিচার। কী গান শেখাচ্ছে ও ছোট ছোট ওর ছাত্র-ছাত্রীদের, ‘রেইন রেইন গো অ্যাওয়ে…’? বৃষ্টি এখনই যাওয়ার নয় তবু। আজ ওর কপালে ভোগান্তি আছে। আমার অফিস ছিল তাতার স্কুলের পাশেই, ক্যামাক স্ট্রিটে। ফলে জানি যে, বৃষ্টির দিনে মুহূর্তে কেমন ভেসে যায় ওই অঞ্চলের চারপাশ।
শুধু ওই অঞ্চল কেন, বেসিন-আকৃতির গোটা শহরই তো ভাসতে থাকে ফি-বছর। বেহালার বন্ধুদের বুঝি বেহাল অবস্থা ইতিমধ্যেই। তবু, বেসিনের আউটলেট পরিষ্কার রাখার দায় নেই কারু। উপরন্তু, একের পর এক ফ্লাইওভার– ফ্ল্যাট– শপিং-মল, উঠছে আর উঠছে। তার জেরে পুকুর বোজানো ও গাছ কাটার মহোৎসব চলতেই থাকে। এই মূর্খ মহোৎসবের বর্জ্য, যতটা যা অবশিষ্ট আউটলেট, তার মুখ চেপে ধরছে আরও আরও।
–হ্যালো, বিপুলদা!
–হ্যাঁ, বলুন সুলেখাদি!
–বৃষ্টি নামল কলকাতায়?
–হ্যাঁ, আজ নামল। আপনাদের ওখানে?
–কাল রাতেই নেমেছে। এখনও ঢালছে।
–তাই? আনন্দের খবর তো!
–হ্যাঁ, মাঠ-ঘাট জল পেল শুরুতেই।
–হীরাদা কোথায়?
–হীরা-সুভাষ-দুর্গা, সকাল থেকেই সব মাঠে।
–বাঃ, খুব ভালো খবর।
–উঠোনের ডোবাটা জলে টইটুম্বুর একেবারে।
কথা বলতে বলতে সুলেখাদির গলা আনন্দে ডুবতে থাকে। তা ডুববে না কেন, সুলেখাদি বাঁকুড়ার চাঁদড়া গ্রামে থাকেন যে। শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে এইসব আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। পুড়ে-ঝুরে যাওয়া যত মানুষের বসবাস। অথচ শোনা যায় যে, পাহাড়-ঘেঁষা এই অঞ্চলগুলো নাকি বহু আগে একদা বৃষ্টি-অরণ্য ছিল। আজ শুখা।
এইসব পোড়া মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে আমার তাই অপেক্ষা আষাঢ়ের জন্য। পিঁপড়েরা যেন আশ্রয় খুঁজে পায় তাদের। বুলবুল-চড়ুইরাও তাদের নিজের নিজের আশ্রয়ে ঠিক থাকুক। শহরের স্কুলে আটকে থাকা শিশু ও তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সময়মতো বাড়ি ফিরুক। অফিসের লোকজনও জল ঠেলেঠুলে পরিবারের কাছে ফিরুক। মহাকাশের নিচে আশ্রয় অটুট থাকুক চলমান এই প্রাণ-বিশ্বের। ছোট্ট নতুন ধানের চারাটি থেকে শুরু ক’রে প্রান্তরের সবচেয়ে দীর্ঘ ও বয়স্ক যে গাছটি, তাদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় আমি যেন গাইতে পারি–
বৃষ্টি-মাতা! বৃষ্টি-মাতা! বৃষ্টি করো দান
উষ্ণ এই ধরিত্রীর করো পরিত্রাণ…
৫ আষাঢ়, ১৪২৫ (২০ জুন, ২০১৮)
বাহ!! খুব ভাল লাগল!!