পার্থজিৎ চন্দ
বন্দর ও বাণিজ্য-সম্ভাবনার অপমৃত্যুর মাঝখানে বিষন্ন হয়ে থেকেছে আমার বর্ষা। সে ঠিক এইভাবে থেকেছে বলেই আমার শরীরে বুনে দিয়ে গেছে বিষণ্ণতার নীল ছত্রাক আর খ্যাপার আনন্দ।
যে নারী আমার প্রেমিকা তাকে আমি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতে পারিনি কোনও দিনই। ঠিক তেমনই সেই নদীকে আমি হুগলি নদী বলে ডাকতে পারিনি কোনও দিন। রাজধানীর থেকে দূরে, ঠিক যেখানে আমার গঙ্গা বাঁক নেয় একদিকে আছিপুর আর এক দিকে সিন্দু্রিয়ামহলের দিকে, সেখানে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে উড়ে আসে ঝাঁক ঝাঁক মেঘ। সেই মেঘ আষাঢ়স্য ‘প্রশম’ দিবসে আরও আরও গাঢ় হয়ে, গর্ভিণী হয়ে ঝুঁকে পড়ে নদীটির বুকে। মেঘেদের কালো ছায়া নদীতে। দূরে, গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে জেগে থাকে পাটকলের উঁচু উঁচু চিমনি। নদীর জলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ভাঙা জেটিগুলি। ঠিক যেন কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী সন্ধের মুখে জল খেতে নেমেছে নদীটির বুকে। ডায়নোসরের মতো লম্বা গলা জলে নামিয়ে দিয়ে সে শুষে নিতে চাইছে আমাদের বিষাদ। কিন্তু পারছে না।
এক একদিন দুপুরে সেই আছিপুরের দিকে থেকে বৃষ্টির চূড়ান্ত সম্ভাবনা নিয়ে উড়ে আসে কালো মোষের মতো মেঘ। আমি দেখতে পাই সেই মেঘের ভেতরে একটি ফুটে ওঠা সি-মাউথ। বে অফ বেঙ্গল। ঢাকায় শায়েস্তা খাঁ-র এজলাশ। এবং একই সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস ও সন্ধির শর্ত। দেখি সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিমাখা-দিনে কোম্পানির ডিরেক্টরদের উড়ে আসা চিঠি, ‘…likewise been satisfied that Ulluberreah was misrepresented to us by those sent to survey it’. আমার শ্রাবণের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে এক পারপারহীন মিস-রিপ্রেজেন্টেশন। সেই প্রায় কাল্পনিক সত্য-ঘটনার-মতো দুপুরে নদীর বাঁকে এসে দাঁড়ায় ইউনিয়ন জ্যাক ওড়া একটা জাহাজ। সাহেব-নাবিকের অসহ্য স্টুপর ভেঙে যায়। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া নেশার মধ্য থেকে তিনি উঠে দাঁড়ান। নেশার মধ্যে থেকে জাগে বন্দুকের নল। বৃষ্টি-হাওয়ার দিকে, শ্রাবণের দিকে আক্রোশে গুলি ছোঁড়েন সাহেব। সেই গুলির আওয়াজ বৃষ্টি-ভেজা গঙ্গার বুকে ভাসতে ভাসতে জোব চার্নকের ফেলে যাওয়া জুতো ও প্রখর স্বপ্নের সন্ধানে ভেসে যায় কলিকাতার দিকে। কলকাতায় ঢুকেই সে আশ্রয় পায় হীরা বুলবুলি বাঈয়ের গর্ভে। নেটিভবাবুরা আনচান করেন নুনের দালালির অপার সম্ভাবনায়। বৃষ্টি নামে কলোনিয়াল বঙ্গে।
ভুল বললাম। কলোনিয়াল দিনকালের বাইরে ভীরু ও আহত-ভ্রমরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বৃষ্টি। আমাদের চিন্তা-চেতনায় (এমনকি যৌনতাতেও) কলোনিয়াল লিগ্যাসির যে গুরুভার, সেখানে আষাঢ়-শ্রাবণ আজও ‘মিসফিট’। শহরের সব থেকে বড় শপিং-মলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, গ্রাম থেকে সদ্য পড়তে আসা ভূতের মতো মিসফিট। সে একা। সে একা। আর একা বলেই সে সুন্দর। আজও।
সেই একাকী সুন্দরের সঙ্গে মানুষের বারবার দেখা হয়ে যায়। ‘এ জীবনে বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি ঝরে মাত্র একবার’, এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি যে এ জীবনে বৃষ্টি ঝরেই। বারবার বৃষ্টি ঝরে। বারবার অপ্রস্তুত মানুষকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে সে হারিয়ে যায়। সবার আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চেপে বসে বুকের ওপর। বর্ষা আসলে এক নিবিড় দুর্গ। সে তার ধারার আড়াল দিয়ে তৈরি করে এক দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ। শুধু কান্না আর অভিমান ছাড়া সেই প্রতিরোধ ভেঙে ফেলবার আর অন্য কোনও অস্ত্র নেই।
এই বর্ষার সঙ্গে আমার যে কতবার দেখা হয়ে গেছে! আমার ছোট্ট জনপদের সব সরু রাস্তাই বেঁকে গেছে গঙ্গার দিকে। বহু বহু বর্ষা-দিনের আগে আমার একটা ছোট্ট সাইকেল ছিল। তার রিনরিনে ঘণ্টির উপর এসে বসত বৃষ্টি-ভেজা পাখি। কোনও দিন সেই সাইকেলে কোনও বর্ষা-কিশোরীকে সাহস করে বসিয়ে হারিয়ে যেতে পারিনি দিগন্তের দিকে। কিংবা বলা যেতে পারে যে কোনও কিশোরী সাহস করে বসতে পারেনি সেই সাইকেলে। শুধু বর্ষার দিনে তাদের লেডিবার্ড সাইকেল চালিয়ে স্কুলের দিকে হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার বর্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। না শেষ হয়নিও হয়তো… কারণ আমি নিজেকে স্পষ্ট আবিষ্কার করি এক নিঝুম বাড়ির একফালি বারান্দার নীচে। মধ্য দুপুর। আমার শহরে গোপনে যে তিনজন কবিতা লিখত তাদের একজনকেও পাইনি সে দুপুরে। মাথায় জয় গোস্বামীর সেই বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি খাতার মতো কিছু একটা। দম বন্ধ হয়ে মরে যাবার অনুভূতি। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল সে দুপুরে। এই বাড়িটার মাঝে মাঝে প্লাস্টার-খসা প্রতিটি ইট আমার চেনা। যদিও বাড়িটির দিকে আমি তাকাতে পারতাম না কোনও দিন। সেদিন পবিত্র চোরের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম বারান্দার নীচে। বারান্দার এক কোণে হাওয়ার আছাড়িপিছাড়ি আর বৃষ্টির ছাটের মধ্যে দোল খাচ্ছে তার পোশাক। আমি চিনতাম, কারণ এই পোশাকেই সে পড়তে আসত আমার প্রায়-অন্ধ ইংরেজি মাস্টারমশাইয়ের কাছে। যে সব বৃষ্টির দিনে সে পড়তে আসত না, সে দিন স্যার আমার পিঠে হাত রাখতেন। টু-সাম… থ্রি-সামের ভার্চুয়াল দানবের সামনে আজও বৃষ্টির দিনে দোল খায় সেই দুপুর।
জানি, অনেকেই আশাহত হবেন। এই লেখায় এখনও রবীন্দ্রনাথ আসেননি। আমার বর্ষায় আসেননি রবীন্দ্রনাথ। এই কালাপাহাড়ি বর্বরতা নিয়ে হয়তো কবিতা লেখাই অপরাধ। আসলে আমার তিনি আসেন… যান। সম্ভাবনার অপমৃত্যুর মতো মাঝপথে অপ্রস্তুত করে হারিয়ে যান। বা আমাকে অনাথ করেই যান। কিন্তু স্থিরভাবে থাকেন না কিছুতেই।
আমার স্থির বিশ্বাস এই ভারতবর্ষের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বর্ষা। ভারতভূম যতটা বর্ষার ততটা আর কোনও ঋতুর নয়। বহু দূর থেকে, হয়তো সেই রামগিরি পর্বত থেকেই, যখন মেঘের দল ভেসে আসে, তখন আমার শরীরে শুরু হয় এক অদ্ভুত খেলা। আমি বুঝতে পারি শরীরের মধ্যে জেগে উঠছে এক প্রাগৈতিহাসিক জীব। তার লম্বা গলা। পাটকলের চিমনির মতো মেঘেদের দিকে চেয়ে থাকা দানব শিশ্ন। এক বন্ধু বলেছিল, ছোট থেকে দেখতে দেখতে নদীর বুকে মুখ থুবড়ে থাকা জেটি আর লোহার টাওয়ার আমার জিনের মধ্যে এনক্রিপ্টেড হয়ে গেছে। হয়তো তাই। কিন্তু এই অনুভূতিটাই হয় আমার।
কী আশ্চর্য, সেই অনুভূতিটাই আমাকে প্রতিটি শ্রাবণে টেনে নিয়ে যায় নির্জন গঙ্গার দিকে। মনে পড়ে মৃত বন্ধুর মুখ। মৃত সব প্রেম। হ্যাঁ, মৃতই। সন্ধ্যা হয়ে আসে। গোয়েঙ্কাদের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনির ওপর থেকে ভুস করে শুশুকের মতো মাথা তোলে একটা প্রকাণ্ড মেঘ। তার বুকে লালচে আভা। আমি স্পষ্ট দেখি আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে সেই প্রাণীটা জল খেতে নেমেছে গঙ্গার বুকে। অনন্ত তৃষ্ণা তার।
রক্ত-রঙ গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছে একটা নৌকা। তার ভেতর এক মাল্লার অস্পষ্ট মুখের আদল।
তাঁর হাউসবোট কি তবে শেষমেষ এই বর্ষার ভেসে এল পদ্মার বুক থেকে? আমার গঙ্গায়…