বৃষ্টিদগ্ধ লাল

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য  

 

বৃষ্টি নামে। রাতভর জানলার কাচে চোখ রেখে দূরে— কারও মুখ ধীরে হয় বাষ্পকুসুম। রাতভর দাঁড়িয়ে চোখ রাখি বৃষ্টির অক্ষরে; বিছানায় একলা পড়ে থাকে ঘুম। বৃষ্টি যেখানে ঝরে শাদা অক্ষর– কেউ ছিল তার পাশের অন্ধকারে বকুল। ছাতাখানি উড়ে গেলে তারপর বৃষ্টি অক্ষর লেখে তার বকুলগন্ধ এলোচুল। কে কখন বৃষ্টিতে ভিজে যায়? ফুটপাথে নেমে পড়ে তরল আকাশ নীল। কে কখন বৃষ্টিতে দৃষ্টি হারায়? তার চোখে এসে আকাশ বোনে দীর্ঘ ঝিল, ঝিলিমিল ঝিলিমিল।

বৃষ্টি নামে। সে আকাশে তাকালে– আকাশ ছিঁড়ে বৃষ্টি নামে। একফোঁটা বৃষ্টি হলে চোখের ভিতর, সে-ই আমার একফোঁটা নির্জন ঘর। আকাশের হাসিতে বৃষ্টির প্রশ্রয়। পরিণত চোখ ঘুমের আকুলতা। পরিণত চোখ রাতজাগা ঝিঁঝিঁ— ছিল কবে পূর্ণতার আকাঙ্খা। বিদেহী হাত ঘুরে ঘুরে বাতাসের ক্ষয়। বর্ষাঘাতে ছিল এতটুকু ভয়, আকাশের হাসিতে বৃষ্টির প্রশ্রয়; কুকুরের হাসিতে বৃষ্টির প্রশ্রয়।

বৃষ্টি নামে। তিনটি বৃষ্টিপাতের পর আর ইচ্ছে করে না। মেঘগুলি ঢেকে দিই ক্লান্ত রোদের বাকলে। ঘেমে উঠি অর্থহীন অভিমানে। আমার অভিমান একদিন কিনেছিল তিনটি বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাত কিনেছিল তিনটি বকুলের দামে। ওটাই নিজস্ব বলে ঘটাই। বাকিটা আমার নয় জেনে পুড়ে যাই অর্ধেক। বাকিটা পড়ে থাকে বিছানার মৌনী চাদরে। আমাকে টানে না তা। বিস্মৃতির বনে ঘুরে এসে দেখি সে-ই পরিণত সুন্দর। সুন্দরের কাছে জমা আছে আমার সকল অক্ষর।

বৃষ্টি নামে। আমি পুড়ে যাই। বকুলের বনে, তমালের বনে, হিজলের বনে, হরিতকীর বনে বৃষ্টি নেমে সবুজ হয়ে গেলে আমি তার চোখের পাতার নিচে শুয়ে থাকি মহাকাল। তার চোখের ভিতর নিঝুম কেঁদে কেঁদে আমি চিরদিন বৃষ্টিদগ্ধ লাল।

বৃষ্টি নামে। ভিতরে বৃষ্টি— বাহিরে বৃষ্টিধারা। ভিতরে সন্ধ্যা— বাহিরে সন্ধ্যাতারা। এই গান শেষ হলে নামে বৃষ্টির ভিতর বাদল। এই বাদল ভাসায় পাথর। পাল্টে যাক ঘর খড় সোনালি কহর। বলে সে নীল চোখে শ্যামল। জানলার দোহাই, ভেঙে চলো দরজার গরাদ। ঘনাবে না উল্লম্ব রাত। ঘিরে এসো।

বৃষ্টি নামে। আমি চিনি তাকে চিরদিন বৃষ্টিধারা জলে, তাকে ছুঁয়ে কান পাতি নিজেরই করতলে। কাদা আর বৃষ্টিপাত উতল শৃঙ্গারে ভেঙে চলে বাতাসের পায়ের ছাপ। শরীর ঘূর্ণি। ঘূর্ণির ভাষা বুঝে বৃক্ষছেঁড়া পত্রদল। ভুলে যাওয়া ব্যথা ডাকে আয়। এখনও অনির্মিত আছে কেউ। ধীরে, অস্ফুটে বলা কথা দিগন্তের কানে ঝুলে আছে। কেউ আসে বাহির হতে। সে দ্বার ভেঙে আসে। সে ঝড় হয়ে জানলার পর্দা উড়ায়। জানলার পর্দারা ডানাবতী হলে সে ফুলদানিতে ঢুকে পড়ে। সে আকাশে তাকায় যখন– ঝিরিঝির বৃষ্টি নামে। একফোঁটা বৃষ্টি হলে চোখের ভিতর, সে আমার একফোঁটা নির্জন ঘর।

বৃষ্টি নামে। রিনরিনে চোখের ঘেরে সে টেনেছে কাজল। কাজলের ঘরে কোন জল করে চিরদিন ছল? কাজলের ঘর চিরদিন করেছে নিজেকে পর। কার চোখের পরে তবে তার কেঁপেছে ওষ্ঠাধর?

বৃষ্টি নামে। একদিন ছিল কচুপাতার বন। বৃষ্টি হত কচুপাতার বনে। অথচ নিবিড় ভিজে যেতাম আমিই, এখনও যেমন। আমার কোনও শ্রাবণ ছিল না নিজের। আমার কোনও শত্রু ছিল না; এখনও নেই। আমিই সবার শত্রু হয়ে গেছি বহুদিন। ভাঙারাতের সপ্তক বাজায় নিঃসঙ্গ বীণ।

বৃষ্টি নামে। একটি কান্না ছড়িয়ে রেখেছি মেঘে। একটি কান্না জমালাম আবেগে। বৃষ্টিকে বাদল নামে ডাকি, বুকের আগুনে পুড়ে পুড়ে আমি একলা জোনাকি। বাদল নামো। আমাদের হাতে তিনটি জোনাকবাতি। আমাদের হাত তো দুইটি হাতই ছিল। আমাদের আর একটি জোনাক ছিল। বাদল নেমে তার পরিণাম বলো।

বৃষ্টি নামে। কখনও কেউ রক্তের যন্ত্রণা চিরে, একটি গান তো মরে যায় মরে যায়। পাতালের ছায়া ডেকে ডেকে একাকার। আমার তাকে নিয়ে গেল কোনখানে? আমার সে কি শুনেছিল স্বরলিপি? আমার কাঁদন স্বরলিপি হয়ে গেছে। তানপুরাটার ভারি তারটিতে সে, এখন তো রোজ বাদলের গান করে, বাদল নামো, বাদল নামো।

বৃষ্টি নামে। দূর মন্দিরে কীর্তনিয়ার বাঁশি। কার কীর্তন বাজে সে বাঁশির দেহে। একলা ঘুমে শুয়েছে জলপাই বন। লালপাতা তার কান্না লুকোয় শিরায়। আমার কান্না বহুদূর মেঘে মেঘে মেশে। বাদল নামো, বাদল নামো হলাহল এলোকেশে।

বৃষ্টি নামে। আমার ঘুমের নদী এসে দেখি চোখ ধুয়ে গেছে। নদীর সুরের কাছে কখনও দাঁড়িয়ে আমি ধীর। নিঝুম বুকের পরে আনমন গান স্বপ্ন হয়ে আছে। আমার চোখজুড়ে বয় একা শ্রান্ত হাওয়ার মীড়।

বৃষ্টি নামে। নদীমধ্যে বৃষ্টি নেমে এলে নদীর তলের পাথর সব কোমল হয়, হয় উড়ুক্কু। রূপবতী বৃষ্টির মোহ। এই বর্ষণ রাত্রিকে দেয় সমাহিত কেমন এক রূপ। তাকে আমি চিনি, তার পথচলার গল্পও অনুরূপ। আমার বিশেষ বাদলাদিনের প্রান্তে তাকে তো খুঁজিনি অলিখিত সুর। সে বসেছিল বহুদূর; প্রসন্ন উত্তরে শুয়ে থাকা চিল। ঝিলমিল রং ছিল তো রৌদ্রে, অমল ভুলের অপরূপ মিছিল। আমার সন্ধান ঝরে যায় স্মৃতি, আমার বৃষ্টি আঁকে বিস্মৃতি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...