দেবব্রত শ্যামরায়
একদা তো জলেই ছিলাম, তারপর কাদায়। কয়েকশো বছর ধরে পাঁকে পা পুঁতে দাঁড়িয়ে এক প্রাকৃতিক কণ্ডিশনিং… আমাদের বেশিরভাগ পূর্বজদের… আজ আমরা স্বীকার করি বা চেপে যাই। মেঘ-বৃষ্টি-রোদের নির্ভরতায় বাঁধা ছিল দিন ও রাত। মাটির হাঁড়িতে রাখা বীজধান, হাঁড়ি জড়িয়ে নির্ভয়ে শুয়ে থাকত মেটেরঙ বাস্তুসাপ। চষা মাটি থেকে জেগে ওঠা কেঁচো আর সেই কেঁচো খেতে হালের ডগায় লাফিয়ে বেড়াত কাকের দল। একদা এইসব…।
বর্ষা নিয়ে একটা ছোটখাটো ব্যক্তিগত গদ্য লেখার কথা ছিল, আর আমি এসব কী যা-তা শুরু করেছি! আপাতত জমার খাতায় খান চল্লিশেক বর্ষা, মাত্র প্রথম দু’-তিনটি স্মৃতিধূসর, এই পুঁজি থেকেই না হয় একটা-দু’টো…। অবশ্য আমার ব্যক্তিগত আষাঢ় ময়ুরের মতো নাচে না। এই বর্ষা প্রবলভাবে শ্রেণিচিহ্নিত; বর্ষা নিয়ে যেটুকু ছলছবিলা, সবই আমাদেরই; পথবাসী গৃহহারাদের এই নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও আবেগ নেই। আমার বর্ষাও প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন, আদ্যন্ত নাগরিক। নির্বাসিত যক্ষ এখানে রুফটপ ক্যাফেতে ছাতার নিচে বসে সঙ্গিনীর সঙ্গে কফি খায়। কালো কফি। অল্প কিছু কথা হয়, উদ্দেশ্যবিহীন। বৃষ্টি ধরে আসে। মরা আলোর নিচ দিয়ে যে যার পথে পা বাড়ায়। উদ্বাস্তু পাখির দল কার্নিশে কার্নিশে ওড়াউড়ি করে।
অথচ আরম্ভটা এত নির্মোহ ছিল না। অনেক সরল, সজল সে এক মফস্বল। অথবা আরও বেশি নির্মম ছিল, সেদিন যা বুঝিনি। ছেলেটা মর্নিংস্কুল-ফেরতা, বৃষ্টিতে তুমুল ভেজে। মা-বাবা কাজে। হঠাৎ মাথা ঘুরে যায়। দু-কামরার দুপুর জুড়ে জ্বরের ঘোর। স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে একটা সবুজ হিলহিলে সাপ। ঢুকছে তো ঢুকছেই। কোনটা বেশি লম্বা– দুঃস্বপ্ন, নাকি সাপটা? নাকি ওটা আদৌ কোনও স্বপ্নই নয়? একা ঘরে সে ও সাপ, ছেলেটার জ্বর বাড়ে, সাথে ভুল বকা। বাবলুকাকা বিকেলে পড়াতে এসে টেবিলের নিচে অতিথিকে খুঁজে পায়। আর কী সাহস বাবলুকার! যদিও দেখা গেল, ওটা নিরীহ একফুট এক জলঢোঁড়া, তাও। কিন্তু তারপর থেকে পরপর অনেকগুলো রাত ছেলেটা সাপের স্বপ্ন দেখে, ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়… মা বলত, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! দোষ কাটাতে মা কাকে যেন নিয়ে আসেন… লাল পাড় শাড়ি, লম্বা খোলা চুল, কপালে ইয়া বড় সিঁদুরের টিপ। তিনি শ্রাবণের সন্ধেবেলা সুর করে মনসামঙ্গল পড়েন। ঝিম-ধরানো সুর। মা-কাকিমাদের ভিড় জমে। ঠিক তখনই টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, সেই শব্দে মনসার গান ডুবে যায়। স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়া আর কুপির কাঁপা আলোয় ছেলেটা মায়ের কোল ঘেঁষে বসে।
কোলের ওম ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে হয়। আকাশভাঙা বর্ষণে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে গোলপোস্ট, দূরের পুকুরধার, গোটা ছেলেবেলাটাই। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বাবা-মা’র অল্প পুঁজি দিয়ে খান দুই ঘর… প্রথম বর্ষায় হু হু জল… দর্মার বেড়া পড়ে যায়। বাড়িতে নতুন আসা দড়ি ঝোলানো এফ এমে মেঘ রাগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসান দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। অপ্রত্যাশিত রেনি ডে পেলে সেই প্রথম মাঠে না গিয়ে, বাড়ি না ফিরে ম্যাটিনি শো। নায়িকার বৃষ্টিভেজা শরীর থেকে টিপ টিপ জল ঝরে, জল না আগুন! আবার, সাপ ঢোকে ঘরে। হ্যাঁ, বাস্তুসাপ, বয়ঃসন্ধির।
আসে লিটল ম্যাগ, রাজনীতি… ক্রমশ কালো হয়ে আসে ঠোঁট… বর্ষার অনুষঙ্গ কমে আসে। শেষবার মনে রাখার মতো ভিজেছি এক শ্রাবণসন্ধ্যায়, বন্ধ দোকানের সামনের চালায় আমরা দু’জনে আটক, অনিচ্ছায়। দুই না তিন। চাতালের এক কোণে আশ্রয় নিয়েছিল এক পাগলও। পাগলের হাতে ইটের টুকরো, ঠোঁটে খিস্তি। দমবন্ধকরা সেই বৃষ্টির কারাগার থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। পাগলের অভিশাপ নাকি অসম অর্থনীতি, জানি না, আমাদের আর দেখা হয়নি। সেই বর্ষার কাছেও ফেরা হল না আর।
ছেলেটার তখন কলেজ, মায়ের ব্রতকথা-র ফাঁকে একটা লুকোনো চিঠি খুঁজে পায়। বাবলুকার লেখা। মা-কে। বাবলুকা একদিন আচমকা পড়াতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। চিলেকোঠায় একা একা বসে সহসা খুব শীত করে ছেলেটার। আবার জ্বরটর এল নাকি? টেবিলের নিচের সেই সাপটার কথা মনে পড়ে। জলঢোঁড়া। নির্বিষ। নিতান্ত একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছিল। অথবা ইঁদুর। সাপটাকে কি মেরে পুঁতে দিয়েছিল বাবলুকা? নাকি পুড়িয়ে দিয়েছিল? ঠিক মনে পড়ে না। ছেলেটা চিঠিটা পুড়িয়ে দেয়। ঝরনা কলমে লেখা নীলচে অক্ষরের ছাই ভেজা বাতাসে উড়তে উড়তে কোথায় মিলিয়ে যায়।
দোতলার এই সাফসুতরো ঘরে সাপ ঢোকার সুযোগ নেই। মা আজকাল আর হাঁটতে পারেন না৷ আগে টিনের ছাদে বৃষ্টির আক্রমণের শব্দে সারারাত ঘুম হত না মা’র। এখন বাইরের কোনও শব্দ নেই, মা তবু রাতের পর রাত নির্ঘুম। সকালে উঠে কাগজে এই কলকাতা শহরে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ার খবর। বিচ্ছিন্নতা। কৃষকদের প্রেতমিছিল রাজপথের বুকের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যায়। বাজার বিশেষজ্ঞরা তর্কে মাতেন, কৃষকমৃত্যু কতটা বর্ষাজনিত, কতটা পরকীয়া! অস্বস্তি হয়, অভ্যাসবশত টাকরায় জিভ ঠেকাই। অবশ্য যেকোনও শোকের আয়ু এখন বড় কম। উফারে গমগম করেন মেহেদি হাসান– উমর ঘুমর ঘের আয়ি রে….। যক্ষ, আত্মপ্রতারক, বিকেলে ছাতার নিচে বসে সঙ্গিনীর সঙ্গে কফি খায়৷ মাপা মেঘে নাগরিক বৃষ্টি ঝরে। টেবিলে কালো কফি। সঙ্গিনীর বিষণ্ণ চোখ। অপ্রেমের স্বাদ তেতো। যৌনতারও। কফির কাপ ছুঁয়ে জলের ছাঁট। এক কাপের দাম একশো পঞ্চাশ-ষাট। এই কফি উৎপাদন করছেন যিনি, তাঁকে আর যাই হোক আত্মহত্যা করতে হয় না বোধহয়।