বর্ষা আসে, বর্ষা যায়

ঈশিতা দে সরকার  

 

দেখা হলেই মৃণালকাকুর সেই এক কথা– “একটা ভালো খবর দে তো, পেট ভরে রসোগোল্লা খাব।” মৃণালকাকুর ‘ভালো খবর’-এর আগেই একটা খারাপ খবরের সামনে বসে খয়েরি প্লেটে দুটো সাদা রসগোল্লা খেতে হয়েছে আমাকে। সাদা রসগোল্লা, সাদা রজনীগন্ধা, তালশাঁস রঙ বৃষ্টি গলার কাছে যে বৃত্ত এঁকেছিল, সে কম্পাস হারিয়ে যাওয়াই ভালো। বৃষ্টি মাস ছিল না সেদিন, ছিল বৃষ্টিদিন। একটা আস্ত বৃষ্টিদিন কখনও অনেকগুলো বর্ষা মাসের চেয়ে চূড়ান্ত হতে পারে। মৃণালকাকু সরকারি বাসের টিকিট কাউন্টার থেকে সাদা টিকিট ছিঁড়তে ছিঁড়তে বৃষ্টির এক্কা দোক্কা ঘরে হারিয়ে গেছে। বাস জানালার ধুলোমাখা কাচে বৃষ্টি এলেই আমার চেনা আঙুল একটা ঝিম ধরা রাস্তা আঁকে। যে রাস্তা থেকে পেছন ফেরা যায় না।

দুটো মানুষ একটা গাছ হতে পারে এই বর্ষায়। হাতের তালুতে থাকা নদীগুলো উপচে পড়ছে। শরীর জুড়ে ডিঙির তির তির। মোহিনী অট্টম ছন্দে বর্ষা এসেছে। সে ছিল যতটা প্রকাশ্য, ততটা গোপন। ঝুঁকে পড়া পাতার প্রস্তাবে জলের সম্মতি ছিল। অসম্মতিতে ঠোঁটের প্রতিটা অক্ষরবৃত্ত যত্নে তুলেছিল চার বছরের ছোট প্রেম। ছাদের দরজা বন্ধ করলে, যে জ্যামিতিক কোণ, সেখানেই পরষ্পরের ঠোঁট পরস্পরকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘চুমুর কোনও পঞ্জিকা হতে দেব না…’!

বর্ষা আসে। প্রতি বর্ষায় নিষিদ্ধ সেই স্পর্শ আরও বেশি করে একমাত্র উচ্চারণ হয়ে পড়ে। শরীরে জলের প্রয়োজন, মরাগাছের ‘ছোঁয়াচ’ প্রয়োজন, বর্ষা আমার এমনই এক প্রেম বিজ্ঞান।

গ্রীষ্মের ছুটিকে ‘আম কাঁঠালের ছুটি’ বলত আমার মফস্বল। দাঁত টকে যাওয়া আশ্বিনী আমমাখা ছুটির দুপুরগুলোকে সোহাগী করে তুলত। কাঁঠালে তখন রঙ লেগে আছে। বর্ষা ঢোকে। আটপৌরে সোনালি থান পরা কাঁঠাল থেকে বীজ খুলে রাখে দিদা। দিদা মাটির উনুনে লোহার কড়াইয়ে বালি দিয়ে কাঁঠাল বীজ ভাজত। খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরতাম সে মখমল। বৃষ্টি আসত কখনও বিভূতিভূষণীয় কারুকার্যে। উনুন পাড়ে বসে দিদা প্রায়ই বলত, ‘নদীর ধারে বাস/ভাবনা বারো মাস।” বলত, বর্ষার জলে বিপুল কীর্তনখোলা কীভাবে তুমুল হয়ে উঠত। এপাশে রিনরিনে কুলিক ওপারের ঝলমলে কীর্তনখোলা। বর্ষায় দিদার মন দুই নদীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াত। দেশভাগ মানুষকে অন্য নদী, অন্য জীবন, অন্য চলা দিলেও প্রিয়জন বেদনা ছিল একতারাতে বাঁধা। ছুটির দুপুরে মাঝে মাঝে বারান্দায় দিদার পাশে বসে এক বিষাদ বর্ষার খোঁজ পেতাম। সে বর্ষা দেশভাগের যন্ত্রণার প্লাবনের কাছে হাঁটু মুড়ে বসত। প্লাবন তো বর্ষারই অবাধ্য সন্তান।

জন্ম, বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। উত্তরের নদী গাছ অরণ্যের কোটরে লেগে আছে জন্মদাগ। লেগে আছে তিস্তা নামক মায়ার কাঁথাস্টিচ। যেবার বর্ষায় বেশি বৃষ্টি হত, ভূগোল না-জানা আমাদের পড়শি-পরিজন বন্যার আভাস খুঁজত আকাশে-তিস্তায়। যে বার বর্ষা এলেও বৃষ্টি আসত অনেক পরে, “আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে” গায়নের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাথায় কুলো, কাঁখে কলসি নিয়ে বৃষ্টিদেবীর অভিমান ভাঙাত। কলসি ভরে উঠত সাত বাড়ির বারোয়ারি জলে…।

তিন চারদিন টানা বৃষ্টিতে জেলায় জেলায় নদী আছড়ে পড়েছে গৃহস্থালিতে। ফি বছর মানুষ নতুন করে মাটির প্রলেপ দিয়েছে ভাঙা-নরম খুঁটিতে।

২০১৭। পনেরোই আগস্টের সকাল। পতাকা আর মেঘের ব্যবধান কিঞ্চিৎমাত্র। পাড়ায় পাড়ায় সতর্কবার্তা, “বন্যার উপক্রম, যে যার নিরাপদ জায়গায় চলে যান।” কিন্তু বাঁধের আগল ভাঙলে নিরাপদের সংখ্যা মুছে যেতে থাকে। স্বাধীনতা দিবসের দুপুরে ভাঙল সে আগল। জল, আলো, খাদ্য পানীয়, সহায়সম্বলহীন মানুষ মাথায় কাঁধে করে গেরস্থালি গুছিয়ে ঠাঁই নিল দোতলা বাড়ির ছাদে, উঁচু রাস্তায়, স্কুলবাড়িতে, আধ-ভাঙা ব্রিজে। ত্রিপলের তলায় শুরু হল নতুন জীবনের অধিবাস। যারা পারল না, আশ্রয় নিল গাছে। যেভাবে দিনরাতগুলো কাটল, সে সারাংশ লেখার যোগ্যতা আমার কলমের হয়নি।

সাতদিন অসুস্থ মা-বাবা নিয়ে আলো, জল, স্নানহীন কেটেছে ছাদের খোলা আকাশের কাছে৷ তবুও তো ছাদ ছিল, যাদের ছিল না৷ তাদের কেউ কেউ মাটির হাঁড়িতে ভাসিয়েছে এ যুগের নবী বা দ্বৈপায়নকে।

“বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে…”

পাহাড়-ঝরনা-চা বাগানহীন আমার রায়গঞ্জে নেই-এর তালিকা যথেষ্ট। বন্যা সে নেইকে গাঢ় করে দিয়েছে প্রতিবার। দিয়েছে মানুষের পাশে মানুষের বলিষ্ঠ দাঁড়ানোর ইচ্ছে, দিয়েছে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে বাড়ানো হাতটাকে কতটা বিস্তৃত করা যায় তার প্র‍্যাক্টিস। যার ঘরে চারটে পেঁয়াজ, ছটা আলু বেশি রয়েছে, এ বন্যা তা ভাগ করে নিতে শিখিয়েছে। যে গৃহবধূর মুখ দেখেনি এ পাড়া, ছন্নছাড়া বন্যা সুযোগ করে দিয়েছে সেই বধূর আলোকিত মুখ দেখার। মানুষ, কেবল মানুষ নিজের সবটুকু নিয়ে ভেলা ভাসিয়েছে সেই দুর্যোগে, যেখানে চিত্রকর কান্না ছাড়া অন্য কোনও রঙ ছুঁয়ে দেখবে না।

বাদলার মা তিনদিন আসেনি। গড়ফা ২০-র মেসবাড়িতে মুড়ি চানাচুর চিপসে অভ্যস্ত হচ্ছে আঠারো-উনিশেরা। গোটানো জিনসে জলছাপ এল মহানগরে। বাদলার মা, কালিদিদি এল না। ফুটো চাল ধোওয়া জলে ভিজে গেছে কাঁথা। ভেজা জামা গায়ে কালিদির ছয় মাসের নাতনি কোন অজানা জ্বরে পড়ল, উঠল না আর….। সকাল সাতটার রেডিও মির্চিতে, ‘মনসুন স্পেশাল’ কথা বলে আধো ঘুমের কাছে। বেলাশেষে ভিক্টোরিয়ায় সবুজ ছোঁব বলে গুছিয়ে রেখেছি জঙ্গল প্রিন্ট স্কার্ট-টপ। বৃষ্টির রুমঝুমে মিশে যায় কালিদির নাতনির মৃত্যু, সারা শরীরে ঘামাচি নিয়ে বেশি বেশি বৃষ্টিস্নানে অটোকাকুর শান্তির হারমোনি। সদ্য প্রেমিক মেসেজ পাঠায় “থাকবে না গাড়িঘোড়া কিছুতেই/দোকানপাট সব বন্ধ/শুধু তোমার আমার হৃদয়ে/ভেজা মাটির সোঁদাগন্ধ…একদিন….বৃষ্টিতে একদিন…”।

“আমি তখন ছিলেম মগন, গহন ঘুমের ঘোরে, যখন বৃষ্টি নামল….”। বাঘা যতীনের দোতলার ঘরে “রবীন্দ্রনাথ একাই ভেজেন/আমাকে ভেজান”। পীযূষকান্তি এমনই এক ঘোর। সেদিন জুলাই। সেদিন ম্যাজিক রিয়ালিজমের জন্মদিন। ঘরে টেপ রেকর্ডারে যখন ‘বৃষ্টি নামল’ বাজছিল, আচমকা বৃষ্টি এল গন্ধরাজের গাছের ডগায়। তানসেন প্রকৃতিকে ছুঁয়েছিলেন, পীযূষকান্তিও ছুঁতে পারেন। এ “জানা আমার ফুরোবে না”।

বর্ষার বুকপকেটে যে ক্যাসেটগুলো রাখা, মেঘ তার মালিক। ‘ঘোর ঘনঘটায়’ ‘কুঞ্জপথে সখী ক্যায়সে যাওব’– বর্ষায় ভানুসিংহ কলম ধুয়েছিলেন, ধুয়ে গেছে নৌকোর গলুইয়ে ফেলা মাছের আঁশ, আধখাওয়া শুকনো লঙ্কার হাবিজাবি। ঘরকন্না করছে বেলাফন্টের, ‘The Banana Boat Song’-এর পাশে ঘরোয়া সারি গান। “তুমি হইয়ো চন্দর বন্ধু আমি গাঙের পানি”। প্রবল ধারায় ভেসে যাচ্ছে এ নামগান, আজানের সুরে বিষাদের পরত। আমার বন্ধুর বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর আমার বন্ধুর মা বর্ষাকালে আর খিচুড়ি রাঁধে না। সেদিন বর্ষা ছিল বলে অদ্রীশদার বডি মুড়ে রাখা হয়েছিল সবুজ পলিথিনে৷ আমরা দূর থেকে তাকিয়েছি। দেখিনি কিছুই।

মেসি, লুকাকু, নেইমার নেই। স্কুলবাড়ির লাগোয়া মাঠে জলকাদায় শুরু হয়েছে জার্সিহীন বিশ্বকাপ। বল যতটা পা ছুঁতে পারছে, তার চেয়ে বেশি ছুঁয়ে যাচ্ছে হাফ প্যান্ট পরা পরস্পর। রাতজাগা চোখ নেই, উত্তেজনা নেই, আছে বর্ষার আঁকা মাঠে নেমে আসা ভুবনগ্রামের স্কেচ। সাদা স্কুল ড্রেসে ববিপ্রিন্ট তুলে স্কুল ফেরত দিনগুলো মনে পড়ে। অভিমান করে জলের ট্যাঙ্কের নিচে লুকিয়ে থাকা বর্ষা, কেবল আমার মধ্যে বাঁচে না। এ সারল্য সর্বজনীন, এখন বৃষ্টি এলে এক্সট্রা ক্লাস নিতে ইচ্ছে করে। একটা গাছের নিচে দাঁড়ালে নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। ডুয়ার্সের ফরেস্টের বড় পাতার কোণ থেকে খসে পড়া জল মাথা ভেজালে মনে হয়, এ প্রাপ্তি কেবল আমার। কালিম্পং-এর ছোট জনপদগুলোতে বর্ষার ‘আনকমন’ ডিপ্রেসন শব্দকে পাত্তা দেয়নি কোনওকালে।

গান, অভিমান নিয়ে নাড়াচাড়া শেষে চাল দিয়ে জল পড়ার ছবি দেখছে পুরনো পাড়া। ভিডিওতে ‘সিলসিলা’র সিন৷ টিউশন থেকে বাড়ির রাস্তায় চর্যাপদ রাখা আছে। মন খারাপের অনুবাদ অপছন্দকে বাদ দিচ্ছে।

বর্ষা এলে এখন কিছু মনে হয় না। কেবল টের পাই……।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...