ব্যক্তিগত বর্ষাদিন

আহমেদ খান হীরক

 

কবি নির্মলেন্দু গুণ কোথাও যেন এমন একটা কথা বলেছিলেন— বলেছিলেন যে গ্রামের ছেলে যে শহরে চলে আসে সে সৌভাগ্যবান। কারণ তার গ্রাম ও শহর দুটোই দেখা হয়। কবির এই সূত্র ধরলে আমি সৌভাগ্যবান বটে! গ্রামে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা– কৈশোর আর তারুণ্যের মিলমিশ গ্রাম। আর তারপর শহরে, এই একেবারে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় চলে আসা। আমি বলতেই পারি গ্রাম আমি ছুঁয়েছি, আর শহর আমি দেখেছি। গ্রামের বর্ষায় আমি যেমন মুখরিত হয়েছি, তেমনি শহরের বর্ষাকেও আলিঙ্গন করেছি। আমার ব্যক্তিগত বর্ষা তাই গ্রাম আর শহরে দ্বিখণ্ডিত। এই দ্বিখণ্ডিত বর্ষার সৌন্দর্য যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কদর্য রূপও! ঘোর বর্ষাপ্রেমী নিশ্চয় এ কথা শুনে রাগ করতে পারেন; কিন্তু বর্ষা নিয়ে আমার উভয় মনোভাবই তীব্র!

প্রথমেই কি গ্রামের কথা বলে নেয়া উচিত? মানুষ সুখের কথাই আগে স্মরণ করতে চায়। আমি তাই সুযোগ পেলেই পুনর্ভবার তীর ধরে দৌড়ে বেড়াবার স্মৃতি আওড়াই। অথচ বর্ষায় পুনর্ভবার তীরই বা আর কই? রবিবাবুর আমাদের ছোট নদীর মতো পুনর্ভবায় যদিও গ্রীষ্মকালে হাঁটু পানি থাকে, তবে বর্ষায় তাতে পার হয়ে যায় গরু পার হয়ে যায় গাড়ির কথা ভাবাও যায় না। বর্ষায় পুনর্ভবা পাশের বাড়ির নতুন বৌয়ের মতো যৌবনবতী। সৌন্দর্য তার কূলে-কিনারে আথালি-পাথালি হয়ে যাকে বলে বিছড়ায়ে থাকে। আমি, পুনর্ভবার প্রেমিক, রোজ তার কাছে গিয়ে ম্লান হয়ে বসে থাকি।

গ্রামের বর্ষা মানে আমার কাছে তাই পুনর্ভবার রূপ। পুনর্ভবার ফুঁসে ওঠা– কূল ঝাপিয়ে মান হারানোর দান। গ্রামের বর্ষা আমার মাথায় একটা মসৃণ টানেল। তার ভেতর গুমমমমম শব্দে দম আটকানো পুনর্ভবার বয়ে চলা। তাতে সবুজ আরও সবুজ হয়ে ওঠে। আকাশ আরও নেমে আসে নিচে। ভেজা পায়ে আটকে থাকা বাঁশপাতার মতো মায়া ছুঁয়ে থাকে স্মৃতির তীব্র শরীরে।

ঢাকার বর্ষাটা একটা অস্বস্তি। একটা পেইন। একটা যন্ত্রণা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন একটা শহর চিনতে নাকি সেই শহরের কাঁচা বাজার আর লাইব্রেরিকে দেখতে হয়। আমি বলি একটা শহর চিনতে সেই শহরের বর্ষাকে দেখতে হয়। বর্ষার মতো এক অনাবিল সৌন্দর্য যে শহর ধারণ করতে পারে, সেই শহরই বাসের উপযুক্ত। কিন্তু আমরা তো সবাই জানি ঢাকা শহর মানুষের উপযুক্ততা অনেক আগেই হারিয়েছে। এ শহরে বর্ষা অভিশাপের মতো আসে… বৃষ্টি গ্লানি হয়ে পড়ে! শহর উপচে নোংরা পানি জমে থাকে। মানুষ সে সবের ভেতর দিয়ে, যেন তারা প্লাবিত, দিনবাহিত করে। বর্ষায় ঢাকা এক অবরুদ্ধ শহর। মেঘ দেখলে ঢাকার মানুষ এখন বোধহয় আতঙ্ক বোধই করে– অন্তত আমি তো করিই। কারণ বৃষ্টি ঝরলেই একদিকে যেমন রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে… তেমনি দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়া চাইবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলো।

বর্ষা আমাদের কাছে তাই আর সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হতে পারে না। বর্ষার মতো, বৃষ্টির মতো এক আনন্দকে বিস্ময়কর নিরানন্দে ভরিয়ে দেয়ার জন্য ঢাকাকে আমরা অভিশপ্ত নগরী বলতে পারি। অথচ এখানেও, বর্ষা হলে, গাছগুলো সবুজ হয়ে ওঠে, কদমগুলো ফুটে নিজেদের মেলে ধরে, আর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করি তরুণ-তরুণীরা, কিশোর-কিশোরীরা, বালক-বালিকারা, আকাশের দিকে তাকিয়ে, কপালে বৃষ্টির স্পর্শ নিতে নিতে এখনও হেসে ওঠে।

বর্ষা, নরকেও, মানুষকে হাসাতে পারে– বর্ষার এই বিস্ময়!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...