অলোকপর্ণা
মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলেই সে চোখ বুজে নেয়। একটানা বৃষ্টির আওয়াজ সাদাকালো টিভির ঝিরঝিরের থেকে কোনওখানেই আলাদা নয়। ভাবে একপা একপা করে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নেমে গেলে বেশ টিভির ঝিরঝিরের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়। মনে মনে আশরীর ভিজে গেলে হয়রান লাগে। এত আর্দ্রতা সহ্য হয় না কারও। মানুষ, কুকুর, বিড়াল বা পাখি কারওই না। শুধু গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্যোপায়। আর কাকতাড়ুয়া। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলেও সে মনে মনে বহুক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে দেখলে তাকে এইমুহূর্তে এক অনাবিল কাকতাড়ুয়া বলে মনে হতে পারে।
একবার ছোটবেলায় খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মধ্যে সে আর বাবা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ আকাশ থেকে পারদ বৃষ্টি নেমে এল, বা বৃষ্টির মতো কিছু একটা। আশেপাশের সবাই ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করেছে, সে দেখে বাবা তার মাথায় ছাতা খুলে দিচ্ছে। ছাতা হাতে সে এগিয়ে যাচ্ছে মারকাটারি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। বৃষ্টিটা একে একে গিলে ফেলছে রাস্তা ঘাট, বাড়ি ঘর, গাছ পালা, মানুষ জন। ডুবে যেতে যেতে বাবা পাশ থেকে বলছে, “অপেক্ষা করিস, রামধনুটার জন্য।” বাবাকেও গিলে ফেলল একসময় আকাশ থেকে নেমে আসা চকচকে পারদ কণাগুলো। ছাতা হাতে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশে পাশে কেউ নেই। শুধু চকচকে পারদে ঢেকে আছে। সে ধীরে ধীরে ছাতা বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। উপর থেকে মুশলধারে পারদ কণা নেমে আসছে তার উপর। মনে পড়ল পাশের বাড়ির মিমি বলেছিল, “পারদ বিষ। চামড়ায় নিতে নেই।” ঘুম ভেঙে গেল। পরে সে জেনেছে মানুষ কখনও স্বপ্নে মরে না। মরার ঠিক আগে জেগে যায়।
What is the purpose of Rainbow?
রামধনু তৈরি করে কী বোঝানো হয়? পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর জিনিসের তাৎপর্য ভাবায় তাকে। সে অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজে। রামধনু, ইন্দ্রতুলক, বুদবুদ, পাখির পালক। কেন এগুলো তাকে আরাম দেয়, কী উদ্দেশ্যে? ভ্রূ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের চোখে সে রামধনু দেখে। কেন মুষলধারে বৃষ্টির পর এমন আকাশ ভরা রামধনু উঠবে। কেন সবসময় কিছুর বিনিময়ে কিছু। এমনি এমনি কেন নয়। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। টুটুদাদার কথা মনে পড়ে আজকাল প্রায়ই। স্কলার টুটুদাদা দারুণ চাকরিসহ একা একটা শহরে থাকতে চলে গেছিল। বহু বছর পর সে জানতে পেরেছিল টুটুদাদার স্কলার বন্ধুদের টুটুদাদা কিসব মেইল পাঠায়, সকালে বিকেলে রাতে। সময় অসময়ে। অশালীন অর্থহীন ইমেইল আসে টুটুদাদার থেকে। সবাই বলল “স্কিযোফ্রেনিয়া।” একটা দুটো ইমেইল সেও দেখেছিল। আর ভয় পেয়েছিল। কারণ মেইলগুলোর প্রতিটা লাইন সে বুঝতে পেরেছিল। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা দাঁড়ি-কমা-প্রশ্নচিহ্ন। পড়তে পড়তে ছোটবেলার স্বপ্নের কথা মনে পড়েছিল তার। ঝিরঝির শব্দে আকাশ থেকে সর্বগ্রাসী পারদ নেমে আসছে… জেগে থাকলে মানুষ মৃত্যুর আগে আর নতুন করে জেগে উঠতে পারবে না। একথা বুঝতে পেরে তার সারা গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেছিল। খুব ইচ্ছে হয়েছে টুটুদাদার সাথে রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে জিজ্ঞেস করবে, “Is it ok to be insane?”
কিন্তু দেখা হয়নি তাদের। কিসের বিনিময়ে দেখা হতে পারে সে ভাবে, ভাবতে ভাবতে টিভির রিমোট দিয়ে চ্যানেল বদলে যায়। আজকাল আর টিভিতে ঝিরঝির দেখা যায় না। অকারণ নয়েজের বদলে নীল বা কালো পর্দা সাজিয়ে রাখা থাকে। রাতের পর রাত চ্যানেলের পর চ্যানেল বদলে সে ঝিরঝির খোঁজে। আর ভাবে একদিন সেই স্বপ্নটা আবার দেখবে। আর এবার ছাতার তলায় বাবাকে ঢুকিয়ে নিতে সে ভুলবে না, ভুল করবে না।