আই রিয়েলি ডোন্ট মাইন্ড দ্য রেইন…

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

বৃষ্টি নিয়ে আমার সেভাবে কিছু বলার নেই। আসলে, বৃষ্টি আমি দেখিনি কখনও। আমাদের বনেদি বাড়িতে একধরনের বৃষ্টি পড়ত। আমার তখন হেমন্ত। আমার তখন শাপমোচন। ঝড় উঠলেই-– সাতমহলার স্বপ্নপুরী। আমার বেসুরো গলায় উসকোখুসকো ম্যাটিনি আইডল। তারপরে কেন জানি না সেই ঝড় থেকে বৃষ্টি এলেই সব উৎসাহ মিইয়ে যেত। আমি ঘরে ঢুকে যেতাম। দাদুর কাছে মায়াবী অক্ষরে অঙ্কের বই খোলার সময়ে কানে রেশ থাকত না। বাইরে একটা কিছু হত, জাস্ট ‘একটা কিছু’। বৃষ্টিকে তখন কী নামে ডাকতাম মনে নেই। তবে তা আর যাই হোক বৃষ্টি নয়। ছাদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে সম্ভবত সেই বৃষ্টি পড়ত উঠোনে। আর সেই চুঁইয়ে পড়া জল দেয়ালগুলোকে পলকা করে দিল হয়ত। যৌথতায় স্বপ্ন থাকতে পারে। দায় থাকে না। এখন যে খসে যাওয়া দাগগুলো দেখি বৃষ্টি সেগুলোকে স্থায়ী করে দিল। কী নামে ডাকতাম মনে নেই, তবে বৃষ্টি আলাদা করে কোনও রোমান্টিসিজম শেখায়নি আমাকে। শিখিয়েছিল মেয়েটা। ডিডি ওয়ান। দুপুর বারোটার দিকে। ‘অউরত’ চলছে। সিরিয়াল। বুঝতাম না। শুধু দেখতাম। অদিতি বলে একটা মেয়ে। অবিকল আমার নারীর মতো দেখতে। কাঠির মতো রোগা। চুল, কণ্ঠ, তাকানো হ্যালুশিনেটিং। বৃষ্টি। সাইকেল করে যখন আসত, আমার টিউশনি দেওয়ালে আলোর সরীসৃপ ঝাঁপ দিতে চাইত। সামনে বেয়াক্কেলে পৃথিবী। পোকা। ওদের সঙ্গে আগুন নিয়ে খেলব খেলব করেও যখন আর খেলা হল না, মেয়েটি বাবার চাকরির দৌলতে উত্তরবঙ্গে। বৃষ্টিফেরত সাইকেলফেরত স্মৃতিফেরত সেই নারী একটার পর একটা সোনু নিগম শুনত। ওরম হয় সবার। বন্ধুরা বলত। হয়ত…। খটকা লেগেছিল। দাদু চলে যাওয়ার পর যখন টিউশন গেলাম, পড়ার ফাঁকে চুল এলিয়ে এতবার করে দেখছিল কেন? চোখ পড়তেই সরিয়ে নিল। মেধা তালিকার প্রথমদিকে থাকতাম না। সেভাবে দরকারও পড়ত না। তবু, একটু কপিটা দেবে বলে হপ্তায় একবার করে বেছে বেছে সেই আমার খাতাটাই চাইত কেন? উত্তর নেই। আর তাছাড়া, থাকলেও, বৃষ্টির সেই উত্তর দেওয়ার দায় নেই। সেই মেয়ে গেছে। সেই দিন গেছে। তারপর থেকে অনেকদিন অব্দি বৃষ্টিকে আমি সোনু নিগম বলে ডাকতাম। সোনু নিগম। গান। বর্ষা। বন্ধুর প্রেমিকা। আলাপ করাবি না? নাহ…। বলে সেই সিগনেচার হাসিটা। ঠিক প্রিয় বন্ধু না। তবু, স্মৃতিতে, কথায়, গল্পে, গানে, ক্রিকেটে, কুইজে ওর পাশেই আমার সিট। প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করায়নি। বৃষ্টি কেমন লাগত ওর? কোনওদিন সেসব কথাবার্তায় আসেনি। ওসব এসেছে অঞ্জনের গানে, বিঘ্নিত ক্রিকেট ম্যাচে আর আমাদের এক কমন বন্ধুর বাড়ির এক মায়াবী লনে। যেদিন বৃষ্টি হত খেলা হত না। যেদিন বৃষ্টি হত, টিভিতেও বাতিল ওয়ানডে। বৃষ্টি বুঝত না, ওইসব একদিনের ম্যাচ আমাদের মুক্তি ছিল। আমাদের শেন ওয়ার্ন ছিল না। আমাদের কিছু সাধারণ বেঙ্কটপতি রাজু ছিল। সুনীল যোশী ছিল। ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজ ছিল। বৃষ্টির জন্য ম্যাচ না হলে আমাদের ফ্যান্টাসিগুলো বন্ধ হয়ে যেত। আমরা উড়তে পারতাম না। মফঃস্বলে বৃষ্টি পড়লে আমাদের ছোট্ট লনটায় হাত ঘোরানোর ম্যাচ হত না। সাইকেল করে একটার পর একটা চেনা মুখ এসে বলত না, তাড়াতাড়ি টস কর। বৃষ্টি এসব বুঝত না কোনওদিনই। বন্ধুদের ডুবে যাওয়ার দিনে বৃষ্টি চুপচাপ তোলপাড় করা কোপাই দেখত। তার অনেক বছর পর স্মৃতি রিপিট টেলিকাস্ট করলেও বৃষ্টি আগের মতো ওরম করেনি আর। কারণ, সব বন্ধুর মৃত্যুদিনে বৃষ্টিকে আসতেই হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। কৈশোর, যৌবন। বৃষ্টিকে আমি স্বপ্নভঙ্গ নামে ডেকেছি। স্যাক্সোফোন আর গিটারে অঞ্জন দত্তের মতো যার মুখ। ‘কথা দিয়ে কথাটা না রাখা, ফেলে আসা চেনা চেনা ব্যথা’। বন্ধু হতেই পারত। কিন্তু হয়নি। ভাবি না আর। আর তাছাড়া, জানি যে বৃষ্টির রং হয়ে যাবে নীল। আর আকাশের রংটা ছাই। আকাশের রং। সন্ধে বাড়লে, রাত বাড়লে দেখা যায় না। আমি দেখি। কালো আকাশে আমি গন্ধ পাই। বৃষ্টি আসার। তার সঙ্গে হেঁটেছিলাম অনেক আগে। বৃষ্টি শুরু হবার পর আর না। পরদিন পরীক্ষা ছিল যে। সেই না হাঁটা আমাদের আর বাড়তে দেয়নি। আমরা যারা সম্পর্ক থেকে একদিন সত্যিতে আসি, যাদের বৃষ্টিতে হাঁটার কথা থাকে অথচ হাঁটা হয়ে ওঠে না, তাদের অনেকের গল্পটাই একইরকম। জাস্ট কিছু হয় না। অথচ অনেক কিছুই হতে পারত। চুলের মধ্যে ঢুকে বৃষ্টিকে বোঝা যেতে পারত। সত্যি করেই বৃষ্টি চোখের জল ভুলিয়ে দেয়, নাকি সবই কাব্যি করে বলা, সেসবই হাতেনাতে পরীক্ষা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু, হল না। আমি অঞ্জন দত্ত কিংবা গ্লেন ক্যাম্পবেল শুনতে শুনতে একদিন অনেকটা বড় হয়ে গেলাম। বুঝলাম, বৃষ্টি হলে ঘরে জল আসার ভয় হয়। বুঝলাম, হাসতে হয়। প্রচণ্ড হাসতে হয়। কারণ, আ স্মাইল ক্যান হাইড অল দ্য পেইন। গানের কথা না, সিরিয়াসলিই আই রিয়েলি ডোন্ট মাইন্ড দ্য রেইন। গানের ভেতর। গানের অনেক ভেতর….। সত্যি সত্যি বৃষ্টি আসত কিনা জানি না। তবে, আমি বৃষ্টিকে রচনা করতে পেরেছিলাম। আমাদের মফঃস্বলে রুক্ষতা রুটিনমাফিক আসত। লোডশেডিঙের মতো। এর মাঝেই কান্ট্রি, আমার কান্ট্রি। বি জে টমাস। রেইনড্রপ্স কিপ ফলিং অন মাই হেড। অন্ধ গায়ক জো ফেলিসিয়ানো। লিসেন টু দ্য ফলিং রেইন লিসন টু দ্য রেইন। জন ডেনভার। লাইক আ স্টরম ইন দ্য ডেসার্ট, লাইক আ ওয়াক ইন দ্য রেইন। কিংবা গ্লেন ক্যাম্পবেল। রাইন্সটোন কাউবয়। যার কথা এই এক্ষুনি বললাম। আমি বৃষ্টি দেখিনি কখনও। গানে, শুধু গানের ভেতর দিয়ে যাকে শুধু বুঝেছি কখনও সখনও।

এসব মেমরি লেন আমায় একসময় বয়স্ক করে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে। মেঘমল্লার। শ্রীজাত। ওইসব টুপি পড়া ঘোড়ার ওপর ওঠা ফর্সা লোকগুলো। রাজনীতি না, গানের আমেরিকা। রেডিও। বয়ঃসন্ধির সুমন, অঞ্জন, নচি। ক্লুলেস, নিরুত্তর রাতে ‘…তোমার অভিসার’। বড্ড কাছের রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলা। আমাদের ঘরবাড়ি। এসব একটা সময়ে মনে পড়ে না। বৃষ্টি বললেই এককামরার ফ্ল্যাটে শাটার দেওয়া জানলার নীচে লখিন্দরের সাপের মতো বৃষ্টির জল। বৃষ্টির। বিষ-তীর। সত্যি করা শ্রীজাত। তিন চার মাস। পুজোর ঠিক আগে অব্দি। জমা জল। মশা। কয়েকটা খারাপ অসুখ। নাম করতে নেই। গ্রামবাংলায় রাতের লতার মতো। তখনকার মফঃস্বলে স্বামীর নামের মতো। নাম করলেই নিশির ডাক। ধরে ফেলবে। হিসেবের গোলমাল। সরকারি নথি। পুরসভা। ব্লিচিং। যুব বিশ্বকাপ। আমাদের ঘরে বাচ্চা ছেলে মেয়ে। খেলা। খেলা বন্ধ। ভয়। ভয়। ভয়। শুধু ভয় করে। আর কিছু কথা আসে না।

ওই যে বললাম, আই রিয়েলি ডোন্ট মাইন্ড দ্য রেইন…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...