পাচার-বিরোধী বিল : যুক্তিহীন বিতর্ক

অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ততদিনে ওই অষ্টাদশীর লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস হয়ে গেছে। কীভাবে শাড়ির আঁচলটা আলতো ছুঁইয়ে রেখে বুকের ভাঁজটা দৃশ্যমান করে তোলা যায়। কেমন করে ঠোঁটের মধ্যে কামনা রস জাগিয়ে তুলে খদ্দের ধরতে হয়। এটাই এখন তাঁর পেশা। তাই পেশার ধর্ম তো মানতেই হবে।

অথচ, এই মেয়েটির চোখে একদিন রংধনু খেলত। কখনও আকাশে ওড়ার, কখনও সংসার বাঁধার, কখনও বা সবাইকে ছাপিয়ে সেরা হওয়ার।

সে অবশ্য সেরাই হয়েছে। এই লাইনে তাঁর এখন খুব কদর। সবাই এসে, ধরা যাক এই বিজলিরই খোঁজ করে। কারণ সে যে চমকায়।

এমন বিজলিরা জি বি রোড, সোনাগাছি, কামাথিপুরা— সব জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাঁদের আমরা দেহোপজীবিনী বলে জানি। এর একটা সংজ্ঞাও রয়েছে— তাঁরা স্বেচ্ছায় এই পেশায় এসেছেন ও সেখানে কোনও জবরদস্তি নেই।

এ কথা ঠিক সত্যিই এই পেশায় এমন বহু মহিলা আছেন যাঁরা বাধ্য হয়ে নিজে থেকে এই পেশা বেছে নিয়েছিলেন। কারণ যাই-ই হোক না কেন।

কিন্তু বিজলির মতো যাঁরা এ সব জায়গায় আছেন, তাঁদের কী হবে? তাঁরা কোন পর্যায় পড়বেন— স্বেচ্ছা না পাচার? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর বোধহয় নেই। কারণ বিজলি বলেন, ‘কোথায় যাব বলুন তো? নষ্ট মেয়ে তো আমি। আরে এই বেশ আছি। ভালো কামাই হয়।’

ওঁর কথায় কোনও ভুল নেই। আমাদের সমাজটা এমনই। যেদিকে আঙুল ওঠার কথা, ঠিক তার উল্টোদিকে ওঠে। বয়ে চলে এক অদ্ভুত প্রবাহ-ধারা।

তাই স্বেচ্ছা-পাচারের এক অদ্ভুত সংযোগে বেঁচে থাকেন বিজলিরা।

সে জন্যই বোধহয় পাচার-বিরোধী বিল নিয়ে শুরু হয় এক অপ্রাসঙ্গিক লড়াই। যেখানে যৌনকর্মীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে সরব হয় বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। অন্যদিকে, সুর চড়তে থাকে পাচার আন্দোলনের কর্মীদেরও। মন্ত্রী, সাংসদ, আধিকারিক কারও সঙ্গে দেখা করতে বাকি থাকে না দুই প্রতিপক্ষের। অবশেষে জয় হয় পাচার-বিরোধী কর্মীদেরই। গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুলাই ২০১৮) লোকসভায় আলোচনার পরে সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়ে যায় এই ঐতিহাসিক বিল। রাজ্যসভায় তা নির্বিঘ্নে পাশ হলেই, এটি আইনে পরিণত হবে।

তবে তাতে বিরোধ কমবে না। কারণ যে বিষয়গুলি নিয়ে বিল-বিরোধী সংগঠন ও ব্যক্তিরা আপত্তি তুলেছিলেন, তার কোনওটাই এখনও পর্যন্ত বদল করা হয়নি।

বিরোধের প্রথম ক্ষেত্রটিই হল যৌনকর্মীরা, যাঁরা স্বেচ্ছায় এই পেশায় এসেছেন, তাঁদের এতে রুজি-রুটির ক্ষতি হবে। কারণ এই বিলে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়ে, যাদের জোর করে যৌনপেশায় নামানো হয় তাঁদের সঙ্গে ইচ্ছুক যৌনকর্মীদের কোনও ফারাক করা হয়নি। এটা সরকার করতে পারে না।

এই দাবিতে তেমন কোনও সারবত্তা নেই বলেই ধরে নেওয়া যায়। আপাতত আপত্তি যেখানে উঠেছে তা হল,  নিগৃহীতার যৌনবৃত্তিতে সম্মতি ছিল কি না, তা অবান্তর। কারণ, তাঁকে যৌন শোষণ করা হয়েছে। সেটা অপরাধ।

এ ক্ষেত্রে বিতর্কের জায়গা হল, পাচার হওয়া মেয়ে ও যৌনকর্মীদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে ফারাক থাকবে না। যৌনকর্মীদের স্বীকারোক্তিকে পাত্তা না দিয়ে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে। এভাবে তাঁদের পেশাই উঠিয়ে দেওয়া হবে।

সামান্য কিছু ক্ষেত্রে পাচার ও পেশার মধ্যে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, তার জন্য কখনওই এই প্রভিশনের বিরোধিতা করা যায় না। কারণ, বহু সময়েই পুলিশ ও পাচারকারীর আইনজীবীরা দাবি করেন, নিগৃহীতা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন পাচারকারীর সঙ্গে, অথচ যা সত্যি নয়। নয় কাজের লোভ দেখিয়ে, প্রেমে ফাঁসিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে যৌনপল্লিতে। কাজেই আদালতে সর্বদাই প্রমাণের চেষ্টা করা হয়, মেয়েটি নিজের ইচ্ছায় গেছে। এখান থেকেই শুরু হয় নিগৃহীতার চরিত্রহননের চেষ্টা, তাঁকে সামাজিকভাবে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা। একাধিক নিগৃহীতা জানিয়েছেন, মাসির ভয়ে, পুলিশকে সত্যি কথা না বলে তারা বলে, তারা স্বেচ্ছায় এই পেশায় এসেছে ও সাবালক। তাই, আইনে এই সংস্থান থাকলে তা পাচারকারীদের ধরতে সহায়তাই করবে।

কিন্তু এতে যৌন-পেশায় থাকা কর্মীদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। কারণ, সাবালক কেউ যদি স্বেচ্ছায় যৌনকর্মী হন, তাঁদের রক্ষা করার জন্য আলাদা আইন এদেশেই আছে।

একটা দিক দেখতে গিয়ে ও কিছু অমূলক ভয় থেকে, পাচার হওয়া মেয়েদের আইনি দিকটা সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়।

পাশাপাশি অন্য আরেকটা কথাও প্রকটভাবে উঠে এসেছে। তা হল, এর ফলে যৌনকর্মীদের অকারণ হেনস্থা করা হবে। তাঁদের জোর করে পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। তা যদি ভুলক্রমে করা হলেও, আইনে যেহেতু শুধুই পাচারের কথা বলা আছে, তাই স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসা মহিলাদের ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ থাকছেই।

এ বার প্রশ্ন হল, বিজলিরা কি এর ফলে কোনও সুবিধা পাবেন? এখানে একটা সামান্য ধোঁয়াশা রয়েছে। উত্তরটা একই সঙ্গে হ্যাঁ ও না। বহু সময়েই মাসিদের ধমকানি, নানা ভয় দেখানোর ফলে অনেক মেয়েই বলে, তারা স্বেচ্ছায় এসেছে এই পেশায়। তাও অনেকে পালিয়ে বাঁচেন। নিদেনপক্ষে চেষ্টা করেন।

এই আইন তাঁদের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। অর্থাৎ যাঁরা জাঁতাকলে আটকে পড়ে এখন নিরুপায়। তাঁদের কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে, পারবেন।

যা এতদিন পর্যন্ত কোনও আইনে ছিল না।

পাচার ও যৌনপেশা সমার্থক হয়ে পড়েছিল। তার ফলে দুটো ক্ষেত্রকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

এই প্রথম পাচার সংক্রান্ত কোনও বিলে, সোর্স থেকে ডেস্টিনেশন– প্রতি ক্ষেত্রে অভিযুক্তের শাস্তির বিধান আছে। উদ্ধার হওয়া মেয়েটিকে নিয়ে হানা দিয়ে অভিযুক্তকে ধরার কথা বলা হয়েছে। যে কারণে প্রথমেই পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার না করে, নজরদারি করবে। তারপর এক দিন উদ্ধার করে তাকে সঙ্গে নিয়ে রেড করবে। বিল-বিরোধীদের মনে হয়েছে, এটা আদতে নিগৃহীতাকে harass করা হবে কিন্তু পাচারকারী বহাল তবিয়তে থাকবে।

আর স্বেচ্ছায় যৌনকর্মী হওয়া মহিলাদের উপর এজন্য অত্যাচার বাড়বে। তাঁরা নিরাপদ থাকবেন না। পুলিশের ভয়ে কাজ করাই দায় হবে।

এমনিতেই অভিযোগকারী যিনি, যে কোনও কাজেই পুলিশকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য। তাই এই যুক্তি টেকে না। আর যৌনকর্মীদের কেন পুলিশ পাচারকারীকে চেনানোর জন্য তুলে নেবে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার যো নেই, বহু পাচার হওয়া মেয়েই আজ ‘স্বেচ্ছায়’ যৌনকর্মী।

তা হলে কেন এত আপত্তি একটি লবির? কেন নানা অজুহাতে বিলটিকে তাঁরা স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাতে চান? যে কমিটিতে গেলে আগামী অন্তত এক বছরে এই বিল পাশ হবে না। সম্ভবত বিলটি বাতিল হয়ে যাবে ও তা ফের আনতে হবে। যদিও লোকসভায় পাশ হওয়ায় কিঞ্চিৎ আশা এখনও আছে।

এখানে একটা প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী। এই আইন এলে কি আসলে যৌনপল্লীর মালিকদের স্বার্থে আঘাত লাগবে, তাই এই হট্টগোল?

একাধিক তথ্য বলছে, পাচার এখনও অধিকাংশই হয় যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়ার জন্য। কাজেই মাসি ও তাঁর মালিকদের সঙ্গে পাচারকারী, দালাল ও আড়কাঠিদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। পুলিশের কাছে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ। ‘পাচারে সাহায্যকারী’ হিসেবে এদেরও শাস্তি অনিবার্য। গ্রেপ্তার হবে। অপরাধ প্রমাণে অন্তত দুই বছরের জেল।

যৌনপল্লীর সঙ্গে পাচারের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পুলিশ থেকে আইনজীবী সকলের কাছেই আছে এই তথ্য। কীভাবে মাসিদের নির্দেশে হরমোন ইনজেকশন দিয়ে চোদ্দ বছরের কিশোরীকে ‘সাবালক’ করতে হয়, তা এখন সর্বজ্ঞাত।

সেখান থেকেই তাই এই গেল গেল রব উঠেছে। কোনও যৌনপল্লীর মালিক কি হলফ করে বলতে পারবেন, তাঁর ওখানে পাচার হয়ে আসা কেউ নেই? তাহলে রেডলাইট অঞ্চল থেকে এত মেয়ে কী করে উদ্ধার হয়?! কেনই বা তাঁদের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয় পুলিশের চোখ এড়িয়ে?

এ সব প্রশ্নের উত্তরই জানা। তাই কথার পিঠে কথা বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত নয়।

তবে শুধু যৌনকর্মীরাই নন, তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে রূপান্তরকামী অধিকার গোষ্ঠীর একাংশ। তাদের বক্তব্য, এর ফলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন!

এই বিলের একটি জায়গায় বলা হয়েছে, পাচারের জন্য যদি মারাত্মক কোনও পদক্ষেপ করা হয়, যেমন এইচআইভি সংক্রমণ করানো, হরমোন ইনজেকশন দেওয়া, তাহলে সে ক্ষেত্রে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর এতেই কিছু রূপান্তরকামীর মনে হয়েছে, তিনি ছেলে থেকে মেয়ে হতে বা মেয়ে থেকে ছেলে হতে যে হরমোন ইনজেকশন নেন, তাতে পুলিশ এসে ধরবে!

এই ভয়ও অমূলক। কারণ, বারবারই বলা হচ্ছে– ‘পাচারের উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে’। সেক্ষেত্রে যে কোনও রূপান্তরকামীকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে, তা যুক্তিহীন।

অন্য প্রসঙ্গটি, এইচআইভি সংক্রমণের। তাতেও বিলবিরোধীরা মনে করছেন, এতে নাকি এই মারণ রোগ আরও বেড়ে যাবে ও তা যৌনকর্মীদের স্বার্থের পরিপন্থী। কারণ, ওঁরা এখন সচেতন, তাই এ জন্য গ্রেপ্তারি হলে ওঁরা ভয় পাবেন ও এইচআইভি ঠেকাতে উদ্যোগ নেবেন না। তাতে সবার ক্ষতি।

এখানেও সেই একই কথা আসে। পুরোটাই পাচারের সাপেক্ষে। তা হলে যৌনকর্মীরা কেন ভীত হবেন আর কেনই বা এইডস ঠেকাতে উদ্যোগী হবেন না! এই যুক্তিরও বিশেষ সারবত্তা নেই।

বিজলিও শুনেছেন এই বিল ও তার বিতর্কের কথা। যে ৪৩০০ জন যৌনকর্মী মানেকা গান্ধীকে বিল বদলাতে বলে চিঠি লিখেছেন, তাতে বিজলি ছিলেন না।

তাই মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ‘অন্ধের আবার দিন রাত কী গো!’ চোখটা যেন ছলছল করতে দেখলাম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...