সঞ্জীব দেবলস্কর
ইংরেজিতে আছে প্রবাদটি, ‘গিভ দ্য ডগ অ্যা ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাঙ্গ হিম’। অসমের বাঙালিদের হয়েছে এই দশা। এদের পিঠে তকমা লেগেছে বিদেশি, বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশি– এরপর লাগানো হল সন্দেহজনক নাগরিক, ডি-ভোটার তকমা, বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হল, টেনে হিঁচড়ে আনা হল ডিটেনশন ক্যাম্পে (পড়ুন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে), তা সে ব্যক্তিটির বয়স পঞ্চাশ, ষাট কিংবা একশো দুই-ই হোক না কেন, বা সন্দেহজনক বিদেশি নাগরিকটি হোন না কেন একজন অন্তঃসত্তা নারী (যেমন গোয়ালপাড়া জেলের রেশমি আরা বেগম, প্রায় হাটখোলায়ই ফুটফুটে একটি সন্তানের জন্ম দিল এ হতভাগিনী, কেঁদে কেঁদে বলছিল সে মা হতে চলেছে, কেউ শোনেনি)। এত কিছু হলেও কেউ কিচ্ছুটি বলতে পারবে না, পুলিশি হাঙ্গামায় পড়তে হবে, আইনি সঙ্কটে পড়তে হবে৷ সে সঙ্গে আছে আদালতের দোহাই, নাগরিক অধিকার কর্তনের হুমকি, নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়ে রাষ্ট্রহীন হওয়ার আশঙ্কা। এই দুর্দিনে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে।
শুধুমাত্র নামের বানান বা আনুষঙ্গিক বিচ্যুতির জন্য নাগরিকত্ব বাদ পড়ে যাবে এটা জেনেও চুপ করে থাকতে হবে! সামান্য একটা তথ্য যাচাইয়ের জন্য নিরক্ষর, অর্ধ-সাক্ষর গরীবদের বরাক উপত্যকার কিন্নর ঘাট থেকে ডিব্রুগড়, করিমগঞ্জ থেকে গৌহাটি টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, প্রতিবাদ করলে দেশদ্রোহী, এনআরসি-দ্রোহিতার অভিযোগ। যে দেশে একজন দেবদেবীর থাকে অষ্টোত্তর শতনাম, সে দেশে ব্যক্তিনামে তারতম্য থাকবেই। ক্ষমতার শীর্ষে যারা আছেন এদের কি ডাক নাম, ভালো নাম নেই? এরা কীসের ভারতবাসী? আমাদের নামের মধ্যপদে থাকে- মেয়েদের বেলায়, ‘বালা’, ‘রানী’, ‘আরা’, ‘জান’– পুরুষদের বেলায় ‘কুমার’, ‘রঞ্জন’, ‘কান্তি’, ‘ভূষণ’, ‘উল্লা’, ‘আলী’ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পঞ্জিয়নকর্তার স্পর্শকাতরতা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বললে আপনি আবার ফৌজদারি মামলার আসামি। এ তো তালিবানি শাসন৷ আজ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যারা হিংসাশ্রয়ী যুদ্ধের আয়োজন করছেন, এরা কি দেখেননি তালিবানি শাসনতন্ত্র কায়েম হওয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগান জনগণই বেশি। অষ্টাদশ শতকে লিবার্টি, ফ্রেটার্নিটি, ইক্যুয়েলিটির শ্লোগান দিয়ে ফরাসি রিপাবলিক যোদ্ধারা যাকে ইচ্ছা তাকেই গিলোটিনে ফেলেছিল, অসমে কী এরই পদধ্বনি?
প্রতিদিন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের চোখের সামনে দাপাদাপি করবে জ্বলন্ত মশাল হাতে উন্মত্ত জনতা, হেঙডাঙ (খড়্গ) হাতে, মুণ্ডিতমস্তক, অর্ধউলঙ্গ প্রতিবাদকারীদের শ্লোগান, শহরে, মাঠে ময়দানে আধাসামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ প্রদর্শন। কোনও প্রতিবাদ করতে পারবেন না। চ্যানেলে চ্যানেলে কাল্পনিক শত্রু, কাল্পনিক বহিরাগতদের সংখ্যা নিয়ে চর্চা, অন-অসমিয়াদের, বিভিন্ন ভাষিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো বাক্যবান। আপনি থাকবেন নির্বাক শ্রোতা হয়ে। এখানে নিয়মিত চর্চা চলছে কীভাবে অসমের মাটিতে অসমিয়াদের সংখ্যালঘু বানিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে ইত্যাদি, যদিও মোদ্দা কথাটি হল অসম মূলতই একটি অসংখ্য সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বহু নৃ, ভাষিক গোষ্ঠী সমন্বিত রাজ্য যেখানে কেউ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
আরেকটি শব্দ নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়, ‘খিলঞ্জিয়া’, অর্থাৎ স্থানীয় জনগোষ্ঠী। ইতিহাসই জানাচ্ছে এ খিলঞ্জিয়ার দাবিদার বাঙালিরাও, কারণ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক থেকেই কামরূপ রাজ্যে বঙ্গদেশ থেকে ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে, আহোম রাজত্বে ষোড়শ সপ্তদশ শতকেও বঙ্গদেশ থেকে মানুষকে আহ্বান করে আনা হয়েছে, আর অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে উনবিংশ শতকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে অসমের নানা ধরনের সম্পর্কের সূত্রে বাঙালিদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যার পূর্ণতা ঘটেছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে তিনটি বাঙালি অধ্যুষিত জেলাকে কেটে এনে আসামের সঙ্গে সংযুক্তিতে (১৮৭৪)। এ দীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরায় বাঙালিরা কি স্থানীয় অর্থাৎ খিলঞ্জিয়া অভিধার অধিকারী নয়? বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের জন্মের কয়েক শতাব্দী পূর্বেই এরা অসমের বাসিন্দা, কেউ বা রাজসভায় পৌরোহিত্য করতে এসেছেন, কেউ বা অনাবাদী জমিকে কর্ষণযোগ্য করে তোলার জন্য আহূত, ইংরেজ আমলে কেউ বা আমলা, চা বাগিচার বাবু, রেল সম্প্রসারিত হলে রেলের বাবু, খনিজ তেলের উত্তোলন শুরু হলে দেশীয় কর্মী, কেরানি, কালাসাহেব, হাসপাতালের ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, ছোট বড় মাঝারি ব্যবসায়ী, দিনমজুর এবং ইশকুল-কলেজ, অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পুরো উনবিংশ শতক ধরেই অসমের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে এদের উপস্থিতি। এরাও স্থানীয় অভিধার যোগ্য, অসমের বা অসমিয়া জনগণের শত্রু নয়।
গণমাধ্যমগুলোতে কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বরাক উপত্যকার স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে কেন বাংলাভাষার প্রচলন, কেউ আবার কাছাড়কে ‘অসমের ক্যান্সার’ বলে আখ্যায়িত করছেন, আবার কেউ একেবারে মধ্যযুগীয় প্রথায় হুমকি দিচ্ছেন অস্ত্রহাতে সদলবলে বরাক উপত্যকায় মার্চ করবেন৷ এত আক্রোশ! এ মাধ্যমগুলো যে প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক বিধিনিষেধগুলো লঙ্ঘন করছে, রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ প্রচার করছে- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে যে এসব মারাত্মক ক্ষতিকর, বিশেষ করে অস্ত্র হাতে প্রদর্শন– এ নিয়ে কোনও আশঙ্কা ব্যক্ত করার কোনও অধিকার থাকবে না কারও? সামান্য এক পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধে এটুকু আশঙ্কার কথা বললেই লেখককে মিডিয়া ট্রায়ালে ওঠানো, লেখকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা– এসবের একটাই অর্থ যে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কাছে ‘আনুগত্য’ স্বীকার করতে হবে।
এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই, ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন রাজধানী শিলঙে বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে মাননীয় রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরির মুখ দিয়েই স্পষ্ট ভাষায়ই এ কথাটি বাঙালিদের শুনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ভাষণে অসমিয়াদের ‘masters of their own house’ অর্থাৎ ‘প্রভু’ এবং বাঙালিদের ‘strangers in our midst’ (উড়ে এসে জুড়ে বসা) ‘আগন্তুক’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল৷ একসঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, নির্যাতন ভোগ করে, কারাবরণ করে, শহিদত্ব বরণ করেও স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ঘটতে না ঘটতেই এ কী নির্মম বাক্য লোকপ্রিয় বরদলুই মন্ত্রীসভা অনুমোদিত এ ভাষণে! এটা যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, একটি সুচিন্তিত ম্যানিফেস্টো তা এখন বোঝা যাচ্ছে। স্যার হায়দারি পঠিত ওই ভাষণে বাঙালিদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘হীনবীর্য’ বলে (‘The Bengalees has no longer the power, even if they had the will’)। অবশ্য এদের প্রতি সামান্য অনুকম্পা প্রদর্শনের সংস্থান এ ভাষণে ছিল৷ বাঙালিদের প্রতি সুব্যবহারের আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, বিনিময়ে এরা যেন অসমিয়াদের প্রতি অনুগত থাকেন। মূল বাক্যগুলো এরকম: ‘I would appeal to you to exert all influence you possess to give the strangers in our midst a fair deal, provided he in his turn deals loyally with us’। অর্থটা কী হল? আনুগত্যের বিনিময়েই মানবিক আচরণ লাভ করবে বাঙালিরা।
স্বাধীনতার পরবর্তী কালে দশকে দশকে যখনই উগ্র দেশপ্রেমিকরা এ আনুগত্যে ঘাটতি দেখেছেন তখনই বাঙালির ঘরবাড়ি পুড়েছে, রক্ত ঝরেছে, শুরু হয়েছে বঙ্গাল খেদা, বহিরাগত বিতাড়ন আন্দোলন। অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক ভালোবাসা নিয়েও বাঙালিরা যে মাতৃভাষাটি ছাড়তে চাইছে না, স্কুল কলেজে বাংলা পড়ছে– এটা এক শ্রেণির দেশপ্রেমিকরা মানতে পারছেন না। গোয়ালপাড়া সহ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অনেকেই ভয়ে মাতৃভাষাবিহীনিতা স্বীকার করছেন (মার খাওয়া তবু বন্ধ হয়নি, নেলি, গহপুরের কথা বললে কেউ আবার গোঁসা করতেও পারেন), কিন্তু আবহমান বাংলার বিলগ্ন সম্প্রসারিত বঙ্গ, বরাক উপত্যকা নিজ ভাষিক অস্তিত্বে স্থিত রইল, এও তাদের ক্ষোভের কারণ। ভাষার প্রতি এত ‘প্রেমহীন ভালোবাসা’-র ফলশ্রুতিতে অবিভক্ত আসাম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, শৈলশহর শিলং থেকে রাজধানী নিয়ে আসামকে সরে আসতে হল, সুন্দরী নেফাকে ছেড়ে দিতে হল যা এখন পরিচিতি লাভ করল অরুণাচল প্রদেশ হিসেবে, ছেড়ে দিতে হল লুশাই হিলসকে যা এখন মিজোরাম রাজ্য৷ ইতিপূর্বেই সরে গেল মণিপুর, নাগাল্যান্ড। এ ভাঙনের মূল কারণ ওই আধিপত্যবাদ৷ প্রতিটি ভাষিকগোষ্ঠীর মধ্যেই এই উগ্র আধিপত্যবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটেছে নিজ নিজ জাতিসত্তার বিকাশ৷ স্বতন্ত্র বড়োল্যান্ড, কামতাপুর, ডিমারাজির দাবি– এ সবই আসামের অসহিষ্ণুতা, পরভাষা, পরসংস্কৃতি বিদ্বেষের ফলশ্রুতি।
এত কিছুর পরও বাঙালির কাছে রাষ্ট্রদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রশ্রয় পায়নি, বাঙালি শতসহস্র পীড়ন সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব কিংবা ভারতীয় সংবিধানের প্রতি ক্ষণিকের জন্যেও আস্থাহীন হয়নি, কোনও আতঙ্কবাদকে তো প্রশ্রয় দেয়নি। খণ্ডিত ভারতের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে যারা ছিটকে পড়েছে এ ভূমিতে, এরা তো জীবন দিয়ে দেশভাগের দায় মিটিয়েছে। নিজ দেশের এ অংশটিতে সামান্য পা রাখবার এ অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করার এত আয়োজন কেন? নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে থাকার চক্রান্ত প্রত্যক্ষ করেও কি উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রতি ‘আনুগত্য’ প্রদর্শন করে যেতে হবে?
এতৎসত্বেও অসমিয়াদের প্রতি অন্যায় করা হবে যদি এ কথাটি স্বীকার না করি, অসমের দুর্যোগপূর্ণ দিনেও আমরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং আশ্রয় পেয়েছি আমাদের প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবিদের কাছে যাঁদের অনেকেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থকও। এদেরও অনেকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বাঙালিরা তাঁদের পরম সুহৃদ, পরমাত্মীয়, অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির গুণগ্রাহী।
অসমিয়া জাতি এবং ভাষিকগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েও সমমর্যাদার ভিত্তিতে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার চেয়ে বাঙালিরা কোনও গর্হিত অপরাধ করেনি যে এদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনতে হবে, ভারতের মাটিতে ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে হবে বার বার? আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, সাময়িক উন্মাদনায় উত্তাল হওয়া একটি বিশেষ চক্রের উন্মত্ততাই সমগ্র অসমিয়া জনগোষ্ঠীর একমাত্র পরিচায়ক নয়। এর চাইতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ রয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের তীরে যাঁরা ভাতৃত্ববোধ, সমন্বয় এবং সহাবস্থানের ভিত্তিতে নতুন অসম গড়ার স্বপ্ন দেখেন যেখানে প্রতিটি ভাষিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী সমমর্যাদার ভিত্তিতে বসবাসের অধিকার লাভ করবেন। এদের জন্যই অসম এখনও একটি বধ্যভূমি হয়ে ওঠেনি, কখনও হয়ে উঠবেও না, এটা অসমের অসমিয়া এবং বাঙালি সহ অপরাপর ক্ষুদ্র, মাঝারি ভাষিকগোষ্ঠীর স্থির প্রত্যয়।
*লেখক একজন সমাজ, ইতিহাস, ভাষা গবেষক, সমাজকর্মী এবং কলামনিস্ট, শিলচর।