যুগান্তর মিত্র
মাকড়ি
সোনার ধান হচে গো। আহা, আমার সোনার পিত্তিমে য্যান! প্রাণভরে শ্বাস নেয় ফিরোজ। মনে তার হাওয়ার উথালপাথাল।
অন্ধকারেরও একটা আলো থাকে। সেই আলোর সঙ্গে আকাশের ভাঙা চাঁদ আর তারাদের আলোয় মাখামাখি হয়ে একরকম জ্যোতি সৃষ্টি হয়েছে। ফিরোজের সারা শরীরে এই জ্যোতি লুটোপুটি খায়।
রুকু ছিল তার বউ, তার মনবারান্দায় হেসেখেলে থাকা বউ। রুকুর একমাত্র সোনার টুকরো কানের মাকড়ি দুটো বন্ধক রাখে ফিরোজ। রুকু প্রাণে ধরে দিতে চায়নি, ফিরোজ অনেক বুঝিয়ে মাকড়িটা নিয়েছে। সোনার ধানের লোভে বন্ধকের সামান্য টাকা নিয়েই নেমে পড়েছিল চাষে।
এবার এত বাদলা হল যে ধানের গোড়ায় জল থইথই। সবাই হাহুতাশ করল, সব ধান মাঠেই পচবে। ফিরোজ শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। রুকু সন্দেহ করেছিল তার মাকড়ি আর ফেরত আসবে না।
–সবুর কর রুকু। আমি ঠিক তোর মাকড়ি নে আনব। এট্টু সবুর কর।
সবুর সে করতে পারেনি। দিলু ভ্যানওলার হাত ধরে চলে গেছে। সেই দুঃখে দিন পনেরো জমির ধারেকাছে যায়নি ফিরোজ। দেখা হয়নি তার জমিন। বৃষ্টি ধরে আসার কয়েকদিন পরে জমিতে আসে সে। তখন সন্ধে উতরে গেছে। আধো-অন্ধকারে সোনালি ধানের গায়ে হাত বোলায় ফিরোজ। জল নেমে গেছে জমির, ফুরফুরে হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে ধানগাছ।
–ওরে রুকু, দেখি যা, তোর মাকড়ির ছোঁয়া লেগিচে ধানে। আয় আয়, দেকি যা।
বলতে বলতে সোনালি ধানের গায়ে গায়ে দৌড়োয় ফিরোজ। সরু সরু গাছ নুয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। তারাও হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। ছোট্ট ছোট্ট সোনার মাকড়ি দুলে ওঠে গাছের মাথায়।
একসময় ফিরোজের হাসির থেকে দমকে দমকে কান্না ঠেলে আসে। ধানগাছেরা তা শুনতেও পায় না। তারা হেসেই চলে। হাসি-কান্নায় ভরে ওঠে জমি আর তার আশপাশের বাতাস।
গুলি
প্রথম গুলিটা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ঠিকমতো টিপই করতে পারেনি নীলু। হাতটা কেন যেন কেঁপে গেল। আর শব্দ পেয়ে ছিটকে উঠে দাঁড়াল মুদির দোকান মহালক্ষ্মী ভাণ্ডারের মালিক বিষ্ণুপদ চাকলাদার। কীসের শব্দ এবং কোনদিক থেকে এল বোঝার আগেই দ্বিতীয় গুলিটা চালিয়ে দিল নীলু। এবার আর ভুল হয়নি। তবে হাত দিয়ে মুখ আর চোখ আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বিষ্ণুপদ। যেন এভাবেই গুলির এফোঁড়ওফোঁড় রোধ করা যাবে।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল বুক থেকে। ‘আঁক’ করে একটা শব্দ। তারপরই ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
সেখান থেকে পিঠটান দিয়ে ফেরার সময় কীসে যেন ধাক্কা লাগল নীলুর কাঁধে। সারা শরীর নড়ে উঠল।
–এই নীলু, ওঠ। কাজে যাবি না? দেরি করলে মালিক নাকি বকাবকি করে। ওঠ ওঠ… ছ’টা বেজে গেছে।
মা’র ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যায় নীলুর। ধড়ফড়িয়ে উঠে দোকানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় সে।
–চা-রুটি খেয়ে তাড়াতাড়ি কাজে যা।
নীলু তার নড়বড়ে ভাঙা জীবনের মতোই ভাঙা সাইকেলে উঠে বসে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে ভাবে, আজ খুব চোটপাট করবে বিষ্ণুদা। হাড়বজ্জাত লোক একটা…
নির্ভার
আজকাল তেমন কাউকে মনের কথা বলার লোক পান না নিঃসন্তান সমীরবাবু। বলার মতো লোক ছিল তাঁর স্ত্রী। তিনিও গত হয়েছেন বছর কয়েক হল।
–বুঝলি নাড়ু, সারাক্ষণ কী যেন নেই নেই মনে হয় আমার। কিন্তু কী যে…
–কন কি কত্তা, আপনারও?
–অ। তার মানে তোরও এইরকম হয় বুঝি?
নাড়ু আগে রিকশা চালাত। বয়স আর রোগের ধারেভারে আজকাল আর পারে না। ছেলেরাই সংসারের দায়দায়িত্ব নিয়েছে। সময় কাটাতে মাঝে মাঝে বিকেলে সমীরবাবুর বাড়ির দাওয়ায় এসে বসে। সমীরবাবুও একজন মন খুলে কথা বলার লোক পেয়ে খুশি। নাড়ুকেই তাই মনের কথাটি বলেছেন।
–আমি তো পেরায় হপন দেহি। কুনুদিন দেহি পা নাই, কুনুদিন হাত, নাইলে মাতা। বুঝলেন নি, এট্টা এট্টা করি শইলের কলকব্জা নাই হয় আর আমি দেইখ্যা আমোদ পাই।
–বলিস কিরে? আমোদ হয়?
–দ্যাহেন কত্তা, এই শইলের নানা কলকব্জা বহুত দিন খাটাইলাম। এইবার যদি নাই হইয়া যায়, খেতি কী কন?
–সত্যি সত্যি তো আর হচ্ছে না। স্বপ্নে হচ্ছে।
–হ। আমিও হেইডাই ভাবতাম। এহন দেহি সত্যই আমার হাত পা মাতা বুক প্যাট কিচ্চু নাই।
–আর এই যেসব আমি দেখছি এগুলো তাহলে কার? মজা পেয়ে বলেন সমীরবাবু।
–ভগায় জানে। তয় মনে লয় এগুলান আমার শইলে নাই।
বিস্ময়ে হাঁ করে সমীর তাকিয়ে থাকেন নাড়ুর দিকে।
–তা ছাড়ান দ্যান আমার কতা। আপনের যে ডাইন পা আর বাম চুখ খোয়া গেচে, ট্যার পান না? আর আর…
সমীরবাবু তাকিয়ে দেখেন সত্যিই তাঁর ডান পা নেই। বাম চোখে হাত দিয়ে বোঝেন সেখানে একটা গর্ত। এরপর আবিষ্কার করেন তাঁর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই ‘নেই’ হয়ে আছে।
–চলেন কত্তা, হাবায় ভাইস্যা পড়ি।
সমীরবাবু আর নাড়ু হাত ধরাধরি করে ভেসে পড়েন হাওয়ায়। ভাসতে ভাসতে দেখেন আরও অসংখ্য মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন অবয়ব হাওয়ায় ভাসছে। তাঁরা দুজনেও অন্যদের ভিড়ে মিশে যান।