সিসিফাস
এক থা রাস্টি। পাহাড় ভালোবাসেন? ঘটনাবিহীন রাতের পর রাত টিমটিম করা আলোবাড়ির ক্যানভাস, আর ছোট্ট একটা ঘর, ভালোবাসেন? একটা টেবিল, টাইপরাইটার, খোলা জানলা, মাঝে মাঝে খেলতে আসা দুতিনটে বাচ্চা, শীত, পুলওভার আর অল্প একটু কান্না পাওয়া নস্টালজিয়া, তাও ভালোবাসেন? তাহলে এ বই আপনার। লোন ফক্স ড্যান্সিং। একটা বিশাল অংশের কাল্ট ভক্ত তৈরি করা সব ভালোর দেশের বাসিন্দা রাস্কিন বন্ডের ‘আত্মজীবনী’। কেন কোট আনকোট? পড়েছেন? মনে হয়েছে, কেন প্রচ্ছদে ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’ লিখলেন রাস্কিন? আসলে সারাজীবন ধরে দেওলি, শ্যামলী, আর দেরার গল্প বলা রাস্কিনের এ আরেকটা বই। গল্প। ছোটবেলার গল্প। স্বপ্ন। হাসি। ব্যথা। পাগল করা প্রেম। লড়াই। আর তার সঙ্গে সঙ্গে চোখের আড়ালে বুনে চলা এক ভারতবর্ষ। প্রিয় পাঠক, আপনাকে হাঁটতে বাধ্য করবে।
জামনগর। বাংলো। অবশ্য তার অনেক আগে এক সেনশুয়াল প্রেম। ছত্রিশ বছর বয়সী রয়াল এয়ারফোর্সের লাজুক, বিনয়ী অব্রে আলেকজান্ডারের সঙ্গে আঠেরোর এডিথ ডরোথি। সপ্তপদীর রিনা ব্রাউন। অহঙ্কারী, উচ্ছৃঙ্খল, খামখেয়ালি। আর যার পরিণতি প্রেম, মিলন, সন্তান, পারিবারিক কলহ এবং একটা অন্ধকার বিচ্ছেদ। ছোট্ট ওয়েন রাস্কিন বন্ড এসব কিছুই জানত না। জানত না কেন তাঁকে জন্মানোর জন্য ওঁদের কসউলিতে আসতে হয়েছিল। সে বুঝত না কিছু। তার মাথায় ভুল করে গিলে ফেলা একটা কমলালেবুর বিচি, আর তার এভারলাভিং আয়ার কথায় যা পেটে গেলে কমলালেবু গাছ জন্মায় শরীরে। মিস্টার জেঙ্কিন্স, আয়ার কথা কি সত্যি? ‘ডোন্ট ওরি, ইট উইল অনলি বি আ স্মল ট্রি…।’ লোন ফক্স ড্যান্সিং এমনই এক ছবি-কথার দেশ। একটা পুরনো কালো রঙের বর্গাকার গ্রামাফোন। বাবার জমানো পোস্টকার্ড, স্ট্যাম্প আর রঙিন ছবি। নেলসন এডি, আর্থা কিট, এনরিকো ক্যারিসোর ব্যারিটোন গলায় আঁকা ছোটবেলার উপত্যকা। একটা সময়ে সইতে সইতে আর না পেরে ওঠে বাবা মার মধ্যে সেপারেশনের মেঘ।
দেরাদুন। দেরা। রাস্কিনের নিজস্ব দেরা। গ্র্যানি। যার কথায়, শরীরী ভাষায় ‘Little boys should speak only when spoken to…’। অনেক পরে বুঝতে পারা, আসলে খিটখিটে সেই বৃদ্ধা যতটা না মা’র মতো, তার চেয়ে অনেক বেশি রাস্কিনের নিজের মুখের মতো। মিস্টার এইচ। বাবার অগোচরে মায়ের ‘সে’। ফটোগ্রাফার, প্লে-বয় এক মানুষ, যেন সত্যি সত্যি মায়ের মতোই। আর তারপর বাবার নিজের কাছে এসে থাকা রাস্কিনের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় সেই দিনগুলো। এ হাট ইন নিউ দিল্লি। অতুল গ্রোভ রোড। হুমায়ুন্স টম্ব। কনট প্লেস। তখনও এতটা কালো না হওয়া যমুনার জল। পুরনো কেল্লা। আর বারবার ম্যালেরিয়ায় ভোগা বাবার হাত ছুঁয়ে রাস্কিনের প্রথম মৃত্যুচেতনার রেশ। এনরিকো ক্যারিসোর ব্যারিটোন। ‘ইয়োর টিনি হ্যান্ড ইজ ফ্রজেন, লেট মি ওয়ার্ম ইট ইনটু লাইফ।’ প্রতিবেশীর কথা, অসুস্থ আপনভোলা অব্রে আলেকজান্ডারের গলায় ছেলেকে নষ্ট করে দেওয়ার কথা। একটা সময়ে সিমলার বিশপ কটন স্কুল। বাবাকে একান্তে চিঠি লেখা, এবং একদিন দেবদারু গাছের তলায় ভূগোল টিচার মিস্টার মারটোর হাত রাস্কিনের কাঁধে। ‘God had needed him more than I did…’ সেই বিশপ কটন স্কুল। মিস্টার প্রিসলিকে দেওয়া বাবার সমস্ত চিঠি স্ট্যাম্প আর ফেরত না পাওয়া।
একটা শীত থেকে আরেকটা শীতের ভেতর ঢুকে যাওয়ার গল্প লোন ফক্স ড্যান্সিং। একদম একা বন্ধুহীন দেরাদুনে তরুণ রাস্টির সঙ্গী বৃদ্ধা মিস্টার কেলনার, shattered spine, twisted hand, bent double body …। ৪০ বছর পর দেরার বরফপাত। কেলনারের আসার দিন। তাহলে এখনই কি যাওয়ার সময়? রাস্টির আবদার। ‘ডোন্ট গো, ওয়েট ফর অ্যানাদার স্নোফল।’ বন্ধু বলতে আরও অনেকে। ডিকেন্স-ভক্ত সিমলার বিশপ কটনের মিস্টার জোন্স। যার কথায় পি জি উডহাউজের পৃথিবী ভাঁওতা। তাতে সত্যি নেই একফোঁটাও। বিসিএসের ফোর ফেদারস। লাহোরের আজহার। স্কুলের গেটের দিকে একটা লুকোনো টানেল। বড় হয়ে কী হবি রাস্টি? –হকি প্লেয়ার। জেতা টিমের। –ধুর, সবসময় জেতা টিমে খেলা যায় না। হারতে হয় অনেক সময়। তুই লেখক হ। কারণ তার কিছুক্ষণ আগেই, রাস্টির গলায়-– ‘when all the war are done, a butterfly will still be beautiful.’ এইভাবেই রাজনীতি, সমাজ ঢুকে পড়া। দেশভাগ। আজহারদের চলে যাওয়া। মানসিকভাবে বাড়তে না পারা বোন এলেনের আঁকার খাতায় ড্রাগন, বাঘের বদলে হিন্দু টেররিস্টের হাতে খুন হয়ে যাওয়া গান্ধীর মুখ। ছোট্ট প্রতিবন্ধী শিশুকন্যাকে কোথাও একটা নাড়া দেওয়া ফারিস্তার আত্মা। দেরার গ্রীন্স হোটেল। মিসেস ডিডস এবং তাঁর সতেরো বছরের ছেলে হাওয়ার্ড, সারারাত ঝগড়া, মদ্যপানের টাকা চাওয়া এবং একাকী অসহায় মিসেস ডিডসের ময়দানের অন্ধকারে বারবার গ্যাংরেপ হওয়ার গল্প। না, লোন ফক্স ড্যান্সিং শুধু মনভালোর গল্প না। অভিশপ্ত বিশপ কটন স্কুলের সেই ব্যাচে রাস্কিন ছাড়া প্রায় সবার অকালে চলে যাওয়ার গল্প। হেমেন্দ্র, কিশেন, যোগী…। একটা সময়ে দেরার স্টেশন ক্যান্টিন রোডের সেই ছাদের বাড়ি, বরসাতি, রুম অন দ্য রুফ। সোমি, হরিপাল, ছোটু, দলজিত, কৃশেন… ব্রিটিশ যুবকের সঙ্গে পাঞ্জাবি ভালোবাসার মিশেল। আরও অনেক গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে দেখা হওয়া। রাস্কিনের নিজের কনফেশন। ‘The most fictional of all my characters is myself…’।
ভয়েজ টু ইংলন্ড। লেখকের স্বর্গ লন্ডন। লেখক হওয়ার দেশ লন্ডন। তাই, জার্সি থেকে লন্ডন। মিস্টার ব্রমলির দেওয়া টাইপরাইটার। গ্রাহাম গ্রিন। ডায়ানা অ্যাটহিল। রুম অন দ্য রুফ-এর প্রকাশক, যার কথায় ‘আই থিঙ্ক ইটস লাভলি…’। এবং ভিয়েতনামি তরুণী ভু। যে চায়ের কাপে ক্রাইসান্থিমাম পাতা দেখতে দেখতে রাস্টির ভালোবাসার প্রস্তাবে সম্মতি জানাতে পারেনি সেদিন। ফিরে আসা। ঘরের টানে, ‘দেশের টানে’ ফিরে আসা। মিস্টার এইচের ছেড়ে আসা স্ত্রী বিবিজি। বন্ধুত্ব। ভালোবাসা। আশ্রয়। গঙ্গার স্নান।
এবং, মুসৌরি। ম্যাপলউড লজ। আওয়ার ট্রিজ স্টিল গ্রো, টাইম স্টপস অ্যাট শ্যামলী, নাইট ট্রেন অ্যাট দেওলির মতো স্বপ্নের লেখাগুলোর ঘর। বারবেট, সিকাডা, অরণ্য। রাস্কিনের নিজের কথায় ‘as a boy loneliness, as a man solitude …’। একতলায় মিস বিন। পরী টিব্বা। বাজ পড়ে মরে যাওয়া একটা পাহাড়ি গ্রাম। ভুতুড়ে প্রেমিক প্রেমিকার ঘর। মনখারাপের রাতে কুলগাছের মধ্যে একলা ভালুক দেখে রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে ওঠা রাস্কিনের সেই পরী টিব্বা। ওয়েনবার্গ অ্যালেন স্কুলের চাঁদনী রাতে একলা একটা শেয়ালের উদ্দাম নাচ। পিক্ল, টফি, সুজি… কখনও চিতার ছোবল, কখনও রহস্যজনক বিদায়… এক এক করে পোষা কুকুর বেড়ালের চলে যাওয়া…। সঙ্গে দিয়ে যাওয়া সেই গুড ওল্ড লোনলিনেস। হ্যাঁ, সঙ্গে সুশীলা। নাম বদলে…। শরীর। চুমু। তুমুল প্রেম, এবং না হয়ে ওঠা এক মিথ।
মায়ের ক্যান্সার। হ্যারল্ড, হ্যান্সেল। গাড়ি দুর্ঘটনা। যদিও একইসঙ্গে প্রেম আর তার নতুন বৌ চন্দ্রা। রাস্কিনের অ্যাডপ্টেড পরিবার। ছোট্ট রাকেশ আজ চল্লিশ। যদিও এখনও টাটকা ছোট্ট ভাই সুরেশের ফ্রেম। Its terrible to see little children suffer and be unable to do anything to relieve it…’। আস্তে আস্তে খ্যাতি, অর্থ। ছোটদের জন্য নেহেরুর বায়োগ্রাফি লেখার ভার, ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে গল্প লিখে পঞ্চাশ টাকা, পেঙ্গুইনের কন্ট্যাক্ট, শ্যাম বেনেগালের ‘জুনুন’ ছবির জন্য রাস্কিনের গল্প ফ্লাইট অফ পিজিয়ন। বিতর্কও। ডেবোনেয়ারে সেন্সুয়ালিস্ট গল্পের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ‘বন্ধু’ খুশবন্ত সিং-এর পাশে না দাঁড়ানো। শেষমেশ আইভি কটেজ। বর্ষার রাত। খোলা জানলা। মাউন্টেন ভিউ। অ্যান্ড দ্য ক্রিকেট স্টিল সিংস অন দ্য উইন্ডো সিল…।
বড় বেশি কথা বলা হয়ে গেল হয়ত। বাকি বলতে স্পিকিং টাইগারের প্রকাশনা থেকে এ বইতে অজস্র ছবি… ছোট থেকে আশির রাস্কিন। সঙ্গে বাবা, মা, স্ট্যাম্প, চিঠি, এলেন, বিবিজি, সোমি, হরিপাল, ম্যাপলউড লজ, সুজি, রাস্কিনের পরিবার…। হলুদ অক্ষরে আপনাকে কাঁদাবেই পাঠক। আপনি পড়বেন… It is the story of a small man, and his friends and experiences in small places…’। যতই ভালোবাসার কথা বলুক। যতই বেঁচে থাকার কথা বলুক। লোন ফক্স ড্যান্সিং আপনাকে হুহু করে কাঁদাবেই…। আমরাও কাঁদতে তৈরি মিস্টার বন্ড। আপনি আরও অনেকদিন লিখুন। লিখে যান…