পরম্পরার অমল দীর্ঘশ্বাস

মিহির সেনগুপ্ত

 

বই নয়। গ্রন্থ। হাতে এসেছিল পর্যালোচনা করার অনুজ্ঞায়। আমি একটি বিকল্প স্বাধীন নিবন্ধে আমার প্রতিক্রিয়া নিবেদন করলাম।

কথাটা হরেকভাবে বলা হয়ে থাকে। এককালে বলা হত সমালোচনা। ইংরেজি শব্দটা সেই অর্থবোধক হয়ে আসর জুড়ে বসেছিল বহুকাল। তখনও সেই লব্জটা বদল হয়নি পুরোপুরি। বেশ কিছুকাল ধরে কুলীন পত্রপত্রিকায় শব্দটি রূপ পেয়েছে “গ্রন্থ পর্যালোচনা”। সেটা তখন লেখকদের বেশ মনমতন হয়েছে। আবার একেবারে অধুনা এ কাজটির পরিচয় দেওয়া হয় এক ভিন্ন কায়দায়। অমুক লেখকের এই বইটি পড়লেন— তমুক নামক পাঠক। সাধারণত দৈনিক পত্রিকার রবিবারের বিশেষ পাতায় এই কায়দাটি দেখা যায়। বোধহয় ‘সমালোচনা’ শব্দটিতে কিছু মাতব্বরি গন্ধ থাকায় এবং একসময় সজনীকান্ত সদৃশ কিছু পত্রিকা-সম্পাদক লেখক-হন্তা রূপে আবির্ভূত হওয়ায় ‘সমালোচক’, ‘সমালোচনা’ ইত্যাদি শব্দগুলো লেখকসমাজে যারপরনাই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অধুনা সে কারণেই পর্যালোচকেরা কোনও লেখকের লেখাই সামান্যতম বাঁকাভাবে বিচার করেন না।

এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, যে বইখানার পরিচয় দিতে যাচ্ছি, তাঁর অ্যানাটমি— প্যাথোলজি করার স্বাধীনতাটা পোক্ত করে নিলাম। আমার সমস্যা অন্য। বইখানা আগে একবার মাত্র পড়েছি এবং তার অভিনবত্বের কারণে লেখককে আন্তরিকভাবেই প্রশংসা করেছি। তখনও ভাবিনি কাকতালীয়ভাবে বইখানা নিয়ে লিখিত কিছু মূল্যায়ন করব। যা হোক, প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আর দু-চারটি আশ-পাশ কথা বলে নেওয়া দরকার মনে করছি।

আসল কথাটা হল, আমি ঠিক একজন উপযুক্ত আলোচক হিসাবে নিজেকে মনে করি না। তদুপরি এরকম একখানা গ্রন্থ গভীরভাবে পাঠ না করে, সেটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করাটা শুধু অসঙ্গতই নয়, রীতিমতো হঠকারিতা। লেখক যে অধ্যাবসায় এবং নিষ্ঠায় বইখানি নির্মাণ করেছেন, সেখানা একবার পড়েই একটা পর্যালোচনা, এমনকি সামান্য পরিচিতিমূলক কিছু লিখে ফেলতে পারব, তেমন এলেমদার আমি নই। ইতিপূর্বে যে কথাটি আভাসে বলেছি, তা আবার বলি, বইটি বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক সৌষ্ঠবে অভিনব, অন্তত, আমার বিচারে। বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকতার অভিনবত্বই আমার প্রধান আলোচ্য হবে।

যদিও ব্যাপ্তি এবং ভঙ্গিমায় ভিন্ন প্রকৃতির, তবু বইটি নাড়াঘাঁটা করে বহুদিন পর কল্যাণীদির কথা মনে পড়ে গেল। ঐ মহিলার সঙ্গে একদা এই অধমের কিছু লেনা-দেনা ছিল। উপলক্ষ তাঁর অনবদ্য থোড়-বড়ি-খাড়া। ভাবছি দিদি যদি বইখানা দেখে যেতে পারতেন, ‘অতঃপর অন্তঃপুরে’–র এই লেখককে বিলক্ষণ কিছু ভালমন্দ খাওয়াতেন নেমন্তন্ন করে, কোলে বসিয়ে। বিষয় বৈচিত্র্যে দিদি কতটা ব্যতিক্রমী ছিলেন, তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক-পাঠিকারা তা জানেন।

আমি মানুষটা সেই জাতীয় গোষ্ঠীভুক্ত, যারা শুধু ভালো জিনিস ভালো খায়, এমন নয়, আমাদের ধরনটা হচ্ছে খাওয়াটাকেই ভালো হিসাবে মান্য করা। সাদা কথায় আমাদের পেটুক বলা হয়ে থাকে। বাঙাল গার্হস্থ্যের সুবর্ণযুগে, সেরকম পরিবারে জন্মাইনি বলে, ভোজন-রসিক যাকে বলে, তা হয়ে ওঠার ভাগ্য ছিল না। তথাপি একেবারে যে অরসিক, তা নই। তবে একটা সৎ গুণ, বাঙ্গাল-বিধায় রপ্ত হয়েছে, ‘রন্ধনবিষয়ে লেখা, গল্প, ছায়াছবি প্রভৃতি আমার মতো লোকদের যে খিদে বাড়ায় বা কদাচিৎ-অগ্নিমান্দ্যদূর করে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রাখি না। অগ্নিমান্দ্য ব্যাপারটা আমার বিশেষ ঘটে না বলে কদাচিৎবিশেষণটা ব্যবহার করলাম।

এত কথা ঘ্যানাচ্ছি এই কারণে যে লেখক সামরান হুদার অতঃপর অন্তঃপুরেনামক গ্রন্থখানি পড়ে, আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে নিজের নোলা সমস্যা। আমার পরমারাধ্যা পত্নীদেবীর এখন বৃদ্ধাবস্থা। তথাপি, আমার নোলাতৃপ্ত করার সদিচ্ছায় তাঁর যে আদৌ অনিচ্ছা আছে, এমন মিথ্যে কথাটা বলতে পারব না। মিথ্যে বলব না। তাঁর শেখার আকাঙ্খাও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সমস্যা বয়সজনিত কারণে কর্মক্ষমতার অভাব এবং অলপ্পেয়ে ডাক্তারগুলো আমাদের উভয়ের মধুমেহ ব্যাধির কারণে পিঠে-পায়েস এবং বিশেষ বিশেষ সুখাদ্যগুলিতে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রেখেছেন বলে সামরান বিবির নির্ধারিত পথে পা বাড়াতে, অর্থাৎ রন্ধন-কাঠি হাতে নিতে পারছেন না।

সে কারণে পিঠে নকশায় চড়েই আসুন বা নকশা পিঠেয় চেপে বইখানা নাড়াচাড়া করেই এবারের মতো নোলাকে বুঝ দিতে হবে। সে যাক, অতঃপর সামরান বিবিকে কদমবুসি জানিয়েই বাকি কথা আলোচনা করব। এরম একটি আলেখ্য সাধু বাংলা ছাড়া বলা উচিত নয় বলে সেভাবেই বিন্যাসে যাব।

কিছু কিছু বইকে গ্রন্থ বলিতে হয়। না হইলে তাহার মর্যাদা রক্ষা হয় না বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমি ইহাকে গ্রন্থই বলিব। বই তো কতই লোকে লিখিয়া থাকে। সুকুমার রায় লিখিয়া ছিলেন, “আর তো সবাই মামা গাগা আবোল তাবোল বলে, খুড়োর মুখে গুঙ্গা শুনে চমকে গেল সবে”। ‘খুড়ো’ না বলিয়া এক্ষেত্রে ‘খুড়ি’ বলিলে জেন্ডার অশুদ্ধি ঘটিত না। কিন্তু প্রথমে যখন ‘লেখিকা’ না বলিয়া লেখক বলিয়াছি, তখন যদি তাহা আধুনিক বিধায় গ্রাহ্য হয়, এক্ষেত্রে গ্রাহ্য না হইবে কেন? কিন্তু সেই সব বিচার এ স্থলে উপলক্ষ নহে। বহু বহুকাল পূর্বে ‘খুড়ো’ গুঙ্গা বলিয়া সর্বজনকে চমকাইয়া দিয়াছিলেন, তাহার বেশ কিছুকাল পরে কল্যাণীদিদি ‘থোড় বড়ি খাড়া’র মধ্যে যে ‘খাড়া বড়ি থোড়’ ছাড়াও বিবিধ বস্তু বিদ্যমান, তাহা প্রমাণ করিয়া ছিলেন এবং কলকেতার সমাজের নকশা অপূর্ব চিত্র-মাধুর্য লইয়া অপূর্ব রূপ, রস, স্বাদ পরিগ্রহ করিয়াছিল। তাহারও বেশ কিছুকাল গত হইলে আপামর পাঠক যখন তদ্বিষয়ে বিগত-স্মৃতি হইল, তখন অকস্মাৎ “আষার আবার সেই কামান-গর্জন”। ব্যবহারে অনুমান, সামরান জন্মসূত্রে শুধু বাঙালিই নহেন, বাঙালি জাতির মধ্যে কুলীনস্য কুলীন (কুলীন শব্দের স্ত্রী-বাচক শব্দটি জানা নেই) কন্যা, অর্থাৎ ‘বাঙাল’। ‘অতঃপর অন্তঃপুরে’ গ্রন্থটি প্রমাণ বাঙাল কন্যারা শুধুমাত্র বিক্রমেই বীরাঙ্গনা নহেন, মসী-বিক্রমেও বিলক্ষণ হস্ত-লাঘবও আয়ত্ত করিতে পারেন, যদি কচ্ছহীনতা সত্ত্বেও আসরে নামিয়া পড়েন।

অতঃপর অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া তিনি যেভাবে তাহার আনাচে-কানাচে দৃষ্টিক্ষেপণ করিয়াছেন তাহা গবেষকসুলভ পর্যবেক্ষণ-ঋদ্ধ হইলেও গন্ধ-পিচেশ পাঠক-পাঠিকাকুল তাহাতে সামান্যতম আঁশটে গন্ধ পাইবেন না। এই গ্রন্থটির নির্মাণ হইয়াছে এমনই একটি সুবিন্যাসে যাহাকে শুধুমাত্র লেখা বা রচনা বলিলে তাহার সম্মানহানি হইয়া থাকে। অবশ্য একথাটি সকলেরই জানা যে বই-পুস্তকাদি যাহা লেখা হয়, তাহাতে ‘প্রিন্টেড-ডেব্রিসের’ পাহাড়ই বৃদ্ধি হইয়া থাকে। কিন্তু এইরূপ গ্রন্থ-নির্মাণে সারস্বত সংসারে অমূল্য সম্পদই সৃষ্ট হইয়া থাকে।

শুরুতেই বলিয়াছি, অধম ‘নোলাসর্বস্ব’ পেটুক বাঙাল। ফলে গ্রন্থখানির সিংহদরজার অন্দরে পা রাখিয়াই প্রথমে রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ নামক এক কবির ধরতাইটি পাঠ করিলাম,

“চাউল ভিজাইয়া কন্যার মায়ে ডাকছে অরিপরি
অরিপরি বৌ ঝিয়ারী সকলও নাইওরী,
তোমরা যাইও আমার বাড়ি…”।     

পাঠক-পাঠিকা পদ্যটি পুরাটাই পড়িবেন। পড়িলেই বুঝিবেন, অনুরোধটির বিলক্ষণ হেতু আছে। অন্যথায় গ্রন্থপাঠ শেষ হইলে যদি কৌতূহলবশে এটির দিকে দৃষ্টি যায়, আবার গোটা গ্রন্থখানি পুনঃপাঠে বাধ্য হইবেন। এই পদ্যটি অন্তঃপুর প্রবেশিকার চাবিকাঠি। কথাটি জানাইয়া দিয়া কতটা উপকার করিলাম, তাহা বোধগম্য না হইলে, এই গ্রন্থ পাঠ করিবার অধিকার নাই। সংক্ষেপে জানাই, ‘বিসমিল্লাহ হইতে তামাম শুদ্‌’ পর্যন্ত না পাঠ করিয়া কোনও ভিন্ন কাজে মন দিবেন না বা বাকিটা পরে পাঠ করিব বলিয়া ফেলিয়া রাখিবেন না। আখেরে অতৃপ্তি থাকিয়া যাইবে।

‘নোলা-বিষয়ে’ অনুভবের আর একটা কথা বলিয়া লইয়া আসল কথায় যাইব। রাধারমণের পদ্যটি পড়িয়াই ‘অরিপরি’ ডাকটা কর্ণে প্রবেশিল এবং তাহার মধ্যে বাজিতে থাকিল— ‘যাইও আমার বাড়ি’। সাব্যস্ত করিলাম, অবশ্যই যাইব। কারণ, কন্যার মায়ে স্বয়ং নিমন্ত্রণ জানাইয়াছেন, আবার তার আগেই তাহার চাউল ভিজানোর কাজটিও হইয়া গিয়াছে। না যাইবার প্রশ্নই ওঠে না।

তাহার পর পরই সামরান পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘নুরুন্নেহা ও কবরের কথা’ হইতে একটি অসামান্য স্মৃতি-কণ্ডূয়নকারী আখ্যায়িকাংশের উদ্ধৃতি দিয়া অন্তঃপুর প্রবেশিকার দ্বারোদ্ঘাটন করিলেন নিজের স্মৃতিসায়র মন্থন উদ্দেশ্যে। লিখিলেন, “লেখালিখি আসলেই অপ্রাসঙ্গিক। তিতাসবিহীন জীবনে কিছু লিখে ওঠার কথাও হয়তো ছিল না। শহরে গল্পরা যায় হারিয়ে। জীবন হয়ে পড়ে কর্কশ।” তাহার এই কথাগুলি স্মৃতিকাতর চির দুঃখী-দুঃখিনীর জীবনে কী যে সত্য, তার অভিজ্ঞতার কিছুটা অন্তত, মানসিকতার দিক হইতে প্রায় তাঁর সহোদরপ্রতিম আমার আছে। লেখক যদি তিতাস-বিহীনতার দুঃখে দীনা হন, আমিও যে কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, ধানসিদ্ধি-বিহীতার যন্ত্রণায় দীনতি দীন। কিন্তু তাহার মতো পরম্পরাগত স্মৃতির সহিত নিজস্ব স্মৃতিকে অচ্ছেদ্য গ্রন্থনায় গ্রথিত করার মতো সম্পদ বা ক্ষমতা আমার ছিল না, ছিল না তৎসহ অনুশীলন-লব্ধ গবেষণার ঐশ্বর্যও। আরও একটি ভিন্নতার কথা বলিতে হয়। তাহার এবং আমার বিষয়-আশয়ও স্ব-স্ব রচনায় পৃথক। আমি একদা বিষাদবৃক্ষ নামে একটি হৃষ্ট-পুষ্ট স্মৃতি-আখ্যায়িকা লিখিয়াছিলাম। সেখানিকে গ্রন্থ নামায়নের গৌরব অবশ্যই দিব না। তবে তাহার কল্যাণে লঘু-গুরু অনেক পাঠক-পাঠিকারই স্নেহ ভালবাসা লাভ আমার এখনও হইয়া চলিয়াছে। বইখানি একান্তই আমার ডাউন মেমরি লেন স্টোরি। সামরান হুদার অতঃপর অন্তঃপুরে গ্রন্থখানিও অনেকখানি বাল্যস্মৃতি-নির্ভর। তিনি বা আমি কেহই আত্মজীবনী, আত্মকথা বা আত্মস্মৃতি হিসাবে তাহা লিখি নাই। কিন্তু সামরান যাহা লিখিয়াছেন, তাহা আমার নিকট একটি রচনা-সিক্তকারি সরস তথা, তথ্যপূর্ণ গবেষণাঋদ্ধ চিত্রনাট্য হিসাবেই আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছে। ইহাকে একটি আর্কাইভাল ডকুমেন্টেশন রূপে গণ্য করা অন্যায় হইবে না বলিয়া মনে করি।

সামরান তাহার গ্রন্থখানিতে মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠা অবলম্বনে তাহার বৃহৎ পরিবারের কথা লিখিয়াছেন এবং বাকি ব্যাপক অংশ বিন্যাস করিয়াছেন অন্তঃপুরের বিশেষ কতগুলি অনুষঙ্গে। বলিতে দ্বিধা নেই, সেই পথে গতায়াত আমার সাধ্যাতীত ছিল। কয়জন স্মৃতি জৃম্ভণকারীর পক্ষেই বা তাহা সাধ্যায়ত, বলিতে পারিব না। কিন্তু যত সংক্ষিপ্তভাবেই তিনি তাহার বাল্যস্মৃতির বিবরণ দিন না কেন, সেই বিবরণের ছায়াচিত্রগুলির সূত্র অবলম্বন করিয়াই যেন পর পর সাতটি রিল একটি প্রশস্ত রূপালি পর্দায় তাহাদের অন্তর্গত ছবি ও কাহিনিগুলি উন্মোচন করিতে করিতে চলিয়াছে। এই সাতটি রিল নামায়নে নিম্নরূপ—

  1. আইলো নকশা পিঠাতে চড়িয়া।
  2. নৈব নৈব চিতই।
  3. পিয়ুরসালা রানছনি।
  4. হারানো হাঁস ম্লান মুরগি।
  5. উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতা।
  6. সংসারে এক তালব্য শ।
  7. বাটা ঝিলমিল বাটা ঝিলমিল বন্ধু খাওরে বাটার প্রাণ।

এই সাতটি রিলের ছায়াছবিগুলি যেন সামরান হুদা নামক জনৈকা ছবি ও কথাকারের স্মৃতির অন্তহীন পসরা লইয়া চলিয়াছে। এ বড় অদ্ভুত এক শিল্পন্যাস। তাহার পর্যালোচনা করার শব্দ বা বাণীরূপ আমার আয়ত্তে নাই। খানিকটা পুনরুক্তির মতো শোনাইলেও পরম্পরার সূত্রে গ্রন্থিভুক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছেন চমৎকার নৈপুন্যে। আমার বিষাদবৃক্ষের অন্যতম বিষাদ ছিল পূর্ব প্রজন্মের স্মৃতি পরম্পরার সহিত বিচ্ছিন্নতার। হিংসা হয়, যখন দেখি শিশু বা বালিকা সামরান, স্মৃতিগল্পে তাহার দাদা-দাদি, নানা-নানিদের বা তাহার আব্বা, ফুফু, কাকা প্রভৃতিদের অনায়াসে আনিয়া ফেলিতে পারিতেছেন। তখন মনে হয়, কী বিশালই না তাহার গল্প কাহিনির উৎস। আমার তো দাদা, নানা, দাদি, নানিদের স্মৃতির টুকরো-টাকরা অদৃষ্টে ছিলই না। তাহাদের গল্প বা স্মৃতিচারণ আমার পরম্পরায় নাই। মাসি, পিসিরা, যাহারা ছিলেন, তাহারা তো দেশভাগের কোঁৎকায় যে কোথায় ছিটকাইয়া গিয়াছেন হদিস নাই। সে কারণে, আমার অদৃষ্টের যতটুকু গল্পকণা জুটিয়াছে, তাহার মধ্যে বর্ণাঢ্যতা বিরল। তাহা কেবলমাত্র বিষাদমণ্ডিত। ভাগ্যক্রমে সামরান যে পারিবারিক এবং প্রাকৃতিক বর্ণাঢ্যতা উপভোগ করিতে পারিয়াছেন তাহা আমার ভাগ্যে ঘটে নাই।

কিন্তু তাহা শুধু ভিন্নতা মাত্র। সামরানের আসল চমৎকারিত্ব তাহার অসাধারণ অনুশীলন, অধ্যবসায় এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। অন্তঃপুরকে প্রকাশ করিতে হইলে যে অন্তর্দৃষ্টির প্রসারণ প্রয়োজন গোটা গ্রন্থে তাহা বিপুলভাবে দৃশ্যমান। আমার স্মৃতিচারণে তাহার স্বল্পতা নিরপেক্ষ পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই অনুভব করিবেন। সেখানে ক্ষমতার তুলনা চলে না। এই নিবন্ধের পাঠক মনে করিতে পারেন, আমি কৌশলে তাহার গ্রন্থখানির সহিত আমার বিষাদবৃক্ষের তুলনা করিতেছি। বস্তুত তাহা নহে। তিনি তাহার মতো লিখিয়াছেন, আমি আমার মতো লিখিয়াছিলাম। ইতরবিশেষ, বিভিন্ন কারণে থাকিবেই। সেক্ষেত্রে যে ঈর্ষার কথা বলিয়াছিলাম, তাহা সমসাময়িক না হইলেও দুইজন লেখকের মধ্যে থাকিতেই পারে। তাহা নির্মল ঈর্ষা। এই ঈর্ষা উভয়কেই সৃষ্টি-কর্মে প্রবুদ্ধ করে। অবশ্য ঈর্ষাটা নির্মল হইতে হবে। ক্ষুদ্র হীনম্মন্যতাজনিত ঈর্ষা সুস্থ মানসিকতা নহে।

কপালক্রমে আমার বইখানি অতিরিক্ত প্রচার পাইয়াছিল এবং তাহা বড় পত্রিকার বদান্যতায়। তাহা বেশ কয়েক বৎসর আগের কথা। তখন বাঙাল জীবনের স্মৃতি লইয়া বিশেষ কেহ লেখালিখি করেন নাই। তাহার প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি পাইলে, পর পর বেশ কয়েকজন অখ্যাত এবং প্রখ্যাত লেখক যথার্থ উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ দ্বারা বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করেন। এইখানেই আমি আমার বিষাদবৃক্ষের মূল্য লাভ করিয়াছি বলিয়া মনে করি।

এক্ষনে আকাঙ্খা, আমার অনুজাপ্রতিম সামরানের এই ব্যতিক্রমী স্মৃতি-আলেখ্যের পথ ধরিয়া এই বিষয় অবলম্বী আরও অনেক গ্রন্থ রচিত হইয়া আমাদের সমধর্মী পাঠিকা-পাঠকদের আনন্দ বর্ধন করিবে। কিন্তু তাহা তো আকাঙ্খার কথা। এখন গ্রন্থখানি পর্যালোচনা করার চেষ্টা করা যাউক।

আমাহেন স্বল্পক্ষমতার পর্যালোচকের পক্ষে কার্যটি সুসম্পন্ন করা সহজ নহে। সে কারণেই শুরুতে লঘু-চাপল্যে বিষয়টি লইয়া নাড়া-ঘাঁটা করিতেছিলাম। এখন মনে হইতেছে সব কয়টি নকশার বিস্তারিত উন্মোচন করিয়া গ্রন্থটি আনুপূর্ব এই প্রবন্ধ পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাহা কি আদৌ পর্যালোচনার মর্যাদা রক্ষা করিতে পারিবে? সেই কার্যটি গ্রন্থটির পাঠকদের মনোযোগী পাঠই একমাত্র সম্ভব করিতে সক্ষম হইবে। তথাপি আমার নিজের পাঠ-পরিক্রমা কেন উপস্থাপন না করিব? তবে যে কথাটি আগে বলিলাম, পুনরায় তাহাই বলি। সত্য সত্যই ইচ্ছা হইতেছে প্রত্যেকটি রিল উন্মোচন করিয়া দেখাই। কিন্তু তাহাতেও পারদর্শিতা এবং সংযম প্রয়োজন। মুশকিল হইল, সামরান হইতেছেন খানদানি ঘরের কন্যা। তিনি বনেদি ঘরানার যে সব খাদ্যবস্তুর বিবরণ দিয়াছেন, সেক্ষেত্রে আমাহেন নোলা-সর্বস্ব, হ্যাংলা-হাভাতে গরীবের ‘পোলা’র সংযম রক্ষা করা অসম্ভব। সে অবস্থায় আমার বর্তমান বয়স এবং বয়সোচিত ব্যাধি-ব্যামোহ প্রভৃতির কারণে বাধ্য হইয়া সংযম রক্ষা করিলাম। নচেৎ ভুগিতে হইবে। অত মাছ, মাংস, পিঠে ইত্যাদি ইত্যাদি যাহা দেখিলেই চড়-চড় করিয়া রোগের প্রকোপ বাড়িবে। খাইলে তো কথাই নাই।

সত্য কথা বলিতে কি, সামরান বর্ণিত হাঁস, মুরগি প্রভৃতি, যাহা যাহা শরবত মিঞা সাইবেরিয় হাঁস বলিয়া বছরভর সরাবরাহ করিত, তাহার রন্ধন-প্রণালী যে ধ্রুপদী অঙ্গের তাহা এজন্মে অনাস্বাদিতই থাকুক। বাংলাদেশে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কালেভদ্রে অন্তত দিশী হাঁস খাওয়াইয়া থাকে। এখানে তাহাও পাই না।

সামরান কৃষি-নির্ভর যে সুস্থিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছবি ও কাহিনি নির্মাণ করিয়াছেন, তাহা গ্রামদেশের একদা গার্হস্থ্য সচ্ছল জীবনের ছবি ও কাহিনি। ক্রম-নগরায়নের অতিভোগবাদের প্রভাবে অনেক কাল আগেই সেই ছবি বিবর্ণ-মলিন হইয়া গিয়াছে। তাহার অবশেষ চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কিছুকাল পর্যন্ত ছিল। বাঙাল-বাঙালির তখনকার জীবনই আনন্দমুখর ‘সেকাল’। সামরান হুদা সেই জীবনের ‘অক্ষর-চলচিত্র’ নির্মাণ এবং গল্প তাহার ‘অতঃপর অন্তঃপুরে’ গ্রন্থটিতে উপস্থাপিত করিয়াছেন। তবে ইহা অবশ্যই প্রাচুর্যের সচ্ছল জীবনের এবং আনন্দ উৎসব চঞ্চল জীবনের ছবি। সাধারণ, দরিদ্র-ক্লিষ্ট মানুষেরা সেখানে বড় একটা প্রাধান্য পায় নাই। কিন্তু তাহাতে গ্রন্থের মাধুর্য নষ্ট হয় নাই। সেই সেকালে তো সচ্ছল চাষি গৃহস্থের প্রচ্ছায়ায় দরিদ্র-অসচ্ছল মানুষেরা জড়াইয়া থাকিত। তাহা একটি নির্দিষ্ট সমাজ-জীবন। বাঙালি, বিশেষ করিয়া, বাঙাল-বাঙালিরা সাধারণত সেই জীবনের গল্পই আবহমান কাল শুনিয়া, শোনাইয়া আসিয়াছে।

আহার-বিহার, আরাম-আয়াস এবং সে সকলের গল্প শহর-নগরে লভ্য নয়। না, ভুল বলিলাম, আহার-বিহার, আরাম-আয়াস শহর-নগরে গ্রাম অপেক্ষা অধিকই লভ্য। কিন্তু সে সবকে কেন্দ্র করিয়া কোনও গল্প গড়িয়া ওঠে না। সামরান তা-ই বলিয়াছেন, ‘শহরে গল্পেরা যায় হারিয়ে। জীবন হয়ে ওঠে কর্কশ।’ শহরে নিত্য উৎসবের মেলার ভিড়ে সাধারণ অসচ্ছল মানুষের উৎসবেরা প্রাণ-ডানা ঝাঁপটাইয়া মরে। সেই উৎসবে কোনও কোজাগরী গল্প থাকে না। সামরান যে গ্রামীণ উৎসবের বিবরণ দিয়াছেন, তাহার পরতে পরতে গল্প। সেই গল্পের নির্যাসের পরম্পরা ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা বা রকমারি লোকায়ত গীতি, পদ্য, পরাণকথা চুয়াইয়া সামরানের কথনে মেশে এবং তাহাকে ধ্রুপদী প্রায় লোকায়তিক মাধুর্যে শাশ্বত বাংলার সম্পদ রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়।

প্রশ্ন জাগিতে পারে, সেই জীবনে কি সবল-দুর্বল, ধনী-নির্ধন, শোষক-শোষিতের ভেদ ছিল না? সবই ছিল। এবং বোধ করি তাহা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি ছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও কোথায় যেন একটা পাকাপোক্ত সেতু ছিল যাহা সচ্ছল-অসচ্ছলের ভেদ কি বীভৎসায় পরস্পরের নিকট যাতায়াত-অগম্য রাখে নাই।

প্রাকৃত্ত-পৈঙ্গল হইতে একটি শ্লোক কবে যেন পড়িয়াছিলাম ঠিক মনে নাই। শ্লোকটি এই রূপ—

“পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধনা
ভক্তি কুটুম্বিনি শুদ্ধমনা।
হাক্ক তরাসই ভিচ্চগণা
কো কর ব ব্বর সগ্ গমনা।।”

সামরান বর্ণিত গার্হস্থ চিত্র এই শ্লোকে বাঙালি এবং বাংলার আত্মপ্রকাশের ক্ষণ হইতে পরম কামনার সিদ্ধিমন্ত্র হিসাবে গ্রাহ্য হইয়াছে। সামরান তাহা পরিষ্কার ঘোষণায় না বলিলেও, তাহার বিবরণের মধ্যে যে তাহা উঁকিঝুঁকি মারিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই। বাঙালি তথা বাঙাল যে অন্তরে অন্তরে পবিত্র পুত্র, বহুধন, শুদ্ধমনা ভর্তৃক ইত্যাদি নিয়া হাঁকেডাকে ভৃত্যদের তটস্থ করাটা ছাড়িয়া স্বর্গবাসও কামনা করে না, একথা কোন বর্বর না স্বীকার করিবে? এ কারণেই বলিয়াছি যে সামরানের এই বিশেষ স্মৃতিচারণ, যাহা রসনা-বাসনার, আহার-বাহারের বর্ণাঢ্যতায় উজ্জ্বল, তাহা আবহমান বাঙালি পরম্পরার সঙ্গে সম্পৃক্ত হইয়া গ্রন্থখানিকে রসপুষ্ট করিয়াছে।

এই প্রসঙ্গে সামরানের বিষয়টির প্রকাশ-নিরুক্তির চমৎকারিত্ব লইয়া অবশ্যই কিছু বলিতে হয়। সিলেট, ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ‘সফায়-নিরুক্তিয়া’-তে লেখকের স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য। মান ভাষার সহিত লোকায়ত শব্দ ব্যবহার এবং পরম্পরার স্বার্থে লোকায়তিক প্রাচীন গীতিকার উদ্ধৃতি, গ্রন্থখানিতে যেন রসের ফোয়ারা ছুটাইয়া দিয়াছে। পাঠক, পাঠিকাদের যিনি বাংলার (অখণ্ড) যে জেলা বা অঞ্চলের মানুষই হউক না কেন, সামান্য অভিনিবেশে পাঠ করিলে বুঝিতে ক্লেশ হইবে না।

একটি কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত ভেদ বাঙালি তথা বাঙাল বাঙালি কোনও দিনও স্বীকার করে নাই। তবে সেই চেষ্টা কেহ কেহ যে কখনও করে নাই এমনও নহে। কৃতকার্য হয় নাই। সামরান তাহার গ্রন্থে উদ্ধৃতি উদ্ধারে তাহার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। বিষয়টি আগেই বলিয়াছি উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না। গ্রন্থখানিতে বিবরণগতভাবে বা উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে পৃথকভাবে হিন্দু সমাজের উল্লেখ নাই। আমার বিচারে তাহাতে আদৌ কোনও রসহানি ঘটে নাই বা একদেশদর্শিতা দোষ নাই। সাংস্কৃতিক সাধনা হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনা, যাহা মধ্যযুগ হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমান সমাজ এ বিষয়ে অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করিয়াছেন। কিছু কিঞ্চিৎ পার্থক্য আহার-বিহার বা যাপনে অবশ্য আছে। এই গ্রন্থে মুসলমানি খাদ্যাখাদ্যের প্রস্তুত প্রণালী তথা তৎসংশ্লিষ্ট উৎসবাদির বর্ণনাই মুখ্য। তাহাতে কোনও দিক হইতে গ্রন্থের রসহানি ঘটে নাই।

এই কথাগুলি বলার কারণ বর্তমানকালীন কিছু সাম্প্রদায়িক বর্বরতার নির্লজ্জ প্রকাশ, যে কারণে আমরা হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজই উৎকণ্ঠিত। সে মতে প্রার্থনা, কেহ যেন এই সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থটিকে উপলক্ষ করিয়া না প্রচার করে যে এখানে হিন্দু বাঙালি পরিবার বা সমাজের কোনও গুরুত্ব না দিয়া লেখক তাহার নিজস্ব সমাজকে অধিক প্রাধান্য দিয়াছেন। ভরসা এই, বাঙালিরা সমাজটা শুদ্ধ মনের হিন্দু বা মুসলমানদের সম্প্রদায় ভাগ করিয়া দেখেন না। বাঙালিকে তাহারা কেবল ‘বাঙালি’ বলিয়াই প্রতিষ্ঠা দিতে সচেষ্ট।

তাহাদের এই যৌথ সাধনার ব্যাপ্তিলাভ ঘটুক এবং জয় হউক। যে পরম্পরায় উত্তরাধিকারী হইয়া সামরান তাহার দায়িত্ব সুযোগ্যতার সহিত পালন করিয়াছেন, তাহার সেই পরম্পরা বাঙালির স্বার্থে অবিচ্ছিন্ন হউক।

বই- অতঃপর অন্তঃপুরে
লেখক- সামরান হুদা
প্রকাশক- ৯ঋকাল বুকস
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ- শফিকুল কবীর চনদন
দাম- ৪৫০ টাকা

[অলংকরণগুলি মূল বই থেকে। শিল্পী: শফিকুল কবীর চনদন]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...