প্রিয়ক মিত্র
গত সংখ্যার পর
লক আপের একটা স্যাঁতস্যাঁতে কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে সত্যেন। সত্যেনের সারা শরীরে দগদগে ছ্যাঁকা। অশ্বিনী বটব্যালের ধীর শ্বাপদসুলভ চোখ স্থির ছিল সত্যেনের ঠোঁটের ওপর, কখন সে ঠোঁট নড়ে উঠে কবুল করবে আদিনাথের ডেরার খবর। আর হাতের জ্বলন্ত সিগারেটের মুখ চেপে বসছিল সত্যেনের শরীরের বিভিন্ন অংশে। সত্যি কথা বলতে কী, ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যই সিগারেট জ্বেলেছিল অশ্বিনী বটব্যাল, নইলে পাইপ ছাড়া কিছু ফোঁকে না সে।
সত্যেন নিজের পেছনে হাত দিল। অনুভব করার চেষ্টা করল রুলের গুঁতো তার পাছার আকৃতি পাল্টে দিয়েছে কী না!
দেয়নি!
নিশ্চিন্ত হল সত্যেন। সে জানে তার লুঙ্গির গেঁজেতে গোঁজা জিনিসটা তাকে টিকিয়ে রাখবে, রাখবেই…
হঠাৎ সচকিত হল সত্যেন। নিজের গেঁজেতে একবার হাত রাখল।
সর্বনাশ!
কোথায় গেল? নিশ্চয় এরা বার করে নিয়েছে! আর নইলে…
সত্যেন উঠে বসল কসরত করে। তার লাল রাক্ষুসে চোখটা রাখল লক আপে তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা লোকটার দিকে।
ফতুয়া আর লুঙ্গিপরা লোকটা মুসলমান। কসাই। বউকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল। গালে কাটা দাগ। আফগান চেহারা, চোখে সুরমা। ছোটবেলায় দেখা কাবুলিওয়ালার মতন চোখ। হাড় হিম করা। লোকটাকে খুব ভালো লেগেছে সত্যেনের। কারণ লোকটা একবারও ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেনি, উৎসুক দৃষ্টি দেয়নি। নিজের মতন থেকেছে।
এই লোকটা সরায়নি তো?
সত্যেন বিনা বাক্যব্যয়ে লোকটার লুঙ্গিতে তল্লাশি চালাতে গেল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সত্যেনের গলায় একটা শক্ত লোহার মতন হাত চেপে বসল। সত্যেনের মনে হল তার গলার সমস্ত হাড় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।
যেটুকু চোখ ঘোরাতে পারল সত্যেন, দেখল কাবুলিওয়ালার মতন খুনে চোখ মেলে কসাইটা তার দিকে চেয়ে আছে।
সত্যেন ওর ডানহাতের মুঠি পাকাল। শরীরের যাবতীয় জোর জড়ো করল সেখানে। তারপর কসাইটার তলপেট লক্ষ করে চালিয়ে দিল হাতটা।
নিজের হাতের মুঠিটাতেই চরম যন্ত্রণা অনুভব করল সত্যেন। মনে হল দেওয়ালে ঘুষি চালাল সে।
একটা অস্থিরতা তৈরি হতে দেখে ছুটে এল জনাদুয়েক কনস্টেবল।
“আরে এ সুলতান! কা কার রাহে হো?” বুড়োমতন কনস্টেবলটা চিৎকার করল।
একটা হাতের ধাক্কায় সত্যেন ছিটকে পড়ল লক আপের আরেক প্রান্তে।
সত্যেন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে লোহার গরাদ ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল। কনস্টেবলদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “এই শুয়ারের বাচ্চা, দে আমার আংটি ফেরত দে!”
কনস্টেবল দুজনই হতচকিত হল। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে একজন কনস্টেবল লাঠি বাগিয়ে এগিয়ে গেল সত্যেনের দিকে।
লাঠি দিয়ে সত্যেনের থুতনিটাকে খানিক উঁচিয়ে ধরল একজন রোগা কনস্টেবল।
“মাজাকি হচ্ছে খানকির বাচ্চা! লক আপের ভেতর নকশা?”
সত্যেনের আগুনচোখ কনস্টেবলকে দুসেকেন্ড দেখল। পানচিবোনো অসহ্য লাল দাঁতওলা মুখটাতে ততোধিক অসহ্য একটা হাসি!
সত্যেন লাঠিটাকে শক্ত করে চেপে ধরল তার ডানহাত দিয়ে, তারপর কনস্টেবলকে কিছু বুঝতে দেওয়ার আগেই মারল এক হ্যাঁচকা টান। কনস্টেবলের রোগা মুখ এসে ঠোক্কর খেল লোহার গরাদে। কনস্টেবলের হাত পেঁচিয়ে ধরল সত্যেন তার রোগা হাত দিয়ে। মনে হচ্ছিল অজগর পেঁচিয়ে ধরছে তার শিকারকে।
আর্তনাদ করে উঠল কনস্টেবল!
ঠিক সেইসময় একটা রিভলভারের সেফটি ক্যাচের খচ করে শব্দ। সত্যেন চোখ ঘোরাল। কালো মোটা সাদা ঊর্দির টিকটিকিটা এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে কোমরের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা রিভলভার। চোখে নেশা আর করাল রাগ একসঙ্গে মিশে আছে।
কনস্টেবলটা চিৎকার করেই যাচ্ছিল। কানে লাগছিল। ওর হাতটা ছেড়ে দিল সত্যেন একঝটকায়।
কনস্টেবল নিজের হাত চেপে ধরে যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখে খিস্তির ফোয়ারা ছোটাতে শুরু করছিল! সাদা ঊর্দির কালো টিকটিকি থামাল। তারপর নিজে মুখ খুলল।
“লক আপ খোল! হারামজাদার কুস্তি লড়ার শখ আমি মেটাচ্ছি।”
বিশ্রীভাবে হেসে উঠল কনস্টেবল দুটো।
খুনী কসাই-এর চোখ থেকে নিভে গেছে সব আগুন। বিস্মিত এবং খানিক বোকা বনে যাওয়া দৃষ্টিতে সে দেখছে সত্যেনকে।
লক আপের তালা খুলছে কনস্টেবলগুলো। আর বিচ্ছিরিভাবে হাসছে।
এই পরিস্থিতিতে সত্যেনের উচিত ছিল শরীরটাকে আরও খানিকটা গড়েপিটে নেওয়া ভেতরে ভেতরে। তার শরীরের ওপর এখন খেলাধুলো করবে তিনটে সাদা ঊর্দি মিলে। কিন্তু সত্যেনের মাথায় আগুন জ্বলছে। সে ভালো করে দেখল সাদা ঊর্দির কালো মোটা টিকটিকিটাকে। না টিকটিকি নয়, ভাবল সত্যেন, শয়তান লেড়িকুত্তা। অশ্বিনী বটব্যাল যখন ছ্যাঁকা দিচ্ছিল বডিতে, তখন খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসছিল কুত্তাটা।
সামনে এগিয়ে আসছে কুত্তাটা। বেল্ট খুলতে খুলতে। ওই বেল্টের ঘা খেয়েছে সত্যেন। কোনও জানোয়ারকেও এই মার সহ্য করতে হয় না বোধহয়।
মোটামুটি একহাত কাছে আসতেই সত্যেন শরীরের সমস্ত জোর জড়ো করে একটা কাণ্ড ঘটাল। সাঁড়াশির মতন দুই হাত দিয়ে সাদা ঊর্দির কলার চেপে ধরল সত্যেন।
“দে, আমার আংটি ফেরত দে!” গর্জন করল সত্যেন। ওর ভয়াবহ চোখদুটো সাদা ঊর্দির চোখের ওপর রেখে।
সাদা ঊর্দির চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে প্রায়। এটা আশাও করতে পারেনি সে। তার হাত রিভলভারের বাঁটে স্থির হল রাগে আর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে। আর সেটাই হয়ে গেল তার চরম ভুল।
কনস্টেবল দুজন সক্রিয় হওয়ার আগেই সাদা ঊর্দির রিভলভার ধরা হাতটা ঘুরিয়ে সত্যেন চেপে ধরল সাদা ঊর্দির পেটে। টাল সামলাতে না পেরে ট্রিগারে চেপে বসল সাদা ঊর্দির আঙুল।
দুম! শব্দ, ধোঁয়া। রক্তে ভেসে গেল লক আপ। পুলিশের রক্তে, শাসকের প্রতিনিধির রক্তে ভেসে গেল লক আপ। কালো মোটা শরীরটা ধপ করে পড়ে গেল লক আপে।
খুনে কসাই ভয়ে সেঁটে গেছে দেওয়ালে।
আর দেরি করল না সামনের কনস্টেবল। সে এর পরেও আরও কিছু ঘটার অপেক্ষা না করে বেয়নেট গেঁথে দিল সত্যেনের পেটে। টেনে বার করে আনল রক্তমাখা বেয়নেট। আবার গেঁথে দিল।
মৃত্যুর আগে একটাও শব্দ বেরোল না সত্যেনের মুখ থেকে। তার ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাওয়া দুটো চোখে শুধু ভেসে রইল একটা আকাশি রঙের হীরের আংটি।
মানিকতলার ঘর তখন থমথমে। গোটা ঘরের চোখ আদিনাথের ওপর। সে কি বলবে কিছু?
আদিনাথ তার ছোটঠাকুরদাকে দেওয়া কথা রাখবে, রাখবেই। মরে গেলেও সে এই আশ্চর্য ঘটনা ফাঁস করতে পারে না।
“আহ!”
আচমকা দরজার দিক থেকে এই শব্দটা পেয়ে যারপরনাই চমকে উঠল সক্কলে। প্রত্যেকের বিস্ফারিত চোখ ঘুরে গেল দরজার দিকে।
দরজায় ঘাপটি মেরে থাকা খোচড়ের অস্তিত্ব কেউ জানতেও পারত না, যদি না আদিনাথের ছেড়ে রাখা কেউটে সাপটা দরজার বাইরে পাহারায় থাকত। সুন্দরবনের একজনের থেকে সাপ ধরা শিখেছিল আদিনাথ। তারই ধরা সাপ এই কেউটেটা। যা আজ সকালেই একটা চুবড়িতে করে এনে রেখেছিল আদিনাথ। তারা সকলে ডেরায় জমায়েত হওয়ার পর দরজার গোড়ায় সাপটাকে ছেড়ে রেখেছিল সে। সত্যেন ধরা পড়ার পরে সে আন্দাজ করেছিল পুলিশ আজ হামলা করতেই পারে এই ডেরায়। সত্যেন অবধি যখন পৌঁছতে পেরেছে। চুবড়ির মাথাটা হালকা করে ফাঁক করা ছিল। সে জানত কালো কেউটেটা কারও অস্তিত্ব টের পেলেই বেরিয়ে আসবে নিজের মতন। কাজ হাসিল করবে। তারা বেরোবার আগে গোপনে সাপটাকে ধরে আবার চুবড়িতে পুরে দেবে আদিনাথ। পরিকল্পনা খানিক এমনটাই ছিল ওর। কারণ সে নিজে সাপ ধরতে জানলেও বাকিদের এই কেউটে রেয়াত করবে কেন? কেউটে তো শ্রেণিশত্রু চেনে না।
তবে কাজ হাসিল হয়েছে। খোচড় ধরাশায়ী। সশব্দে দরজা ঠেলে খুলে পাঁচজন মিলে ঘিরে দাঁড়াল খোচড়কে।
খোচড় একবার তাকাল সবার দিকে। একটা অদ্ভুত ক্যাবলা হাসি হেসে অতীব কষ্টে বলল, “অনেকভাবেই মরব ভেবেছিলাম, তা বলে এই প্রাণীটার হাতে মরণও যে কপালে ছিল!”
তার করুণ চোখ অনুযায়ী চোখ ঘোরাল সবাই। আদিনাথ ছাড়া প্রত্যেকেরই পিলে চমকে উঠল।
একটা কালো রঙের কেউটে সাপ ফণা তুলে অপেক্ষা করছে। পাশে একটা আধখোলা চুবড়ি।
আদিনাথ শান্তভাবে এগিয়ে গেল। ফোঁস ফোঁস করতে থাকল সাপটা। ডানহাতের তালুটা নামিয়ে নিয়ে আদিনাথ সযত্নে চেপে ধরল কেউটেটার মুখ। তারপর ছটফট করতে থাকা দেহটাকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে আশ্চর্য কায়দায় চুবড়ির ভেতর চালান করে চুবড়ির মুখ বন্ধ করে ঘরের ভেতর সেটা রেখে এল আদিনাথ।
বাকিরা সচকিত, বিস্মিত, চমৎকৃত। আদিনাথ এই সাপটাকে মোতায়েন করেছিল এখানে?
তবে কারওই বিশেষ ভাবার সময় নেই সাপটাকে নিয়ে। সবার চোখ পড়ল খোচড়ের ওপর।
খোচড়ের চোখ কিন্তু স্থির আদিনাথের ওপর।
“আপনিই আদিনাথ রায় না! অনেক শুনেছি আপনার কথা! লতাটাকে আপনিই ছেড়ে রেখেছিলেন না?”
লতা বলতে সাপের কথা বোঝাচ্ছে খোচড় তা বোঝা গেল।
“মরণ তো ছিলই কপালে”, ভালো করে কথা বলতে পারছে না খোচড়, “মা মনসার ভোগেই না হয় গেলাম। আপনার দয়া!”
শেষ কথাটা বলতে বলতে হাসার চেষ্টা করল খোচড়। দুহাতে গোড়ালিটা চেপে ধরে সে শুয়ে পড়ল এবার।
“সামান্য জল হবে?”
“না!”, কর্কশ গলায় বলল তপন।
আবার হাসির চেষ্টা খোচড়ের। “মরেই তো যাচ্ছি স্যার!”
“মরে যাওয়ার আগে আমাদের কজন কমরেড জল পেয়েছে? আপনাদের লক আপে?” জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল অঞ্জন।
কষ্টে চোখ উঁচিয়ে খোচড় বলল, “আমি তো স্যার ফেউ! আমার হাতে কতটুকু! আমার হাতে থাকলে আমি জল দিতাম, ঠিক দিতাম!”
শেষ কথাগুলো নিভে এল যেন।
“শুয়োরের বাচ্চাটা এত দূর পৌঁছোল কী করে!” তপন চাপা গলায় বলল। “তার মানে পুলিশও কি…”
আদিনাথের কানে কথা ঢুকছিল না। আরেকজন রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মৃত্যু দেখছে সে। তার সৃষ্টি করা মৃত্যু, নিপুণ শিল্পের মতন মৃত্যু!
“আদিনাথদা! তপন মনে হয় ঠিকই বলছে!” অঞ্জনের গলায় আর কোনও সন্দেহ নেই, তৎপরতা আছে। “আমাদের পালানো প্রয়োজন, পুলিশ এসে পড়বে!”
“শুধু সাপের ছোবলে রিলাই না করে বডিটায় দুটো দানা অন্তত পুরে দেওয়া উচিত!”
মন্তব্যটা করে সবার চোখ একবার দেখে নিল রোহিতাশ্ব।
আদিনাথ মুচকি হাসল। “হুমম! তা বটে! সাপের ছোবল ইজ নট আল্টিমেট!”
অঞ্জনের দিকে তাকাল আদিনাথ। চোখে নির্দেশ। তার হাতেই এখন আদিনাথের পিস্তল।
“মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা স্যার!” গলা দিয়ে আওয়াজ ঠিকরে বেরোচ্ছে খোচড়ের, তার শেষ হাসির চেষ্টাটার পর সে বলল, “পালান স্যার! পুলিশ আসছে!”
কথা শেষ হতে না হতেই অঞ্জনের পিস্তল দুবার গর্জে উঠল। খোচড়ের দেহ সোজা হয়ে গেল। দুটো হাত ছড়িয়ে গেল দুদিকে।
আর সঙ্গে সঙ্গে আদিনাথের চোখে পড়ল আংটিটা!
আদিনাথের চোখে হতবাক বিস্ময়! এ কী দেখছে সে! তার মানে সত্যেনের কাছ থেকে আংটিটা…
সত্যেনের দোকানেই সত্যেনের গেঁজের ভেতর থাকা আংটিটা দেখেছিল খোচড়। সত্যেন চালাক। ওই আংটি সে আঙুলে গলালেই চোখে লাগত। রাজাবাদশাহের জিনিস বলে কথা! সত্যেনকে ফলো করে তার বাড়ি চিনেছিল খোচড়। রাতে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে এই আংটি সে সত্যেনের গেঁজে থেকে সরিয়েছিল। চুল্লুর নেশায় সত্যেন মড়ার মতন ঘুমোয়।
আদিনাথ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলে নিল আংটিটা। মুঠোর মধ্যে দিয়ে মুহূর্তে পকেটে পাচার করল সেই আংটি!
আদিনাথের এই অস্বাভাবিক আচরণ বাকিদের ধাতস্থ হওয়ার আগেই নীচের দরজায় দুমাদ্দুম শব্দ। পুলিশ!
ভাঙা আসবাব ঠেলে কোনওক্রমে ছাদে উঠে তারপর পাইপ বেয়ে নামতে থাকল পাঁচজন। তারপর গলিতে নেমে দৌড় দৌড় দৌড়।
কিন্তু নামার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচজনেরই পথ আটকে পাইপ মুখে যে টিপটপ ভদ্রলোক দাঁড়ালেন আদিনাথ তাকে দেখেই চিনল। তার কলেজবেলার বন্ধু অশ্বিনী বটব্যাল।
“আদিনাথ রায় অ্যান্ড কোং, পুলিশ যে চারদিক থেকে আপনাদের ঘিরে ফেলেছে দাদারা! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!” পাইপ কামড়ে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল অশ্বিনী বটব্যাল।
“হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! এতদিন পর এভাবে দেখা হল! তারপর মিস্টার বটব্যাল! সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে শেষে পুলিশের টিকটিকি!” আদিনাথের মুখে বাঁকা হাসি!
“তোমার সঙ্গে খোশগল্প করার সম্পর্ক আমার নয় আদিনাথ! তুমি একজন দেশদ্রোহী! ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট! তোমাকে…”
“আমার তো যদ্দুর মনে পড়ছে কলেজে আমার থেকে বেশি দেশকে ঘৃণা করতে তুমি! তোমার ফ্রান্স যাওয়ার স্বপ্নের কী হল কমরেড!” আদিনাথ আলতো করে কাঁধে হাত রাখল অশ্বিনীর।
“আই অ্যাম নট ইওর কমরেড বাস্টার্ড!” আবারও চিবিয়ে চিবিয়ে কথা ছুঁড়ে দিল অশ্বিনী বটব্যাল।
“জানি তো!” হেসে বলল আদিনাথ!
“আদিনাথদা!” অঞ্জনের গলা হিসহিস করে উঠল। “আমাদের পেছনে পুলিশ সেটা ভুলে যেও না! আজ সন্ধে থেকে একের পর এক স্টান্ট দেখিয়ে চলেছ তুমি! বাট ইফ উই ক্যান ফাইন্ড দ্যাট ইউ আর দ্য ট্রেটর, তাহলে কিন্তু!”
“পুলিশের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের কথা আগে বলোনি কেন তুমি!” রঞ্জন তীব্রভাবে বলল।
তপন আর রোহিতাশ্ব নীরব দর্শক। এতটা সময় নষ্ট তারা মেনে নিতে পারছে না! পুলিশ যদি এসে পড়ে…
“সো আনফরচুনেট আদিনাথ! তোমার কমরেডরাই তোমায় বিশ্বাস করে না!”
“জানি অশ্বিনী!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল আদিনাথ! “তবে এইবারে করবে!” একথা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার ডানহাত দিয়ে অশ্বিনী বটব্যালের কাঁধ চেপে ধরল আদিনাথ আর বাঁহাতে থাকা লুকোনো ছোট্ট ছুরি চালিয়ে দিল অশ্বিনীর মুখের কোণাকুণি।
অশ্বিনী মুখ দুহাতে চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠছিল। বিপদ বুঝে বাকি চারজন বাঘের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল অশ্বিনীর ওপর। তার মুখ চেপে ধরে রাখল যতক্ষণ না তার শেষ নিশ্বাস লাবডুব খেয়ে হজম হয়ে যায় আবার।
পুলিশ যতক্ষণ দরজা ভেঙে মানিকতলার বাড়ির ভেতর খানাতল্লাশি চালাচ্ছিল, ততক্ষণে অশ্বিনী বটব্যালের নিথর দেহের ওপর, বলা ভালো প্রায় তার পাকস্থলী বরাবর খোদাই করা হয়ে গিয়েছিল রক্তের অক্ষরে এলোমেলোভাবে লেখা, “পুলিশের কুত্তা”, এই বডি যখন পেয়েছিল পুলিশ, তখন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি তারা। সত্তরে পুলিশের যত লাশ মিলেছিল, তার কোনওটাতেই এরকম নৃশংস কারুকার্য কেউ দেখেছিল কি?
চারু মজুমদার ধরা পড়লেন আর কিছুদিনের মধ্যেই। আপাতভাবে শহরে অভ্যুত্থান থিতিয়ে গেল। ভূতের মতন কয়েকজন নকশাল মাঝে কদিন যে কাণ্ড ঘটিয়ে গেল তা পুলিশের একাংশই জানল শুধু। কোনও দেওয়াললিখন কোনও স্টেনসিলও তারা রাখেনি কোথাও। খ্যাপা কুকুরের মতন খুঁজেও ঐ কুখ্যাত পাঁচজনের একজনকেও খুঁজে পেল না পুলিশ। কোথায় তারা পালিয়েছে কেউ জানে না! মাঝে একদিন মানিকতলার ওই বাড়ির পাশে দেওয়াললিখন দেখা গেল লাল কালিতে, “রুণু গুহনিয়োগীর মুণ্ডু চাই”, ধরপাকড় হল কিছু। কিন্তু না, সত্যি সত্যি রুণু গুহনিয়োগীর মুণ্ডু যারা উপড়ে ফেলতে পারত, তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না কোত্থাও। ফলে রুণু গুহনিয়োগীর প্রাণসংশয় রয়েই গেল। রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে বেঁচে রইল পাঁচজন, আরও অনেকের মতন।
এর পর বছর সাতেক পেরিয়ে গেল। জরুরি অবস্থা পেরিয়ে ইন্দিরা সরকারের পতন হল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। আদিনাথদের কেস নিয়ে নাড়াচাড়া স্তিমিত হল। আদিনাথদের গল্প ওখানেই ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবে অনেকের মতে সুন্দরবনে থান গেড়ে এক সাধু রয়েছে কয়েকবছর ধরে, আদিনাথের সঙ্গে নাকি তার চেহারায় অনেকটা মিল।
সেই সাধুর কৌপীনের তলায় ঢাকা আঙুল কেউ দেখতে পায় না। দেখতে পেলে জানতে পারত, ওই আঙুলে শোভা পায় একটা আকাশি রঙের হীরের আংটি!
এই আংটির পেছনের গল্পে এবার ঢোকা যাক!
শেষ হল ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস। আগামী সংখ্যা থেকে তারান্তিনোর নতুন অধ্যায় জ্যাঙ্গো আনচেনড্…