অরূপ রায় চৌধুরী
রবিবার বিলম্বিত সন্ধ্যা কেটে গেলে, প্রৌঢ় হাফ প্যান্ট আর হলুদ টি শার্ট গলিয়ে চারতলা ফ্ল্যাট থেকে নীচে নেমে আসে। ঠেকে বসে থাকা কনট্রাকটর কাজলের সাথে বাথরুমের কমোডটা সারানোর ব্যাপারে কথা বলে। আজ তৃতীয় দিন। কাজল ভুলে গেছে, রোজই ভোলে। তাই ঢপ দেয়। প্রৌঢ় বোঝে। তবু আবার বলে এবং পরের দিনের জন্য আশাহীন আশ্বাস ম্যানেজ করে কিঞ্চিৎ খুশি হয়। ঠেকে লোক কম, সবজান্তা অতনু কফিহাউস আর কলেজস্ট্রিট নিয়ে বাজে জ্ঞান দেয়। হিন্দু স্কুলে বারো বছর পড়া প্রৌঢ়ের অস্মিতায় মৃদু ঠোকা লাগে। চুপ করে থাকে, সহ্য করে, মনে মনে বিরক্ত হয়। মোহনবাগান, আই এস এল করে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। সুবিধা করতে না পেরে আরও বিরক্ত হয় এবং উঠে পড়ে। ঢলে যাওয়া উইকেন্ডজনিত স্ফূর্তি বা অস্ফূর্তির কারণে, অথবা সারাদিনের বেমক্কা গরম বা সন্ধ্যার পর খানিক ঠান্ডা হাওয়া শরীরে লাগার ফলে সে এক লাফে দাঁড়িয়ে থাকা অটোয় উঠে পড়ে। অটো থেকে নামে এবং বড় না ছোট, বড় না ছোট — এই দোনোমনায় একটা বড় হুইস্কির বোতল কিনে বাড়ি ফেরে। ফেরার পথে মোড়টা ম্যানেজ করতে হয়। কারণ ঠেকে ততক্ষণে লোকজন বাড়ছে। এই অটোতে ওঠা ও নামা, দ্রুত ফিরে আসার জলভাত সমীকরণ কেউ কষলেই চারটে আওয়াজ শুনতে হবে। চারতলায় উঠতে গিয়ে পায়ের পুরনো ব্যথাটা টাটায়। কেয়ার করে না। কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে, কান পেতে শোনার চেষ্টা করে অ্যাড না সিরিয়াল। অ্যাড হলে ব্যস্ততা কম, দরজা তাড়াতাড়ি খোলে। ঘরে ঢুকে ড্রইংয়ের নিচু টেবিলটায় বোতল রাখে এবং ঠক্ করে আওয়াজ হয়। রাখার আওয়াজে যেন ঈষৎ আত্মপ্রসাদ মিশে থাকে। একটা কঠিন অথচ মনোমত কাজ সম্পন্ন হলে যেমনটা হয় আরকি। যেতে পারি কিন্তু কেন যাব টাইপের ঢ্যামনামি করে বোতল খোলে না এবং আনন্দবাজার খুলে বসে। ড্রইংয়ে আপাতত প্রৌঢ় একা। বউ বেডরুমে নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে বিছানায় চেতরে আছে। মেয়ে নিজের ঘরে হোয়াটস্ অ্যাপে। সে মনিয়া দেবনাথের পরকীয়া এবং স্বামীহত্যার খবর মন দিয়ে পড়ে। সে জানে যে কাল লাঞ্চে বিষয়টি উঠবে। তাই আপডেট নেয়। পুবের জানলায় পিচিক্ একটু হাওয়া দিলে বুকের সাদা লোমে হাত বোলায়, একমনে আনন্দবাজারের দিকে চেয়ে জুতসই খবর খোঁজে এবং নাক খোঁটে। যে পর্বে এসে নাক খোঁটা রোমাঞ্চকর মুহূর্তের আভাস আনে, সেটি পূরণ হলে অবশেষে সে উঠে বসে এবং রমাকে দুটো শসা কাটতে বলে। রমা এ’বাড়িতে অনেকদিন। সে হাওয়া বোঝে ও দ্রুত শসায় মন দেয়। প্রৌঢ় নিজে ধীরেসুস্থে ওঠে, সামান্য লেংচে আলমারির কাছে যায়, দুটো গেলাস আর পেগ মাপার ঘুণ্টিটা বের করে। তখন আবার মৃদু হাওয়া দেয়, ভুলে যাওয়া হ্যাজানো গরমটাকে টের পাওয়ায়। সন্তর্পণে একটিতে হাফ পেগ, আর একটিতে এক পেগ মাল ঢালে। গেলাস দুটো নিয়ে ফ্রিজের কাছে ডাইনিং টেবিলে রাখে এবং ফ্রিজ থেকে ধীরেসুস্থে গুনেগুনে চার-চার আটটা হার্ট বা লাভ শেপের বরফ দুটো গেলাসে রাখে, পরিমিত ঠান্ডা জল ঢালে। তারপর ফিরে এসে মৃদু আহ্লাদী অ্যাকসেন্ট পাঞ্চ করে বউকে ডাকে। প্রৌঢ়ের নীচে যাওয়া, ফিরে আসা বউয়ের গোচরে নেই, সে তখন নাটকে। প্রাণপণ নীচু গলায় একা ঘরে সংলাপ বলে চলেছে। কান পাতলে মাঝেমাঝে শুধু “বাহ্”, “বাহ্” শোনা যায়। আবার কনফিডেন্টলি ডাকে — “আরে শুনে যাও না! সব চেঁচিয়ে বলা যায় নাকি?” নরম বিরক্তি মিশিয়ে বউ উঠে আসে। প্রৌঢ় কিছু বলে না, তাকিয়ে থাকে। আরও একটু বিরক্ত হতে হতে বউয়ের এবারে গেলাস-বোতল-ঘুণ্টিতে চোখ পড়ে। চোখের তারায় হাসি লেগে যায় আর লাভ শেপের বরফগুলো ছোট হয়ে তখনও ভেসে থাকে। ওরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে শসায় কামড় দেয়।
সোমবার নিয়মমতো সকাল সকাল পাঁচুগোপাল টাইপ মুখ করে প্রৌঢ় অফিস যায়। লাঞ্চে মনিয়া নিয়ে আলোচনা উঠছে না দেখে অধৈর্য হয়ে নিজেই তোলে এবং পাবলিক সেটা খায়। শুরুতে সবাই খিল্লি করলেও সে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষের অবদমিত যৌন বাসনার সামাজিক সমস্যা বিষয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা ঝাড়ে। কোনওরকম interruption ছাড়াই। ঝাড়তে পেরে সেদিনের মতো তৃপ্তির কোটা পূরণ করে ফেলে। একইরকম পচা গরম নিয়ে বাড়ি ফেরে, নিয়মমতো গা ধোয় এবং ড্রইংয়ে এসে বসে। ঘরে যায় না। সেখানে রোজকার মতো মহড়া চলে। আজ প্রৌঢ়ের হাতে গল্পের বই “ডলু নদীর হাওয়া এবং অন্যান্য গল্প”। একটানা পড়ে, রমা বিরক্ত হয় — কারণ টিভি চালানো যায় না, পাশের ঘরে কান পাতলে একই রকম “বাহ্”, “বাহ্” আওয়াজ শোনা যায়। প্রৌঢ় গলির ভ্যাপসা হাওয়ার কটু গন্ধে পাক খেতে থাকে। সহসা জানলায় পিচিক্ একটু হাওয়া দিলে বুকের সাদা লোমে সে আনমনে হাত বোলায়, বইটা ভাঁজ করে এবং রমাকে দুটো শসা কাটতে বলে। আজ সে দুটো নয়, একটা গেলাসে মাল ঢালে। দ্বিতীয় সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই বউ দরজা ঠেলে বাইরে আসে। হয়তো আর একবার রিয়েল লাইফে ‘বাহ্’ বলার ইচ্ছে নিয়েই বাইরে আসে। প্রৌঢ়কে দেখেই বিরক্ত হয়, অজান্তে হাত দুটো ঝাঁকায় আর বলে ওঠে — “আজকেও আবার……!” একদলা থুতুর মতো থপ্ করে কথাটা গেলাসে ভাসতে থাকে। টিপসিটা ঘেঁটে যায় আর প্রৌঢ় বিড়বিড় করে — “শালা চিয়ার লিডার ……”!! আস্তে বললেও শোনা যায়। “রোজ রোজ”, “শালা”, “বিরক্ত লাগে”, “তোমার কী”, “সে তো বলবেই”, “চিয়ার লিডার”, “ছেঁড়া গেছে” — ইত্যাদি শব্দগুলো ঘরময় দাপাদাপি করে। অতিরিক্ত সিগারেট পান বা অন্য কোনও কারণে প্রৌঢ়ের শ্বাসকষ্ট হয়। ভ্যাপসা ঘরটার বায়ুমণ্ডলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ O2-র বদ্ধমূল বোঝাপড়া হারাতেই থাকে। সবারই শ্বাসকষ্ট হয়।
“একেকটা দিন ঝড় ওঠে
সূর্যকে গ্রাস করে বিশাল প্রলয়
ডানা ঝাপ্টায় পাখী বন্ধ খাঁচায়”
মঙ্গলবার। ঘুম ভাঙা জানলায় এই ভরা জ্যৈষ্ঠে আষাঢ়ে মেঘ। ভিজে, আলগা আলো চোখে আরামের সুরমা টানে। অচেনা শীত শীত অনুভূতি বিছানার বন্ধুতায় আপ্লুত হয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে। হঠাৎ অনেক আবোলতাবোল মনে পড়তেই থাকে। নাছোড়। বয়স কমতে থাকে বিছানায় শুয়ে শুয়েই। উষ্মী ফিরে আসে আবার। আরও কারা যেন ফিরে আসে। তপ্ত, ভাজা ভাজা সময়কে মন্ত্রবলে উড়িয়ে জেগে ওঠে কোন এক অলৌকিক দিনমান। সে ঝটিতি বিছানা ছাড়ে। প্রথমবারের জন্য দাঁত মাজতে ভুলে গিয়ে কোনওরকমে নেমে আসে রাস্তায়, বাড়ির মোড়ে ঝুঁকে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালে লেগে থাকা আগুন চোখ টানে। জামা গোজা নেই, গলায় ঝুলছে না আই কার্ড। জুতোর বদলে চপ্পল। মৃদু ঝড় ওঠে, কাগজের ঠোঙাগুলো পাক খেতে খেতে উড়ে যায়, উড়তে থাকে এলোমেলো। কখনও টানটান হাওয়ার আদরে, কখনও আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ে। আনন্দ নাড়ুর মতো গোলগাল বৃত্তপথে নয়, অথবা ইস্ত্রিঘষা সরলরৈখিক নিয়ম থোড়াই কেয়ার করে ওরা ভেসে যায় নিজস্ব নিয়মে। একদিন তুলো তুলো পিঙ্ক স্লিপ এভাবেই উড়ে আসতে দেখেছিল এক ডেস্ক থেকে আর এক ডেস্কে। প্রৌঢ় বুঝতে পারে — মৃদু অথবা দমকা বাতাসকে নিয়ন্ত্রিত পথে কখনও বইতে দেখা যায়নি। নাছোড়বান্দা অবাঞ্ছিত এক সময়ের কবলে পড়ে মঙ্গলবার। ঢুকে পড়ে অলৌকিক বাতাস যাত্রার ঘূর্ণিপাকে। সন্তানের চিবুকের মতো নরম লাইন আঁকা হতে থাকে পায়ে পায়ে। উদভ্রান্ত ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন পৌঁছে যায় বেলেঘাটা লেক। বৃষ্টিভেজা টুপটাপ জলবিন্দু আঁকড়ে থাকে শরীর। চিবুকের ছোট্ট তিলটা টলটলে তাকিয়ে থাকে। শিরিষ গাছ চুঁইয়ে অনন্ত বাষ্প তখন মেঘ হয়ে দৃষ্টিকে ক্রমশ নরম করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে অক্ষ-দ্রাঘিমার সীমান্তরেখা পেরিয়ে বাতাস যাত্রায় সে পাড়ি দেয় অনাঘ্রাত এক প্লাবনভূমির উপকণ্ঠে। বুড়ো বটগাছটা ওকে চিনতে পারে আর ডেকে এনে বসায়। কিশোর ছেলেটি মাটিকে চুম্বন করে। পকেট থেকে মিনি মাউথ অর্গানটা বের করলে, হাওয়ার ধাক্কায় সুর বেজে ওঠে — “হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা…”। দিঘির জলে হাওয়া আর নরম রোদ্দুরের খুনসুটিতে ঝিলিমিলি একাকার। শুকনো পাতা ভাসতে থাকে, ভাসতেই থাকে। চোখ বুজে আসে। তারপর অনেকটা সময় — প্রহর, ঋতু, বছর পেরিয়ে সে চোখ মেলে দেখে, বয়স্ক হয়ে ওঠা কোনও এক মঙ্গলবার। চেয়ে দেখে — জল ভেঙে উঠে আসছে লিটল মারমেট। কেশরাশিতে লেগে আছে ঘন সবুজ শৈবাল। তার কান্না পায়। দু’ডানার জল ঝেড়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে জলকন্যা। হাতে তুলে আনা শুকনো পাতা। টপ্ করে আওয়াজ হয়। এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে পাতায়। কার চোখ থেকে জানা যায় না।
প্রৌঢ় ফিরে আসে। কখন যে ফিরে আসে, তার হদিশ কেউ দিতে পারে না। কেন ফিরে এল — সেটাও তার নিজের কাছে আর পরিষ্কার থাকে না। শুধু সে উপলব্ধি করে উঠতে পারে — কোথায় ফিরে এসেছে। স্প্রিং খুবলে যাওয়া সোফাটায় একটানা বসে থেকে, বসে থেকে থেকে তার পাছার বামদিকে ব্যথার অনুষঙ্গ জাগে। এই ব্যথা বোধ তাকে জলকন্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রৌঢ়ের সমস্ত দিনটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিম্বা সত্যি সে স্বপ্ন দেখছিল কিনা, সে ব্যাপারেও সে বা অন্য কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। শুধু ভ্যাপসা গরমটা আবার অনুভূত হয়। একটা বৃষ্টিদিনের পরেও কেন যে সন্ধ্যাবেলা আবার প্যাচপ্যাচে গরমটা ফিরে এল, নীচের ঠেকে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ চলে। উত্তেজিত বিতর্কের টুকরোটাকরা, চারতলার জানলা দিয়ে প্রৌঢ়ের কানে পৌছায়। সে অন্তত এটুকু বুঝতে পারে যে বৃষ্টি হয়েছিল। তার ঠেকে গিয়ে বসার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু বৃষ্টিসংক্রান্ত আলোচনার কথা মনে করে সে ভীত হয়ে ওঠে। কারণ তার মনে পড়ে — সে স্বপ্নে অথবা বাস্তবে আজ বৃষ্টিতে ভিজেছিল। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যবর্তী শূন্যতায় তার চেতনা কাটা ঘুড়ির মতো চেত্তা খেতে খেতে ভেসে থাকে। উঠে গিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চোখে চশমা না থাকায় সমস্ত অবয়ব ঝাপসা লাগে। তারপর ধীর পায়ে চশমা আনতে যাওয়ার সময়, সারাদিনে প্রথমবার সে পায়ের পুরনো ব্যথাটা টের পায় এবং সামান্য খোঁড়ায়। চশমা পরিহিত প্রৌঢ় কতক্ষণ এবং কেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তা ঠেকের তর্করত লোকজন বা বেডরুমের কেউ টের পায় না। শুধু রমা তাকে বারবার গালে হাত বোলাতে দেখে। তার দ্বারা কিছুতেই প্রমাণ হয় না যে সে কোনও জলের দাগ, বিশেষভাবে বললে চোখের জলের দাগ খোঁজার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তারপর প্রৌঢ়কে আবার সোফার পুরনো জায়গায় বসে থাকতে দেখে রমা রান্নায় মন দেয়। সিগারেট ধরানোর জন্য লাইটার খুঁজতে জামার পকেটে হাত ঢোকালে, একটা শুকনো পাতা লাইটারের সাথে বেরিয়ে আসে। পাতাটা হাতে নিয়ে সে আবার আয়নায় ফেরে এবং গালে হাত দিলে উষ্ণতা অনুভূত হয়।
প্রৌঢ় রমাকে আবার শসা কাটতে বলে।