বাজার ও পিগম্যালিয়ন

শতাব্দী দাশ

 

শাওয়ার-এর তলায় দাঁড়িয়ে ক্লান্তি ধুচ্ছিল সুষেণ। সারা গায়ে বিজবিজ করছিল জলের কণা। ক্লান্তি ধুচ্ছিল নাকি এমনিই সুখের ধারাস্নান? চাটার্ড এসি বাসে যাতায়াতে কি আদৌ ক্লান্ত হয় সে? বিরাট শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত অফিস-বাসটা তাকে তোলে তার হাজরার বাড়ির সামনে থেকে। রোজ তার পেটের ভিতর ঢুকে সে নির্দিষ্ট সিটে গা এলিয়ে দেয়। পেন্সিল স্কার্ট পরা মৌ ‘হাই’ বলে বাঁদিকের রো থেকে। বিজয়েন্দ্র টাই-টা ঢিলে করে নিয়ে মৃদু হাসে। তারপর সুষেণ কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে নেয়। গানে মনোনিবেশ করার আগেই মনে প’ড়ে যায়, নিজের গাড়ি হয়নি এখনও। মধ্য-ত্রিশ পেরোনোর আগেই হবে নিশ্চয়। এভাবেই সপ্তাহে পাঁচদিন কাটে।

কার্ড ঘষে অফিসে ঢোকার সময় যেদিন পিছন থেকে পিয়া বা নিকিতা বলে — ‘ক্যায়া প্ল্যান হ্যায়! টিজিআইএফ হ্যায় না ইয়ার!’ — সেদিন সুষেণ বোঝে, উইকেন্ড এসে গেল। কর্পোরেটে টিজিআইএফ মানে ‘থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে!’ অতঃপর রুটিনমাফিক বার হপিং। লাল নীল আলোদের জ্বলা নেভা, দু-তিনটে শটের পর হালকা কিছু স্খলন, কথা জড়িয়ে আসা, মুখহীন মেয়েদের গালে আলতো চুমু। এবং নড়বড়ে পায়ে বাড়ি ফেরা৷ দোতলায় বাবামার ঘরে এসব দিনে আর উঁকি মারে না সুষেণ। মদ নিয়ে লুকোছাপা নেই, স্রেফ মুখোমুখি না হওয়ার মধ্যবিত্ত কার্টেসি। তিনতলায় সুষেণের নিজস্ব ঘর। পৈতৃক ভিটেটা বাবা-কাকারা ভাগ করেছেন উল্লম্বভাবে। প্রতি তলায় ঘর পাওয়া গেছে একটা বা দুটো৷ তিনতলার আস্তানাটা সুষেণ রিহ্যাশ করেছে খানিক। এসি বসেছে। পাল্টেছে খড়কি দেওয়া দরজা-জানালা। বাথরুম ওয়াশরুম হয়েছে। পশ কোনও এলাকায় তিন বা চার রুমের ফ্ল্যাট দেখে উঠে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এতেই চালিয়ে নিতে হবে।

একলা হলেই আজকাল গাড়ি বা বাড়ির চিন্তা মাথায় ঘোরে, লক্ষ করল সুষেণ। অথচ বিদেশের যুৎসই প্রজেক্ট মিলছে না! ক্লান্তি নয়, আসলে ধারাস্নানে উৎকণ্ঠা মুছছিল সুষেণ শুক্রবারের রাতে। এ মাসের মধ্যে স্থির হবে তার আগামী প্রজেক্ট। বিজয়েন্দ্র গতকাল পেয়ে গেল, পিয়া আজ। সুষেণ এখনও পেল না। পাবে তো আদৌ? কোথায় পাবে? দেশে না বিদেশে? পারফরমেন্সের পারা হু হু চড়ছে না তার৷ গা থেকে ঘষে ঘষে নিরাপত্তাহীনতা তুলছিল সুষেণ৷

আপাতত জলের ধারা নামছিল তার ঘাড়ের বাঁক বেয়ে। ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরের উপত্যকায়। মহার্ঘ শ্যাম্পুর প্রলেপ বোলাচ্ছিল সে নিখুঁত চুলের ছাঁটের উপর। অভিজাত এক সালোঁয় এক মিজো ক্রিশ্চান মহিলার কাঁচি এই চুলকে বাহার দিয়েছিল। সে সালোঁয় তাকে প্রথম নিয়ে গেছিল অফিসের বিজয়েন্দ্র। সুষেণ চিরকেলে শহুরে, ইংলিশ মিডিয়াম। কিন্তু যেদিন নিজের বহুজাতিক অফিসে সে প্রথম পা দিয়েছিল, সেদিন নিজেকে ম্লান,অনুজ্জ্বল লেগেছিল তার৷ বিজয়েন্দ্র তাকে অফিসের কাচের দেওয়াল, স্বয়ংক্রিয় দরজা, মুখ-দেখা মেঝের মতো চকচকে করার দায়িত্ব নিয়েছিল। শ্যাম্পুর পর ক্যাবিনেট থেকে বেরোল শাওয়ার জেল। হাতের আলগা টানে পিচ্ছিল জেল ছড়িয়ে গেল বুকের খাঁজে, দু বাহুতে, নিম্নাঙ্গে। নিজের শরীরের আনাচে কানাচে হাত দিতে দিতে নেশাতুর সুষেণের কাম জাগল। শরীর শিরশির করল খানিক।

গা মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে ল্যাপটপটা অন করল সুষেণ। একবার ফোনে ফেসবুক খুলে দেখে নিল, কারা রাত জাগে। টুং টাং করে আছড়ে পড়ল দুচারটে মেসেজ। সুষেণ স্ক্রোল ডাউন করছে, নামতে নামতে তিতিরের সংক্ষিপ্ত ‘হাই’-এ থামল সে। কলেজের মেয়ে, ফেসবুকেই চেনাজানা। তিতির ভানহীন ও সপাট। নতুন ডিপিটা বড় করে দেখল সুষেণ। এই টানটান লাস্যের সাথে তার দেখা হতেই পারত। কিন্তু তিতির দেখা করতে চাইলেই সুষেণ কথা ঘোরায়। আসলে সে মুখোমুখি হতে চায় না। সপ্রতিভ মেয়েটির সামনে যে মাঝে মাঝে হীনম্মন্যতায় কুঁকড়ে যায় সে, তা ভার্চুয়ালে লুকিয়ে ফেলা সহজ৷ ওরকম ঝকঝকে মেয়েদের সে পছন্দ করে, ভয়ও পায়।

অফিসের মৌ লিফটে কাঁধ খামচে ধরেছিল সেদিন। সুষেণও জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। মৌ একা থাকে শহরে, ফাঁকাই পাওয়া যেত ওর ফ্ল্যাট। কিন্তু সুষেণের ইচ্ছে করেনি। ল্যাদ হয়েছিল। কীসে আটকায় তার? সুষেণের কখনও স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল না কোনও। কিন্তু ক্যাজুয়াল কিছু ওয়ান-নাইট-স্ট্যান্ডে সে বুঝেছে, বিছানায় নারী জেগে উঠতে না উঠতেই উৎকণ্ঠা গ্রাস করে তাকে। খিদে চলে যায়। যন্ত্রবৎ পারফর্ম করে সে। যেন একটা প্রজেক্ট, যেন প্রমাণ করতে হবে তার সক্ষমতা, যেন তার পারা-না-পারার উপর নির্ভর করছে একটা চড়াই-উৎরাই গ্রাফ, যেন ফুটে যাবে না পারলে। যেন মেয়েটি তাকে রেট করছে –এ প্লাস, এ, বি… এমনও তো হতে পারে, ‘ভালো না পারলে’ চেনা মেয়েটি সার্কেলে রটিয়ে দেবে তার যৌন দক্ষতার অভাবের কিসসা? তার পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ নিয়ে বারোয়ারি আলোচনা হতে পারে না? যে কোনও রক্তমাংসের মানুষের সামনে নগ্ন হতে ভয় পায় সুষেণ।

তিতিরের সাথে তাই দূরত্ব রাখে ও। তারা উন্মত্ত আদর করে কিলবিলে অক্ষরে। তিতির ভিজে ওঠার কথা বলে। সুষেণের পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হয়৷ তাদের সেক্সটিং-এর সম্পর্ক প্রায় একবছর যাবৎ। কিন্তু সুষেণের অন্যমনস্কতার মাঝে তিতির আজ ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে চলে গেছে। শুক্রবার রাতে নিরামিষ শুয়ে পড়ার মেয়ে সে নয়, সুষেণ জানে। অন্য কারও সাথে আদর-বিনিময় হচ্ছে আজ। সুষেণ চুক চুক করে। কম্পিটিশন! সর্বত্র কম্পিটিশন! আবার সবুজ অনলাইন-সংকেত-বিন্দুর সারিতে চোখ বোলায় সে।

**********

ল্যাপটপ চালু হয়েছে এতক্ষণে। এক্সভিডিওজ-এ প্রায় প্রতিবর্তেই ক্লিক করে সে। তিতিরকে দুচারটে খিস্তি দিতে দিতে প্রিভিউ দেখে কতগুলি নীল ছবির। পাঁচদিনের চাপানউতোরের পর সুখের উইকেন্ড। ফ্যান্টাসির পরাবাস্তব কি প্রগলভ তিতিরের চেয়েও ভালো নয়?

ফ্রি-সাইটে বেরসিক বিজ্ঞাপনের আনাগোনা লেগেই থাকে। ক্রস করতে করতে এগোয় সুষেণ। ঠিক সেই সময় একটা মোম-পিছলানো শরীরে চোখ আটকায় তার। এটি যে বিজ্ঞাপন, তা প্রথমে বোঝেনি। রেগুলার পর্ন ভেবে ক্লিক করে। নতুন কোনও পর্নস্টার? মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘বাঁ…’ ক্যামেরা তখন নিখুঁত নারী-শরীরের উপরে অতি ধীরে চলাচল করছে৷ প্যান করে ধরছে নারীর নাভিমূল!

একটা হাত নারী-শরীরের আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করছে। হাতের মালিক কিন্তু অগোচরে। কিছুক্ষণ হাতের চলাচল দেখে ভ্রু কোঁচকায় সুষেণ। এভাবে তো কনফারেন্স রুমে প্রেজেন্টেশন দেয় সে! শায়িত নারী যেন বিক্রয়যোগ্য বস্তু। হাতটি আসলে সেইভাবে ঘোরাফেরা করছে নারীশরীরে, যেভাবে স্ক্রিনের ওপর ঘোরাফেরা করে সুষেণের পয়েন্টার। এ হাত তো কামাতুর পুরুষের হাত নয়, এ হাত ব্যবসায়ীর! ভল্যুম বাড়ায় সুষেণ। মনোনিবেশ করে ভাষ্যে।

শুনেই সে চমকে ওঠে! এই তবে না-মানুষী আশ্চর্য সেই পুতুল! জাপানি কোম্পানি যৌন পুত্তলি বেচছে। সুষেণ শুনেছিল সেক্স-ডলের কথা। কিন্তু ও যে ম্যানিকুইন নয়, একেবারেই মানুষের মতো! কিংবা মানবীর চেয়ে আরও উত্তেজক, আরও মনোলোভা! ক্যামেরা এখন চলাচল করছে স্ফুরিত ওষ্ঠাধর ঘিরে। ঠোঁটের প্রতিটা খাঁজ নিখুঁত গোলাপী! ঠোঁটে হাত বোলায় পুতুল বিক্রেতা, পেলবতা আর কোমলতা সম্পর্কিত দুচারটে বাক্য খরচ করে।

পেটের কাছের চামড়ায় তারপর টান দিল অশরীরী হাত। নিভাঁজ চামড়া ঈষৎ তরঙ্গায়িত হয়ে শরীরকে পারফেক্ট আকার দিল আবার। হাঁ করে দেখছে সুষেণ। এমন শরীর সে দেখেছে কি কখনও? মদের ঘোরেও নিকিতা, পরী বা পিয়াকে কখনও এমন দমবন্ধ সুন্দর লেগেছ? পুতুলের বাদামী উত্তুঙ্গ স্তনবৃন্তকে এবার দেখাচ্ছে হাত। তাদের মোচড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো৷ এভাবে পিয়ার বৃন্তও একদিন সে… তার স্তনগুলি যদিও ছিল ঈষৎ আনত।

টিপেটুপে সিলকন নিতম্বও দেখাল বেচনেওয়ালা। সুডৌল দুটি নরম বৃত্ত ডানা মেলেছে অক্ষরেখার দুপাশে। বেচুবাবু বোঝাচ্ছে, সিলিকন মুখ পাওয়া যাবে ছ’টি, সঙ্গে মানানসই ছ’টি উইগ। একঘেয়ে লাগলে রাতে রাতে বদলে নেওয়া যেতে পারে সঙ্গিনীর মুখ, চুল বা তিলের অবস্থান।

অদৃশ্য বিক্রেতা এবার পুতুলের দুই উরুতে থাবা বসায়৷ টেনে ফাঁক করে পা-দুটিকে; দেখাতে চায় কতদূর ফাঁক করা যায় এবং কত সহজে। অনিচ্ছুক নারীর মতো নয় এই অবনারী। সামান্য আয়াসেই তার দুই পা কাঁচির দুটি লিভারের মতো দুদিকে ছড়িয়ে যায়। তারপর নির্লোম গোপন প্রদেশে অবশেষে যোনি দেখা যায়। মৃদু নেশার ঘোরে পুতুলের যোনি দর্শন করে সুষেণ অস্থির বোধ করে। সমাজ-সংসার-প্রজেক্ট-বিদেশস্বপ্ন-দামী স্কচ-নারী সব তুচ্ছ মনে হয়৷ তার সমস্ত চেতনা শরীরের নিম্নদেশে কোথাও কেন্দ্রীভূত হয়। সে কাঠিন্য অনুভব করে নিজের হাত দিয়ে। বেচনেওয়ালা হাত তখনও ফাঁক করছে নারীর পা-যুগল, করেই চলেছে। সেই সঙ্গে প্রসারিত হচ্ছে তার যৌনাঙ্গের গহ্বর। সুষেণ যেন সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে ঢুকে যাবে সেই ব্ল্যাক হোলে। বেচুবাবু বলছেন – ‘আ পারফেক্ট বিয়ার ক্যান ভ্যাজাইনা।’

********

কৃষ্ণগহ্বরে ক্যামেরা জুম ইন করলে সুষেণ পজ টেপে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাথা ঝিমঝিম করে। এসির রিমোট টিপে ঘরটা আরও শীতল করে নেয় সে। টেবিলে মোবাইল কেঁপে কেঁপে উঠছে অনেকক্ষণ ধরে৷ ফিরে এসেছে তিতির। মেসেজ পপ আপ করে। ‘হাই হানি! ওয়ানা নো হোয়াট আয়াম ওয়েরিং টুনাইট?’ উৎসাহ পায় না সুষেণ৷ তিতিরের উঁচু দাঁতগুলোর মধ্যে অশ্লীল ফাঁক। সে কামাতুরা কুক্কুরির মতো সদা-উন্মুখ। আলাপ শুরু হতে না হতেই ওয়েব ক্যাম অন করে৷ বিভাজিকায় যে তিলটি দেখিয়েছে সেটি আসল না কালিতে আঁকা? সন্দেহ হয় সুষেণের।

আরেকটি মেসেজ আছে বিশাখার৷ ‘নন্দনে ভালো ছবি এসেছে। যাবি?’ এই মেয়ে স্কুলের সহপাঠিনী। এখন কোনও নিউজ মিডিয়ায় কাজ করে। সহপাঠীরাও জানত, বিশাখার সুষেণকে ভারি পছন্দ। বিশাখার ঈষৎ পৃথুল শরীর থেকে অবজ্ঞায় চোখ সরায় সুষেণ।

এতদিনে খুঁজে পাওয়া গেছে মানসসুন্দরীকে। তার কামনার আধার! অনেক ভেবে সে ঠিক করে, ওরকম একটি পুতুল তার চাই-ই চাই! সুন্দরী কাস্টমাইজ করা যায় না? ধরা যাক, ফ্যাটফ্যাটে সাদার বদলে গমরঙা, ফ্যাকাশের বদলে কালো চোখ, আরেকটু ভারি পাছা? সাইট-টি মিনিমাইজ ক’রে সুষেণ অনলাইন বিপণি হাতড়ায় একের পর এক। কী করে পাওয়া যাবে ওরকম? কেউ বলছে ‘উই আর রানিং আউট অফ স্টক।’ কেউ অপেক্ষা করতে বলছে মাসখানেক। সুষেণ দেখল, এক জায়গায় ‘ইন্টেলিজেন্ট’ সেক্স ডলও মিলবে তেমন টাকা খসালে। সে সাড়া দেবে, উত্তেজিত হবে। পাল্টা আদরও দিতে পারে। সেই সাথে সকালের চা বানানোর প্রোগ্রামিং ফ্রি। এমনটা কি চাইছে সুষেণ?  চাইছে কি? হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ… ভাবছে সুষেণ , ভাবছে। নাহ্! যেমন নিষ্ক্রিয়, নিস্পন্দ পুতুল দেখেছিল, ওরকমই চায় সে। ওরকমই একদম। সুষেণ আজ রাতে স্থির উপলব্ধি করে, ছেনালি তার ভালো লাগে না। সে একটা শরীর চায়, খাবলে-খুবলে ছিন্নভিন্ন করার জন্য। পাল্টা আঁচড়-কামড়ে তার প্রয়োজন নেই। এমনকি শীৎকারও তাকে উত্তেজিত করে না। বরং মিইয়ে দেয়। সঙ্গিনীর যে কোনও স্বাধীন হাত পা ছোঁড়াতেই সে প্রত্যয়ের অভাব বোধ করে।

বেটাইমে মা এসে দরজায় ধাক্কা মারে। ‘খোকা, খেয়ে এসেছিস?’

‘হ্যাঁ’।’

‘দরজা লাগিয়ে কী করিস? খোল না। দুটো কথা বলি।’

সুষেণ যার-পর-নাই বিরক্ত হয়।

‘ঘুম পাচ্ছে মা!’

‘দরকারি কথা খোকা!’

অগত্যা সুষেণ ল্যাপটপ মুড়ে রাখে। বড় ঝুলের একটা টিশার্ট গলিয়ে নেয় তার দার্ঢ্যকে ঢাকতে। মা এসে খাটে বসে। দেওয়ালে ঝোলানো এসির দিকে কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়! সুষেণের মনে পড়ে, এবছর মাবাবার ঘরেও এসি লাগিয়ে দিতে হবে। ইলেক্ট্রিকের বিল আসবে কিছু বেশি।

মা তার আপন পিসির মাসতুতো ননদের বন্ধুর মেয়েকে নিয়ে অসংলগ্ন কিছু বলতে থাকে। উচ্চশিক্ষিতা, সবর্ণ পাল্টিঘর… সুষেণ এবার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

‘মা প্লিজ, তুমি জানো শুক্রবার আমি… মাটি কোরো না তো!’

মা মুখ কালো করে উঠে দাঁড়ায়। ‘শুক্রবার আমি’-র পর ‘মাল খাই’ শব্দদুটো অনুচ্চারিত থেকেও ভুরভুর করতে থাকে এসি ঘরে। মা অন্তর্হিত হয়।

********

মা বোঝে না, সম্পর্ক ভাঙে, প্রেম ভাঙে, বিয়ে ভাঙে, কিন্তু ন্যায্য মূল্যে কেনা জড়বস্তু হতে পারে আজীবন-সঙ্গী। ঠিক সঙ্গীও নয় — দখলদারি, পজেশন, প্রপার্টি। ওরকম একটি যোনি, স্তন, নিতম্ব কিনতে পারলে কোর্টশিপের হ্যাপা নেই, মন জুগিয়ে চলার প্রয়োজন নেই, একগামিতার ভান নেই, ইচ্ছে না করলে ফোরপ্লে নেই, পারফরমেন্স নিয়ে উৎকণ্ঠা নেই! মুক্তি! তার নিজস্ব তিনতলার কোটরে সে মুক্তি খুঁজে নিতে পারে রোজ৷ সমাজবিচ্যুত, পরিবারবিচ্যুত, সম্পর্কবিহীন, প্রেমবিহীন একাকীত্বে যেরকম মুক্তি!

বহুদিনই তো একা সুষেণ! অফিসের খেয়োখেয়িতে একা। এসি বাসে ইয়ারপ্লাগ কানে একা। বাবা-মা বা কাকাদের গুষ্টি থাকতেও তিনতলার রিহ্যাশড ঘরে একা। ডান্স ফ্লোরে সঙ্গিনীর কোমরে হাত রেখে একা। একাকীত্বের চর্চা তার আকৈশোর। স্কুল-কলেজে ছিল নির্দিষ্ট ট্র‍্যাকে দৌড়দৌড়ি৷ পিস্তল ঊর্ধ্বমুখে গুলি ছোঁড়া মাত্র সেই যে দৌড়তে শুরু করত সে, ডান বা বাম পাশের ট্র‍্যাকের রানারদের মুখও দেখা হত না ভালোভাবে। ফিনিশিং লাইনে মা-বাবার উৎকণ্ঠিত চোখ৷ তা সত্ত্বেও কোনোক্রমে আলগা বন্ধু জুটে গেছিল যে কজন, ত্রিশের পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷ অনেকেই তারা ‘ওদেশে’। অথচ ‘ওদেশে’-র প্রজেক্টে আজও দাঁত বসাতে পারল না সুষেণ ৷ অগত্যা সেই সব কোনও-এক-কালের বন্ধুদের আজ ঈর্ষা করে সে। আবার যারা তার মতো স্টেটাসের কর্পোরেটেও ঠাঁই পায়নি, তারা ঈর্ষা করে না কি তাকেও? আবশ্যিক কিছু গেট টুগেদারে ঈর্ষার গ্রন্থি তাদের বেঁধে বেঁধে রাখে।

বিশাখা নামে যে মেয়ে তাকে প্রথম কৈশোর থেকে ভালোবাসত, তাকেও ভালোবাসতে পারেনি সে। একবার বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা, একবার কদমগাছের তলায় চুমু বালিগঞ্জ সার্কুলারে। এর বেশি আর কী বা পাওয়ার ছিল ওই মেয়ের কাছে? এর বেশি কীই বা দেওয়ার? এত শান্ত, নিবেদিত একটি মেয়ে — ওকে দেখে কাম জাগে না। বা কলুষিত করতে ইচ্ছে হয় না ওকে। বিশাখাকে সে বিয়ে করতে পারত। ধরা যাক, করল। কিন্তু তারপর যদি প্রজেক্ট ম্যানেজার মহিলার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাতে হয়, ফাঁকা পেলে আলতো জড়িয়ে ধরতে হয় টিমলিডার মেয়েটিকে — তাহলে বিশাখার মুখ মনে পড়ত না? পাপবোধ হত না তার? সব অপরাধবোধ, সব দায়, সব ন্যায়-নীতি থেকে মুক্তির চিন্তাই তাকে উত্তেজিত করে একমাত্র! তাতেই তো অর্গ্যাজম!

********

কয়েক সপ্তাহ পরে, শুক্রবার, একটি পার্সেল এসে পৌঁছয় হাজরা রোডের বাড়িতে। মাকে বলাই ছিল। কাগজে সই করে রিসিভ করে মা। জানতে পারে না অবশ্য, বধূবরণ করছে। ওরা কাঁধে করে তিনতলায় তুলে দিয়ে যায় বাক্সটা। মা নিজের হাতে ছেলের রেখে যাওয়া পাউচ থেকে টাকা মেটায়। কিন্তু ভেবে পায় না, কী এমন জিনিস, যার জন্য প্রায় মাইনের সিংহভাগ খরচা করে ফেলল ছেলে! গজগজ করতে করতে মা দোতলার ঘরে ঢোকে।

সেদিনও স্খলিত পায়ে বাড়ি ফেরে সুষেণ। দোতলাটা এড়িয়ে পৌঁছয় সোজা তিনতলার ঘরে। মহার্ঘ মোড়ক হেলান দিয়ে আছে আলমারিতে, আলগোছে। সুষেণ দরজা বন্ধ করে। জামা খোলে। স্নান সারে। উলঙ্গ বেরোয় সে তার হাড়-জিরজিরে, পৈতৃক বাড়ির রিহ্যাশড ওয়াশরুম থেকে। গা মোছে। মোড়কসহ বাক্সকে বিছানায় শোওয়ায়। যত্ন করে খুলে ফ্যালে ব্রাউন পেপার। বাক্সের গায়ে লেখা ‘কনগ্র‍্যাচুলেশন!’ সেই অশরীরী হাত লিখেছে কি? আরও কিছু লেখা যেন! ধোঁয়া ধোঁয়া দৃষ্টিতে সুষেণ দেখে, লেখা আছে, ‘প্লাস্টিক লাভ লাস্টস ফর এভার!’

সুষেণ নিশ্চিন্ত বোধ করে।

এবার সে ঢাকনা সরায়। অতিরিক্ত টাকা ঢেলে তৈরি মনোমত পুতুল। নিজস্ব ফেটিশমাফিক। গম রঙ। কালো চোখ। ছোট চুল। ছোট করে ছাঁটা চুলে কিছু ফেটিশ ছিল তার। বিশাখা ক্লাস টুয়েলভে চুল ছেঁটে ফেলেছিল তা জেনে। বোকা মেয়ে! সুষেণ হাসে। নিশ্চল নারীর গায়ে হাত রাখে সে। তার গা ঘেঁষে শোয়৷ কোমর জড়িয়ে বাক্স থেকে টেনে তোলে তাকে। বিছানায় পাতে তার শরীর৷ হাত-পা-গুলো নেড়েচেড়ে দ্যাখে। চোখদুটি শূন্যদৃষ্টি। বাকি সবকিছুতেই সেই না-মানুষী মানুষীর চেয়ে সুন্দরতর। এই যে কোমরের বাঁকে বা ঘাড়ে তিল-তাতে সুষেণের কতদিনের মুগ্ধতা! মুগ্ধতা ছিল ঈষৎ পুরু অধরেও। প্রতি ইঞ্চে তার ফ্যান্টাসি ও ফেটিশ মতো তৈরি হয়েছে এ’নারী। নিজেকে পুরাণের পিগম্যালিয়ন মনে হয় সুষেণের, উত্তর-মানবিক এক কাস্টমাইজড এন্ড প্রডাক্টের শরীর খুঁড়তে খুঁড়তে। ‘ফেটিশ’-এর কথায় তার মনে পড়ে, ‘কমোডিটি ফেটিশ’ বলে এক নতুন শব্দ সে শুনেছে অফিসে, কোনও কামশাস্ত্রে এখনও যার উল্লেখ নেই।

উঁচু থেকে একটা অদৃশ্য ক্যামেরা সুষেণের বদ্ধ ঘরটাকে ধরছে এখন। তার দুহাত যখন সাধের পুতুল নিয়ে খেলা করছে ইচ্ছেমতো, তখন অন্য একটি অশরীরী হাত ফিতে দিয়ে মেপে নিচ্ছে সুষেণের ফ্যান্টাসি, ফেটিশ, কাম, যৌনতা ও এতদিন লুকিয়ে রাখা নিজস্ব নগ্নতা। এসব ফেলা হবে স্ক্যানারের তলায় আলবাত। তারপর এমন হাজার হাজার কাস্টমারের চাহিদার গড় করে তৈরি হবে পরবর্তী প্রডাক্ট।

সুষেণের চার-দেওয়ালে, বিছানার চারিদিকে, একজন দুজন করে মানুষের আনগোনা বাড়ে। একটা বাজার গড়ে ওঠে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. অদ্ভুত ভালো চাবুকের মতো লেখা। আগে আপনার লেখা পড়িনি। এবার থেকে নিয়মিত পড়ব।

  2. বা:, বেশ ভালো লাগলো। লেখার স্টাইলটাও ক্রিস্প!

  3. সুপ্রাবন্ধিক শতাব্দীর এক অভিনন্দনযোগ্য সম্প্রসারণ। দু’জন যে একই লোক তা চেনা যায়। তবে গল্পটা প্রিচি নয়। ভালো লাগল।

আপনার মতামত...