অভিজিৎ মুখার্জি
নালন্দা, তক্ষশিলা ছাড়া পরিত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দেখার কোনও সুযোগ করে নেওয়া সম্ভব? আজকাল ওভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার মত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা, নানা কারণে, কমিয়ে আনা গেছে। আমার কিন্তু একবার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সুদূর জাপানে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবছর পড়িয়েছিলাম। তার বহু বছর পরে আরেকবার সেই ক্যাম্পাসে ফেরত যেতে হয়েছিল একটা উপলক্ষ্যে, তবে এবার মাত্র একমাসের জন্য। ওমা, গিয়ে তো চক্ষুস্থির! পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জনশূন্য। যেখানে যেখানে খানিকটা ফাঁকা জমিতে লন-এর মতো ছিল আগেরবার, এখন সেখানে লম্বা লম্বা ঘাস, সেই ঘাসের মাঝখানে আগাছায় ফুটে আছে কিছু বুনো ফুল। আর, খুব মৌমাছি উড়ছে, নিঃশব্দ জনহীন ক্যাম্পাসে তাদের ওড়ার শব্দ দূর থেকেও পাওয়া যায়। একটা ভিজে ভিজে উদাসীনতা যেন ক্যাম্পাসটার মধ্যে। সে আমাকে কিছু মনে করিয়ে দিল না, চিনতেই পারেনি হয়তো অতদিন পরে। আমাকেই মনে করতে হল স্মৃতি সামান্য হাতড়ে, কেমন কেমন দৃশ্য আমি দেখেছিলাম একসময় ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলমুখর এই বাড়িগুলোর করিডরে, রাস্তায়, ক্যান্টিনে, কিছু বিশেষ বিশেষ অবস্থানে, যেখান দিয়ে নিত্য যাতায়াত করতে হত। কী কী অভিজ্ঞতার স্মৃতি এখনও সচেতনভাবে রয়ে গেছে, খেয়াল করার চেষ্টা করলাম। নিজের গরজেই যেন করলাম।
আসলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টা উঠে যায়নি, সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বেশ কয়েক মাইল দূরে একটা পাহাড়ের ওপরে। বহু টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল ঝকঝকে নতুন ক্যাম্পাস, স্থাপত্যের ভারি দৃষ্টিনন্দন এক প্রদর্শনী। কেবল, আমি যে ল্যাবোরেটরিটাতে গিয়েছিলাম, তাদের বেশ কিছু ভারি যন্ত্রপাতি যেমনভাবে সেট করা ছিল, তাতে ঠিক তখনই হাত দিলে জরুরি কাজে বিঘ্ন ঘটবে বলে সেইটেই কেবলমাত্র পুরনো ক্যাম্পাসে রয়ে গেছিল। শহরের চৌহদ্দির মধ্যেই এক কিনারায় পুরনো ক্যাম্পাস যে ডেভেলপারের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, তারাও রাজি হয়ে গিয়েছিল ওই ল্যাবোরেটরিকে কিছুদিন ওখানেই থাকতে দিতে। গ্রীষ্মাবকাশে আমি যখন ওখানে গিয়েছি, গবেষক যে ক’জন ওখানে কাজ করে, অধিকাংশই বিদেশি, তারা ছুটি কাটাতে গিয়েছিল দেশে, আর তাই আমি গিয়ে মুখোমুখি হলাম ওরকম পরিস্থিতির।
কিন্তু আমার কেন গরজ তৈরি হয়েছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে করার, ঠিক কী কী স্মৃতি আমার জড়িয়ে রয়েছে সেই একদা কলহাস্যমুখর ক্যাম্পাসের ভিতরে এখানে সেখানে? অহং! আজকাল ইংরিজিতে বললে যেন লোকের বুঝতে সুবিধে হয়—সেন্স অব সেলফ। যত মামুলি যোগ্যতার মানুষই হই, জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি একত্র হয়েই তো আমার নিজের কাছে আমার জীবনটার মূল্যায়ণ। যদি না মানসিক অবসাদে, চূড়ান্ত গ্লানিতে জীবনকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়, সেসব ছবি তো আমার অস্তিত্বের মতোই সংরক্ষণযোগ্য, তাদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। সেটাই স্বাভাবিক ইন্সটিংকট, সহজাত প্রবৃত্তি।
খেয়াল করে দেখেছি, একেকটা বিশেষ বিশেষ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে যে স্মৃতিগুলো ওখানকার সঙ্গে মিশে আছে, সেগুলো শেষ বিচারে কোনও না কোনও মানুষ, প্রাণী বা উদ্ভিদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া। খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনে আনার চেষ্টা করেও, আমার নিজের ক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলের ক্লাসরুমে কোনও বিষয় শেখার যে প্রক্রিয়া, তার প্রায় কোনোই স্পষ্ট স্মৃতি নেই (কেমন ছাত্র ছিলাম, এর থেকেই অনুমান করতে পারছেন)। আছে মাস্টারমশাইয়ের অগোচরে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসির বা খুনসুটির স্মৃতি, মাস্টারমশাইর কুপিত হয়ে পড়ার বা একজন মাস্টারমশাইর যে ভাবমূর্তি, তার বাইরে গিয়ে কোনও আবেগ প্রকাশ করার স্মৃতি। আমি যে মূলত পড়াশুনোর জন্য স্কুলে গিয়ে বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছিলাম বা আরেকটু সত্যি করে বললে বলতে হয়, আমাকে যে ভর্তি করা হয়েছিল, তার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে ক’টা মার্কশিট আর সার্টিফিকেটের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। অথচ যেসব স্মৃতি সারাজীবন ধরে সবচেয়ে বেশিবার করে চারণ করে যাব, আমার বন্ধু, সহপাঠীরাও করবে, সেসব তো সেই স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়েরই নানা ছোটখাটো ঘটনার স্মৃতিই! এর কারণ সম্ভবত এই যে স্মৃতিমাত্রেই মানুষের সঙ্গে, প্রাণীর সঙ্গে, গাছের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি হয়ে তবে স্থায়ী হয়। বিখ্যাত আইবিস ট্রিলজির ‘ফ্লাড অব ফায়ার’ উপন্যাসে অমিতাভ ঘোষ লিখেছেন :
“It is madness to think that knowing a language and reading a few books can create allegiances between people. Thoughts, books, ideas, words – if anything, they make you more alone, because they destroy whatever instinctive loyalties you may once have possessed.”
সহজাত আনুগত্যের, স্নেহের, সহমর্মিতার বন্ধন ছাড়া কি বাঁচা যায়? স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যে আমির আবরণ নিজের ওপর চাপানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বহন করি, তার কাউন্টার পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ঐ দিনগুলোকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে কিছু মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, যাদের অ্যাকাডেমিক মূল্যায়ণ করার প্রশ্ন ওঠে না। প্রতিটি শিক্ষায়তনে এই ভূমিকাটা প্রতিটি মুহূর্তে পালন করে যায় এই মিলনদা, সত্যেনদা, নাথুদা, ও এরকমই আরো ক’জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে যাদের ক্যান্টিনে গিয়ে রোজ ভিড় করেছি ছাত্রাবস্থায়।
আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ছিলাম, ছাত্রাবস্থায় মিলনদা’র ক্যান্টিনে খুব বেশিবার যাওয়ার উপলক্ষ ঘটেনি। আমরা যেতাম সত্যেনদা’র ক্যান্টিনে। সত্যেনদা’র তখন বয়েস হয়েছে, মোটাসোটা শ্লথগতি মানুষ, ব্যক্তিত্ব নিয়ে কোথাও একটা চুপচাপ বসে থাকতেন। ছাত্রদের সঙ্গে আদিখ্যেতা করে হার্দ্য আচরণ করার কোনও দায় তার মধ্যে মোটেই দেখা যেত না। বরং কখনো সখনো ধমক দিয়ে উঠতেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের তবু গিয়ে তার সঙ্গে দুটো অপ্রয়োজনীয় ফাজলামো না করে এলে চলত না, নিদেনপক্ষে মামুলি দুটো বাক্য বিনিময় করে আসার কী যেন দায় ছিল। মিলনদা’র ক্যান্টিনে মাঝেমাঝে যাওয়ার উপলক্ষ ঘটল যখন আর্টস ফ্যাকাল্টিতে স্কুল অব ল্যাংগুয়েজেস-এর সঙ্গে খানিকটা কর্মসূত্রে জড়িত হয়ে পড়লাম, তখন থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন কর্মরত থাকার সূত্রে বেশ ক’জন সুহৃদ তখন তৈরি হয়ে গেছেন আর্টস ফ্যাকাল্টিতেও। কোনও কাজে ওদিকে গিয়ে, খানিক আড্ডা দিয়ে আসার সুযোগ খুঁজতে উঁকি দিতাম গিয়ে মিলনদা’র ক্যান্টিনে। ইনি কিন্তু মোটেই মোটাসোটা নন, ছিপছিপেই বলা যায়, চোখেমুখে উদাসীনতা আনার কোনও চেষ্টা ছিল না, রোজ যাদের দেখেন না, এমন কেউ কাউন্টারে এসে দাঁড়ালে একটু বেশিই অভিনিবেশ করে শুনে নিতেন তার কী প্রয়োজন। দেখেই বোঝা যেত ইনি বাঙাল। ঠিক কী লক্ষণ দেখে যে সেটা বোঝা যেত, বুঝিয়ে বলতে পারব না। সত্যেনদা যে ঘটি ছিলেন, সেও কেমন যেন আপনিই বোঝা যেত। একটা কথা বলে রাখি : ‘সত্যেনদা’ কিংবা ‘মিলনদা’ বললে কিন্তু মোটেই কোনও দুজন ব্যক্তিকে বোঝাত না। ওদুটো মূলত ক্যান্টিন। এক ছাত্র আরেক ছাত্রকে বলত, “ঠিক আছে, চারটের সময় সত্যেনদা চল।” কিংবা আমি আর্টস ফ্যাকাল্টিতে কোনও সহকর্মীকে ফোনে বলে রাখলাম, “দুটো আড়াইটায় ওদিকে একবার যাব। তোমার ক্লাস আছে? না হলে মিলনদা।”
মাস্টারমশাই বা ছাত্রদের কথা ছেড়েই দিলাম। যাঁরা পাশটাশ করে অন্যত্র চলে গেছেন, বেশ ক’বছর বাদে বাদে কখনও ইচ্ছে বা ফুরসত হয় ইউনিভার্সিটিতে একবার ঢুঁ মেরে যাবার, তাঁরা জানেন যে গিয়ে চেনামুখ খুব বেশি দেখা যাবে না। পুরনো মাস্টারমশাই যাঁরা চেনা, তাঁরাও সেইদিন বিদেশে বা অন্য শহরে কর্মোপলক্ষে থাকতে পারেন। তবে কীসের ভরসায় যাওয়া, কোন স্মৃতিকে আরেকবার ছুঁয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের একটা অংশ যে এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে তার নিশ্চিত আশ্বাস? কেন, সত্যেনদা, মিলনদা! যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকে নিজের কাছে নিজের যে ছবি তার একটা অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেন, তাঁরা সময়ে সময়ে আসবেন, বিভাগীয় রি-ইউনিয়নে আসবেন, আর সেই সুযোগে একবারটি মিলনদায়, সত্যেনদায় উঁকি না দিয়ে পারবেন? নিজেদের মধ্যে আলোচনায় কতবার যে উচ্চারণ করবেন, মিলনদা কিংবা সত্যেনদা! নতুনদের কাছে বেশি বেশি করে সেকথা তুলবেন। ওই নামগুলোতেই তো টিঁকে আছে এক অগ্রন্থিত কাহিনী, অদেখা বন্ধন। তার বন্ধনগুলো দিয়ে দিয়েই তো মানুষটাকে লোকে চেনে। প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই। আর তাই ওই নামগুলো বড্ড দামি। বারবার উচ্চারণ করতেই হবে, নইলে আমরাই যে নেই হয়ে যাব একেবারে নিকট ভবিষ্যতের কাছেই। রুশদি তাঁর ‘শেম’ উপন্যাসে বলেছিলেন, নাম জিনিসটা তো আসলে অতীতের সঙ্গে একটা যোগসূত্র। এমন একটা নাম, যা ছাত্ররা সবাই অহরহ ব্যবহার করেছে, সেটাকে তো বারবার মনে করাতেই হবে, নইলে সেই সময়টা, সেই সময়ের মানুষেরা সকলেই ‘নেই’ হয়ে যাবে যে!