অলোক বিশ্বাস
চলে গেলেন বাংলা কবিতার আর এক নিবেদিত প্রাণ। নিত্য মালাকার। ছয়-এর দশকের কবি হিসেবে পরিচিত। যদিও তাঁর প্রসারিত লেখালেখি সাতের দশক থেকে। তরুণ বয়সে চলে এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। সেখানকার মুক্তিযুদ্ধের আগেই। ছয়ের দশকে। সরাসরি এসে পৌঁছন নবদ্বীপে। নবদ্বীপেই তাঁর কবি হিসেবে জাগরণ। সম্প্রতি বাংলা কবিতার জগতে প্রয়াণ সংখ্যায় যুক্ত হল কবি নিত্য মালাকার। এর আগে আমরা সম্প্রতি হারিয়েছি কয়েকজন অপর ধারার কবিকে। মণীন্দ্র গুপ্ত, স্বদেশ সেন, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, বারীন ঘোষাল, অরুণ বসু, সমীর রায়চৌধুরী, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তম দাশ, উৎপলকুমার বসু, আলোক সরকার প্রমুখকে।
১৯৪৭ সালের ১৮ই অগাস্ট নিত্যদার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই অর্থাৎ ৬০-এর শুরুতেই চলে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ ছেড়ে। নবদ্বীপে শুরু হল তাঁর বসবাস অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে। তাঁর রক্তেই ছিল কবিতা। এবং সেই কবিতার ভাবনা প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরেই। নবদ্বীপে পেয়ে গেলেন কয়েকজন কবি বন্ধুকে। তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন কবি অরুণ বসু। বন্ধু হিসাবে পেলেন আজকের পাঠকপ্রিয় কবি দেবদাস আচার্যকে। অরুণ বসু প্রকাশ করলেন কবিতার কাগজ ‘পালাবদল’, যা পরে ‘অজ্ঞাতবাস’ নামে রূপান্তরিত হয়। অথবা একটি সম্পূর্ণ অন্যধারার লেখালেখির পত্রিকা হিসাবে প্রকাশ ‘অজ্ঞাতবাস’-এর। কবি নিত্য মালাকার এইসব পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হয়েও ছিলেন অবিচ্ছিন্ন এক কবিতাকর্মী। নবদ্বীপে তো সেই ছয়ের দশকে অন্যান্য কবি বন্ধুর সঙ্গে কবিতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন নিবিড়ভাবে। ধীরে ধীরে হাংরি আন্দোলনের কবিদের সংস্পর্শে চলে আসেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অরুণেশ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবো আচার্য, কালীকৃষ্ণ গুহ প্রমুখের সঙ্গে। একজন কবির বন্ধুত্বের তালিকায় কাদের নাম আছে, সেটা থেকে সেই কবির কবিতা সম্পর্কিত ধারণার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয়।
ইদানিং নিত্যদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমে এসেছিল। বিশেষ কোনো কারণ নেই তাতে। নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় দেখা হয়েছে প্রতিবার এবং তখনই দীর্ঘ কথা হত মুখোমুখি। মুখোমুখি যেভাবে খোলামনে কমিউনিকেট করা যায়, সেটা ফোনে হয় না। যখনই কবিতা ক্যাম্পাসের জন্য লেখা চেয়েছি, নিত্যদার কাছ থেকে পেয়েছি। প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন। বেশিরভাগটাই ফোনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেইসব অগ্রজ কবিদের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখি, যাঁরা তরুণদের লেখালেখির ব্যাপারে নতুনকে সাপোর্ট দেন। তরুণদের মনের কাছাকাছি নেমে এসে এগিয়ে থাকা ভাষায় ও ভাবনায় কথা বলেন। কবি নিত্য মালাকার-এর এ ব্যাপারে কোনো ইগো ছিল না। তাঁর কবিতায় ছিল তরুণ মনের উল্লাস, তরুণ মনের অমলতাস। ১৯৯৯ সালে কবিতা ক্যাম্পাসের বইমেলা সংখ্যায় লিখলেন দুটো কবিতা। ‘আজ’ শিরোনামে কবিতার কিছু পংক্তি আমাদের হন্ট করে যায় — ‘আমি তো সকল দেখছি অতীব সুলভ/উপুড় কলস জল গরীবের পাখি আর মরজন্ম চাঁদ/ভেতরে অনেক পাপ ভেতরে অনেক পুণ্য কী-তীব্র গভীর/হাসছে কুকুর-প্রাণ পথের দিনের আর আত্মজীবনীর ।’ নিত্যদা প্রচুর লিখতেন না। হঠাৎ নির্দেশ পেয়ে লেখা ছিল তাঁর দুঃসাধ্য। সেকারণে হয়তো তাঁর কবিতার গ্রন্থের সংখ্যা বেশি নয়। মাত্র ৬-৭টি।এর থেকে বেশিরভাগটা নিয়েই সেলিম মণ্ডল নির্বাচিত সংগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কবিতা ক্যাম্পাস ২০১২ সালের বইমেলা সংখ্যায় অদ্ভুত এক কবিতা ভাবনা লিখেছিলেন নিত্যদা। লেখাটা শুরু করেন এভাবে — ‘আমার কবিতা আসলে নিজের সঙ্গে আলাপ, দিনলিপির সামিল। বস্তুত, সরাসরি একথা উচ্চারণের ভিতরে একটা আত্মপ্রচারের টক গন্ধ আছে। আর, এটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ফেললাম। সে-প্রায় কিঞ্চিদধিক দুবছর আগের এক ডায়েরির পাতায় লেখা উদ্ধৃত ঐ প্রগলভ বাক্য।’ দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে যাপন করতে করতে দেখেছি নিত্যদার কবিতার পাঠকের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। প্রায় সব ধরনের পাঠক নিত্যদার কবিতার কমিউনিকেশনে কমফোর্ট ফিল করে এসেছে। আমাদের মতো যাঁরা প্রচলিত পদ্যমার্কা পেলব ন্যালক্যাবলা কবিতার নুনকুনুনকু দোলা কবিতার তীব্র বিরোধী, তাঁদেরকেও বলতে হয়েছে নিত্যদার টেক্সট বাজারি টেক্সট থেকে আলাদা। কারণ নিত্যদার যাপনটাই ছিল আলাদা। এক কবিতাময় যাপন। এই যাপনে ছিল কবিতার সত্য সন্ধান। অনেকে যেমন বলে ফেলেন আমি কী লিখছি নিজে ভালো করে জানি না। পাঠকরাই বলবেন, এগুলো আদৌ লেখা হল কিনা। এই আত্মবিশ্বাসের অভাব নিত্যদার ছিল না কোনোদিন।
২০১৫ সালে কবিতা ক্যাম্পাসের উৎসব সংখ্যায় যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন তার মধ্যে তাঁর কবিতা বিষয়ক ভাবনার প্রতিফলন ছিল। ‘আমার কবিতা’ শিরোনামে লেখাটার পুরোটাই এখানে উদ্ধার করি — ‘আমার প্রতিটি কবিতাই চর্যাচর্যের দিনলিপি/প্রতিটি কবিতাই সেই ক্লান্তিকর আত্মখনন/দিনদিন প্রতিদিন এবং রাত্রিসুখ/সমভিব্যাহারে অর্জিত/আমার প্রতিটি কবিতাই কোনো না কোনোভাবে/প্রত্যুত্তরের বার্তা/প্রতিটি কবিতাই আমি এবং সমভিব্যাহারী তুমি/প্রতিটি কবিতাই দুরূহপথে ভ্রমণের যাপনের/অনিঃশেষ নিঃস্বতার স্মৃতি।’ কখনো কবিতা লিখেছেন অদ্ভুত সাধুভাষা প্রয়োগ করে। এই প্রবণতা আমি লক্ষ করেছি সাতের দশকের কবি প্রশান্ত গুহমজুমদারের কবিতায়।
নবদ্বীপ থেকে মাথাভাঙ্গায়। চাকরি পেয়ে যাওয়ার কারণে। স্কুলের স্বল্প মাইনের চাকরি। তাই দিয়ে কোনো প্রকারে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন টিনের চালের কুটির বানিয়ে। কিন্তু দারিদ্রের মধ্যেও কবিতা লেখা আর কবিতার আড্ডা কোনোদিন থেমে যায়নি। তরুণ কবিদের সঙ্গে চলে গেছেন ডুয়ার্সের জঙ্গলে, খয়েরবাড়ি জঙ্গলে, মাদারিহাট, জলদাপাড়ায়। কবিতার আড্ডা দিতে ছুটে তরুণদের সঙ্গে মানসাই নদীর ধারে, ছুটুঙ্গু নদীর ধারে। আজ ১লা অগাস্ট সেই ছুটুঙ্গু নদীর তীরে শ্মশানে দাহ করা হল কবি নিত্য মালাকারকে বিকেলবেলায়। মাথাভাঙ্গার তরুণ কবিরা অনেকেই ছিলেন কবির সৎকারের মুহূর্তে। ৮০র শেষের দিকে তিনি নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যান মাথাভাঙ্গায়। চাকরির কারণে। তাঁর বিবাহের মধ্যেও ছিল এক চমক। তিন কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার। বড় কন্যার বিবাহ হয় কবি ও তিতির পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় সাহার সঙ্গে মাথাভাঙ্গায়। যতদূর জানি দ্বিতীয় কন্যার বিবাহ হয়েছে উত্তরবঙ্গ সংবাদের ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে আর তৃতীয় কন্যা চাকরিরত। কবিতাটাই ছিল তাঁর সার্বিক যাপন। দরমার বেড়া দেওয়া বাড়ি পাকা বাড়িতে পরিণত হলেও সর্বক্ষণের কবিতার আবেশ থেকে কোনোদিন মুক্তি ঘটেনি তাঁর। পুরনো বাড়ির সেই শিউলি ফুলের গাছটি নিয়ে তাঁর অনেক শখ ছিল কিছু লিখে যাওয়ার। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না সেভাবে। হসপিটালে ভর্তি থাকাকালীন সেই শিউলি গাছ যেন তাঁর সাথে কথা বলে গেছে। তাকে হন্ট করেছে বারবার। ভেবেছিলেন বাড়ি ফিরে নিশ্চিত শিউলি গাছটি নিয়ে অবশ্যই কিছু লিখে উঠতে পারবেন। মাথাভাঙ্গার কবি বন্ধুদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন। দেবাশিস দত্ত, সুবীর সরকার, অনুভব সরকার, সন্তোষ সিংহ আর তাঁকে পাবে না কবিতার আড্ডায়। আজ ফেসবুক খুলতেই দেখলাম দুই বাংলার কত কবি পাঠক তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত। তুমুল প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে তাঁর কবিতা এক দিক নির্দেশক হয়ে থাকবে। যদিও তাঁর নতুন কবিতা প্রকাশের আর কোনো সুযোগ রইল না আমাদের মতো চুনোপুঁটি আন্তরিক সম্পাদকদের। ছুটুঙ্গু নদীর তীরে জ্বলন্ত চিতার রাস্তা ধরে তিনি চলে গেলেন হয়ত কবিতার আর এক সাম্রাজ্যে। না, তাঁকে তো আমরা যেতে দেব না। কারণ তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের হৃদয়ের আসঙ্গ। পড়ে নিচ্ছি পুনরায় সেইসব পংক্তি যা আমাদের অবসেসড করে রাখে। কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১৫র উৎসব সংখ্যায় ‘জন্মদিন’ কবিতায় — ‘লজ্জা ও আত্মাধিকারে আমি ফ্রেম ভেঙে/ছবিটিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ি, খাই/ইদানীং প্রতিটি দিনকেই আমি/জন্মদিন ভেবে/নিজেকে উদযাপন করি অনর্থকম শোকে।’ অত্যন্ত বন্ধুবৎসল কবি নিত্য মালাকারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন সার্থক করে তুলতে আসুন আমরা হাতে তুলে নিই তাঁর রেখে যাওয়া অনিবার্য অক্ষরগুলিকে, যেখানে জীবনের চারপাশ প্রাণময় হয়ে আছে।
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এইরকমই। স্বতঃস্ফূর্ত আর ভালোবাসামাখা।
তবে আমাদের সেই নদীর নামটি সুতঙ্গা। ছুটুঙ্গু বলে কাউকে ডাকতেও শুনিনি।
শ্রদ্ধা।
কবি নিত্য মালাকার বহুল পাঠ দাবি করেন। আমরা যারা তার প্রয়াণের পর কিংবা এর কিছুকাল আগেই মাত্র তাকে পড়তে পেরেছি কিছুটা, আমাদের কবিতার জগতে বিচরণেরই একটা পদ্ধতিগত ভুল। এইসব ছকভাঙা, চিন্তাচেতনায় একদম কবিরাই কবিতার প্রকৃত ধারক।