বিষাণ বসু
১১ই আগস্ট। আজকের দিনটিই। ঠিক এক বছর আগে।
মানুষের স্মৃতিশক্তি বড় কম। হাজার কথার ভিড়ে, তথ্যবিস্ফোরণের ঠেলায়, দু’সপ্তাহ আগের কথাই মনে পড়ে না, সেখানে এক বছর!!
একটু মনে করিয়ে দিই।
গোরক্ষপুর। উত্তরপ্রদেশ। বিআরডি হাসপাতাল। শিশুবিভাগ। মারা যেতে শুরু করে কিছু শিশু। সংখ্যাটা বেড়ে ষাট পার হয়ে যায়।
দেশ জুড়ে হইচই পড়ে যায়।
মিডিয়ার সুবাদে সারা দেশের সামনে ভেসে আসে একটি মুখ। ডাঃ কাফিল খান।
জানা যায়, মৃত্যুর প্রধান কারণ, অক্সিজেনের অভাব। হাসপাতালের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে দেন অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থা।
ডাঃ কাফিল খান, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে, যোগাড় করেন বেশ কিছু সিলিন্ডার। সেটুকু না হলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে কত দাঁড়াত, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। সরকারি গাফিলতির বিষয়টিও প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কাফিলই।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, স্বাস্থ্যপ্রশাসনের অপদার্থতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, এক একক চিকিৎসকের লড়াই। বলিউডের মাপেও অবিশ্বাস্য। লার্জার-দ্যান-লাইফ হিরো হয়ে ওঠেন কাফিল।
অনুসন্ধানের গভীরে গিয়ে উঠে আসে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। কেমন করে অনেকবার মনে করালেও অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থার বিল মেটানো হয় না, কেমন করে হাসপাতাল প্রশাসনের কর্তার মদত থাকে অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থার নিয়োগে, কেমন করে অভিযুক্ত অফিসার ফিরে আসেন স্বাস্থ্যপ্রশাসনের শীর্ষ পদে — দুর্নীতি, ঘোলাজল, অপদার্থতা, অসংবেদী মানসিকতা, গাফিলতি — কথা বাড়াচ্ছি না, কেননা, এই নিয়ে আগেও লিখেছি, বিস্তারে।
দেশ জুড়ে ছিছিকার উঠলে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামেন স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ। না, মৃত্যুর মূল কারণ খতিয়ে দেখা নয়। উদ্দেশ্য, বলির পাঁঠা খোঁজা।
যোগীজির প্রশাসনের ব্যর্থতার বিপরীতে হিরো হয়ে ওঠা ডাঃ কাফিল খান। এঁর চাইতে ভালো বলির পাঁঠা কোথায়?
কলেজের প্রিন্সিপাল ডাঃ রাজীব মিশ্র, তাঁর স্ত্রী ডাঃ পূর্ণিমা মিশ্র, এনাস্থেশিয়া বিভাগের প্রধান ডাঃ সতীশ, আর অবশ্যই, ডাঃ কাফিল খান। সব মিলিয়ে নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়।
২রা সেপ্টেম্বর। গ্রেফতার হন কাফিল। শিশুরোগবিশেষজ্ঞ কাফিল নিজের ছোট বাচ্চাটিকে ছেড়ে জেলবন্দি হন। অভিযোগ স্পষ্ট নয়। কাফিলকে কোর্টে তোলার বিরুদ্ধেও সরকারের গড়িমসি প্রায় নজিরবিহীন। অন্যান্য সব বন্দির থেকে কাফিলকে রাখা হয় আলাদা। অন্যত্র। মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েন কাফিল।
জেলের বাইরে কাফিলের পরিবার সামাজিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। এতটাই, যে, কাফিলের স্ত্রী, ছোট্ট বাচ্চাটিকে নিয়ে শহর থাকে দূরে বাপের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হন।
এরকমই চলতে থাকে। চলেও যেত এমনভাবেই। কিন্তু, পরিবারের সবার সাথে প্রতিবাদে যোগ দেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন গণসংগঠন।
চাপের মুখে সরকার ধাক্কা খায়।
এলাহাবাদ হাইকোর্টে, ডাঃ কাফিল খান জামিন পান, এই বছরের ২৪শে এপ্রিল তারিখে। প্রায় সাড়ে সাত মাসেরও বেশি হাজতবাসের পর।
ঘটনার মাত্র তিনদিন বাদেই, ১৪ই আগস্ট, সঞ্জয় শর্মা, সত্যিটা জানতে, তথ্যের অধিকার আইনে, সরকারের কাছে আবেদন করেন।
যে সরকার সত্যানুসন্ধানের চাইতে সত্য ধামাচাপা-দোষারোপে বিশ্বাসী, তারা সহজে উত্তর দেবেন, এতটা আশা যিনি করেন, তার শিশুসুলভ সারল্যে চমৎকৃত না হয়ে উপায় থাকে না।
না, সঞ্জয় সহজে ছাড়বার পাত্র নন। তিনি দ্বারস্থ হন তথ্য কমিশনের।
জুলাই মাসে, অর্থাৎ আবেদনের প্রায় একবছরের মাথায়, উত্তর আসে।
কী সেই উত্তর?
আপনি এক বছর ধরেই যা জানতেন।
হ্যাঁ, সরকার মানতে, স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, বিআরডি হাসপাতালে, সেই রাতে অক্সিজেনের ঘাটতি ছিল। হ্যাঁ, ডাঃ কাফিল খান, একক প্রয়াসে যোগাড় করেন কমপক্ষে দশটি সিলিন্ডার। ছয়টি আনন্দলোক নার্সিংহোম থেকে, অন্তত চারটি বিভিন্ন জায়গা থেকে।
আপনি নিশ্চিন্ত? ভাবছেন মধুরেণ সমাপয়েৎ?
এতগুলো শিশুর মৃত্যুর দায় যাঁদের, তাঁরা শাস্তি পাবেন না?
যে মানুষটা একক দায়িত্বে অক্সিজেন যুগিয়ে বাঁচালেন আরও অনেক শিশুর প্রাণ, তিনি নিদারুণ অপমানে-অসম্মানে জেলে থেকে নির্যাতন সইলেন, এই অপরাধের শাস্তি হবে না??!!
কে দায়িত্ব নেবেন?
নিদেনপক্ষে যোগী আদিত্যনাথ? যিনি, প্রকাশ্যেই, কাফিলকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন? আর, বাস্তবে করেও দেখিয়েছিলেন??
আসন্ন স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের আগে, নিজের গেরুয়া বসনখানি ঠিক করার আগে, যোগীজি কি একবার আয়নার দিকে তাকাবেন? তাকাবেন নিজের চোখের দিকে?
আপনি? আপনিও কি নিশ্চিন্তে থাকবেন? থাকতে পারবেন?