সত্যব্রত ঘোষ
কর্মেই মানুষের পরিচয়। সেই কর্মের প্রভাব যদি অসংখ্যজন অনুভব করে, তবে তাঁর জন্মকথা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছাপূরণ এবং ব্যর্থতার বৃত্তান্ত নিয়ে অন্যদের কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতিসমূহ, যা ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, এবং বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। দাক্ষিণাত্যের সমাজকে যারা দ্রাবিড়ীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের প্রমুখ হোতাদের শেষজন বর্ষীয়ান মুত্থুভেল করুণানিধি-র প্রয়াণ ঘটল সম্প্রতি। ইরোড ভেঙ্কাটাপ্পা (পেরিয়ার) রামস্বামী এবং সি এন আন্নাদুরাই-এর সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের সমাজমন্থনে যে মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, লোকপ্রিয় সেই ‘কলাইনার’ (কলাগুরু)-র অন্যতম পরিচয় ছিল সমাজ ও জনগণের হৃদয়কে আলোড়িত করবার মতো শক্তিশালী লেখনী, যা তাঁর সূক্ষ্ম বিচারশক্তি থেকে উৎসারিত। ভারতবর্ষের নির্বাচনকেন্দ্রিক জোটরাজনীতিতে নিজের প্রাসঙ্গিকতাকে তিনি সবসময়ে জাগ্রত রেখেছিলেন নানা বাধা-বিপত্তি ব্যতিরেকে।
না, নিছক শ্রদ্ধাঞ্জলির জন্য এই রচনা নয়। কারণ করুণানিধির মৃত্যুর পর মেরিনা বিচে একদা সহকর্মীদের পাশে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা নিয়ে যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, সেই অভিঘাতে এর উৎস। জন্ম থেকে আমরা যারা গাঙ্গেয় রাজনীতির পাকপ্যাচালিতে অভ্যস্ত হয়েছি, তাঁদের পক্ষে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক চেতনার সামগ্রিক পরিচয় একটু স্বতন্ত্র বটে। কারণ, দ্রাবিড়ীয় আকাঙ্ক্ষাগুলিকে দক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক ধারা আর্যাবর্তের আধিপত্যকামী মনোভাবের বিপ্রতীপ রূপেই উপস্থাপন করে এসেছে। কিন্তু তার বিশ্লেষণও এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। এখানে ১৯৯৬-৯৭ সালে নির্মিত ‘ইরুভর’ নামে এক তামিল চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট বিবৃত হবে, যা ভারতীয় সিনেমা ইতিহাসে এক মাইলফলকও বটে।
সময়টি ছিল উত্তাল। আক্ষরিক অর্থে, ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে। মূলস্রোতে দর্শকধন্য হিন্দি সিনেমা নির্মাণে পাঁচের দশক থেকেই ভাসান, জেমিনি, বিজয়া, পদ্মালয় এবং প্রসাদ স্টুডিয়োর মতো তৎকালীন মাদ্রাজের প্রমুখ প্রযোজকরা যথেষ্ট অর্থ লগ্নি করেছেন, তাঁদের শিল্পী এবং কলাকুশলীরা হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে পরিচিতিও পেয়েছে যথেষ্ট। সঙ্গীত জগতে আলোড়ন ফেলেছেন এ আর রহমান। ‘রোজা’ এবং পরবর্তীকালে ‘বোম্বে’ দেখে সদ্যতরুণ প্রতিভাবান রহমানের আবিষ্কর্তা মণি রত্নমকেও আপামর ভারতবাসী ভালোবেসেছেন। তখন পর্দায় দর্শকরা মারামারি এবং গানের দৃশ্যের চমকদারিত্বে অভিভূত। সরল নিটোল চিত্রনাট্য এবং চরিত্র-নির্ভর পারিবারিক নাট্যসমৃদ্ধ সিনেমার প্রতি তাঁদের বিশেষ উৎসাহ নেই। কারণ চলচ্চিত্র জগতে প্রযুক্তিকে করে তোলা হচ্ছে মধ্যমণি। প্রযুক্তিকে ছলে-বলে-কৌশলে ব্যবহারের অজুহাত হয়ে উঠছে একের পর এক ভারতীয় সিনেমা। দর্শকসমাজ এই কারিগরি চমকদারিত্বে এমন অভিভূত, যে ছবিগুলি শিল্পগুণসম্পন্ন হয়ে উঠছে কিনা, তা বিচারে একেবারেই আগ্রহী নয়। ফলে, সুনিশ্চিত লাভের আশায় প্রযোজকরা প্রয়োজনীয় অর্থলগ্নি করতে একটুও দ্বিধা করছেন না।
মাদ্রাজে “মণি স্যার’ নামে ইতিমধ্যেই খ্যাত এই মধ্যবয়সী ম্যানেজমেন্ট ছাত্র থেকে চিত্রপরিচালক হয়ে ওঠা গোপালা রত্নম সুব্রামানিয়ম আয়ার এই চমকদারিত্বে আর সৃজনশীলতার উত্তেজনা অনুভব করছেন না। ‘বোম্বে’র অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার পর তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন তামিলনাডুর দুই (প্রকৃতপক্ষে তিন) প্রধান রাজনৈতিক চরিত্রদের জীবনচিত্রনে। তিনি ধরেই নিয়েছেন যেভাবে তিনি ছবিটি বানাবেন বলে স্থির করেছেন, তা মানুষের পছন্দ হবে না। তবুও তাঁর প্রজ্ঞা এবং দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের একটি অন্যতম ঐতিহাসিক পর্বকে সিনেমার পর্দায় উপস্থাপনের অসীম আগ্রহ তাঁকে পিছু হঠতে দেয় না।
‘ইরুভর’ (মানিকজোড়) যে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তা ছিল মণি রত্নমেরও কল্পনাতীত। দৃঢ়তা, মেধা এবং স্থৈর্যের যে অপরূপ মিলন ঘটেছে এই ছবিতে, যে তার সৌন্দর্য এবং প্রভাব সরকারি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে। এম জি রামচন্দ্রন এবং এম করুণানিধি-র আলাপ-সখ্যতা-শত্রুতার তিক্ত মধুর পর্বগুলিকে অসামান্য সাহস এবং সততার সঙ্গে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছে ‘ইরুভর’। মুক্তিলাভের পর দক্ষিণ ভারতের দর্শক ‘ইরুভর’ দেখতে আগ্রহী হয়নি বটে। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সিনেমাটির কাছে বারবার ফিরে যেতে চাইছেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক সিনেমা মহলে যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছে ‘ইরুভর’। মুক্তির পর থেকেই। ১৯৯৭ সালে জাতীয় পুরস্কারধন্য ‘ইরুভর’ বেলগ্রেড এবং টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দুটিতে যথাক্রমে শ্রেষ্ঠ অটিয়র ফিল্ম এবং মাস্টার সেকশনে পুরস্কার লাভ করে।
মণি রত্নম যখন এই ছবি বানাতে চলেছেন, তখন সিনেমা হলগুলিতে বিশাল পর্দার ‘সিনেমাস্কোপ’ পদ্ধতির রবরবা তুঙ্গে। জনপ্রিয় এই ফরম্যাটটিকে অগ্রাহ্য করে ‘মণি স্যার’ চিরাচরিত ৪ : ৩ অনুপাতে ‘ইরুভর’-এর চিত্রগ্রহণ করতে চাইলে সিনেমার প্রযুক্তিপ্রিয় কলাকুশলীরা একে ‘উন্মাদের কার্যক্রম’ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তাঁরা তখন বিদেশের বিভিন্ন মনোরম স্থানে গানের চিত্রায়নে টাকা খরচ করাটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। কিন্তু দেশের মাটিতে পরম যত্নে সিনেমা বানানোর প্রখর ইচ্ছাশক্তিতে প্রায় সাদা-কালো পুরনো ছবিগুলির মতো করেই চিত্রায়িত হয় ‘ইরুভর’। নেপথ্যে যে বাদ্যযন্ত্রগুলি শোনা যায়, তাতে এ আর রহমান সিন্থেসাইজারের ক্রমাগত ব্যবহারের পরিবর্তে অ্যাকস্টিক ধ্বনির প্রয়োগে বেশি মনযোগী হয়েছেন। সব মিলিয়ে, দৃশ্য ও শব্দে (সঙ্গীতে) ‘ইরুভর’ শুধু সেই সময়েই নয়, পরবর্তীকালের অধিকাংশ ভারতীয় ছবিগুলি থেকে যে স্বতন্ত্র, তা প্রতিপন্ন হয়েছে।
ইদানীং কালে মিলখা সিং, মেরি কম থেকে শুরু করে প্রমুখ জীবন্ত কিংবদন্তিদের নিয়ে ভারতে চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। কিন্তু ছবিগুলিতে তাঁদের জীবনসংগ্রামকে অনেকক্ষেত্রেই একমাত্রিক রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘ইরুভর’ এদের সবার থেকে স্বতন্ত্র। কারণ, কাহিনীর স্বার্থে নাম পরিবর্তন করলেও মণি রত্নম এই ছবির ক্ষেত্রে দর্শকদের বারবার বাস্তব অনুষঙ্গকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। করুণানিধি এবং এম জি আর-এর সম্পর্কের আখ্যান হিসেবেই ‘ইরুভর’ ইতিহাসে স্থান পাবে। তার চেয়েও বড় কথা, দ্রাবিড়ীয় রাজনীতির স্বরূপটিকে অত্যন্ত যত্নে তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
‘ইরুভর’-এ ফেরবার আগে সংক্ষেপে সেই পর্বের ইতিহাসে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। করুণানিধির লেখা চিত্রনাট্যে ‘মারুধানাট্টু ইল্লাভারাসু’ (মারুধার রাজকন্যা) ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫০ সালে। শুধুমাত্র এক বীর যোদ্ধা হিসেবে নয় এম জি রামচন্দ্রন এমন এক নায়ক হিসেবে দর্শকদের মনে স্থান পেলেন যে সমাজের সব দুষ্টের নাশ করবে। দুই বছর পর নায়ক এম জি আর-কে ‘পুরাতচি থালাইভর’ (বিপ্লবী নায়ক) অভিধা দেন করুণানিধি।
ক্রমশ এম জি আর এবং করুণানিধি-র সম্পর্ক এতটাই গভীর হয় যে সর্বসাধারণ তাঁদের মানিকজোড় হিসেবে সম্বোধন করতে শুরু করে। ১৯৫৩ সালে ত্রিচি সম্মেলনে বন্ধু রামচন্দ্রনের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের অবিসংবাদী নেতা সি এন আন্নাদুরাই-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন ডি এম কে-র প্রমুখ সদস্য করুণানিধি। ১৯৬৭ সালে সি এন আন্নাদুরাই তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দুই বছর পর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। করুণানিধির স্থির বিশ্বাস ছিল তাঁকে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (DMK) পার্টির শীর্ষ আসনে বসাবে মানুষ। এবং বন্ধু রামচন্দ্রনের সক্রিয় সহযোগিতায় আন্না-র উত্তরাধিকারী হলেন করুণানিধি। মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর বন্ধু রামচন্দ্রনকে পার্টির কোষাধ্যক্ষ পদ দিলেন করুণানিধি। আন্নাদুরাই-এর আমলে যে পদটি করুণানিধির ছিল। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে ডি এম কে জয়লাভ করলে আবার করুণানিধি মুখ্যমন্ত্রী পদটি বজায় রাখেন। সেইসময়েই মানিকজোড়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে।
রামচন্দ্রন তাঁর ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হোন, কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে দিতে হবে। করুণানিধির এই শর্ত মানতে রাজি নন এম জি আর। পরবর্তীকালে রামচন্দ্রন ডি এম কে’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন।
তিক্ততার এই মুহূর্তগুলিকে পর্দায় অসাধারণ নাটকীয়তায় ফুটিয়ে তুলেছে ‘ইরুভর’। মোহনলাল অভিনীত ‘আনন্দন’ নামে অভিনেতার চরিত্রটি এম জি আর-এর বাস্তব জীবনের মতো গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়। প্রকাশ রাজ অভিনীত তামিজসেলভন (করুণানিধি) চরিত্রটি তার জেদ এবং বন্ধুবিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে বাস্তবের সঙ্গে একাকার করে দেন। পুরোদস্তুর নেতা হিসেবে জনগণের সামনে প্রতীত হবার জন্য এম জি আর (আনন্দন) ১৯৭২ সালে নিজের দল তৈরি করলেন — অল ইন্ডিয়া দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (AIDMK)। তাঁর সঙ্গে ২৮টি সফল ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় সাড়া জাগিয়ে তোলা জয়ললিতা জয়রামকে বানালেন দলের মুখ্য প্রবক্তা। ছবির জগতের মতো, তাঁদের বাস্তব জুটিও জনসাধারণের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। এম জি আরকে ভালোবেসে যারা ‘মানুষের রাজা’ (মাক্কাল থিলাগম) উপাধি দেয়, তারাই জয়ললিতাকে সম্বোধন করতে শুরু করে ‘আম্মা’ নামে।
‘ইরুভর’ শুধুমাত্র দুই বন্ধুর সম্পর্কের বিন্যাসকেই পর্দায় উপস্থাপন করে না। নরনারীর প্রেমকেও ছবিটি নিয়ে যায় দ্বন্দ্বমধুর এক গভীরতায়। দীর্ঘদিনের সহঅভিনেত্রী কল্পনার মধ্যে আনন্দন আবিষ্কার করেন তাঁর মৃতা স্ত্রী পুষ্পাকে। এই যোগসূত্র প্রথমদিকে অস্বস্তি দিলেও ক্রমশ কল্পনার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করেন আনন্দন। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আঙিনায় কল্পনাই হয়ে ওঠে তামিজসেলভন (করুণানিধি) থেকে বিচ্ছিন্ন আনন্দনের দোসর। সদ্য মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জয়ী বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্যা রাইকে পুষ্পা এবং কল্পনার দ্বৈতভূমিকায় সিনেমার পর্দায় প্রথম আবির্ভাব ঘটিয়ে আনন্দনের মতো দর্শকদেরও এক জোর চমক দেন চিত্রনির্মাতা মণি রত্নম।
বাস্তবকে সতত অনুসরণ করে একটি কাহিনীচিত্রের আখ্যানও যে তথ্যের আকর রেখে যেতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ ‘ইরুভর’। আজ যখন এই খ্যাতি-বিষাদ-লাঞ্ছনা-বিদ্বেষ-ক্ষমতালোভী মানুষগুলি শুধুমাত্র স্মৃতি, তাঁদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলিকে বারবার জীবন্ত করে তুলতে সক্ষম ‘মণি স্যার’-এর এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবিটি।
যমুনালাল বাজাজ ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের ছাত্র, গুরু দত্তের সিনেমা দেখে অনুপ্রেরিত যে তামিল যুবক চিত্রনির্মাণে আগ্রহী হয়ে তামিল তথা ভারতীয় সিনেমাকে ঋদ্ধ করেন, সেই মণি রত্নম কখনওই বাণিজ্যিক সিনেমার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। ‘ইরুভর’ প্রসঙ্গে চিত্রসাংবাদিক সুধা উমাশঙ্করকে তিনি বলেন তিনি ছবিতে কোনও চরিত্রকে অসম্মান করেননি, কারণ যে ভাবনাগুলি নিয়ে দ্রাবিড়ীয় আন্দোলনের জন্ম, সেগুলির প্রতি তাঁর এখনও আস্থা আছে। কিন্তু সেই আন্দোলনের গতিপথ ক্রমশ যেভাবে চরিত্রপূজার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, তা নিয়ে ভাবনা থেকেই ‘ইরুভর’-এর জন্ম। ছবি নিয়ে সাধারণ দর্শকদের বিরুদ্ধ মত থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি তাঁদের অবহেলা করেন না। নিজের ভাবনাগুলিকে পর্দায় রূপ দেবার জন্য তিনি নতুন চেষ্টায় মগ্ন থেকেছেন বরাবর। কিন্তু দর্শকদের যদি তা পছন্দ নাও হয়, পুরনো সফল ছবির ধাঁচে আবার ছবি বানাতে তিনি আগ্রহী নন। কারণ সিনেমা এমন এক শিল্প যেখানে সৃজনকার নিত্যনতুন তাঁর চিন্তন এবং সৃজনশক্তিকেই প্রয়োগ করবেন এমনভাবে যাতে সাধারণ দর্শকরা তা গ্রহণ করতে পারেন। ছবি বানানোর সময়ে আদর্শকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আবার ছবি বানানোকালীন সেই কল্পনাগুলির অনেকগুলি যেমন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, তেমন কিছুকে বাদ দিতে হয়। আদর্শের চেয়ে বাস্তব অবস্থা গুরুত্ব পায় বেশি।
মণি রত্নমের কথায় ‘ইরুভর’ জীবনীচিত্র নয়। এখানে বাস্তবতার আত্মাটুকুকে নিয়ে দুই ঘণ্টায় একটি কাহিনী বলা হয়েছে। তার মধ্যেই আছে সত্যিই যা ঘটেছে, তার সবটুকুর নির্যাস। যার মধ্যে চরিত্রগুলি পরিণত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বিবর্তনের মাধ্যমে শীর্ষে পোঁছাচ্ছে যে আদর্শগুলির ভিত্তিতে, ‘ইরুভর’ তার কথাই বলছে। এটিকে যথার্থ রাজনৈতিক সিনেমা বলা যায় না। পাশাপাশি যা কিছু ঘটেছে, তার সমালোচনা বা সেই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ছবিটিতে। ছবিটিতে করুণা (জয়ললিতা) চরিত্রটি নিয়ে সমালোচকদের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু আমি তাঁকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এক বুদ্ধিমতি নারী হিসেবেই দেখেছি, যাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে নিজে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্যাবহুল এক একটি পর্ব অতিক্রম করে সে নিজের সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
ছবিকে একই সঙ্গে শিল্পসম্মত এবং জনপ্রিয় করবার জন্য মণি রত্নম বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দেন সবার বেশি। তা যেন সবার বোধগম্য হয়। সেই বিষয়বস্তুকে তারপর কতটা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে তার যাবতীয় অনুশীলন। বর্তমানে টেলিভিশন এবং আন্তর্জাতিক সিনেমাসম্ভার সুলভে পাওয়ার কারণে দর্শকদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। কাহিনী নির্বাচন করবার সময়ে দর্শকদের এই সজাগ মনটির প্রতি যত্নশীল থাকা প্রয়োজন। আমি যা বলব, তাই সেরা গল্প এবং তার ভিত্তিতে সিনেমা বানাবার জ্ঞানটিও আমার আছে — এমন আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে চিত্রনির্মাণ করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। প্রতিটি ছবিতে চিত্রনির্মাতা যদি তাঁর প্রথম ছবি তৈরির রোমাঞ্চকে অনুভব করেন তাহলে ছবিটি আরেকটি মনে দাগ কেটে যাওয়া সিনেমার মতো নিজেকে এবং অন্যান্যদের আকর্ষণীয় নতুন কাজে উৎসাহ দেবে।