শামিম আহমেদ
কাক কত প্রকার, তুমি জানো লোহিতচন্দ্র?
–পাঁচ প্রকার। তবে লোহিতের সঙ্গে চাঁদটা ঠিক যায় না।
কেন?
–ওটা সকাল বা বিকেলের সূর্য সম্পর্কে বলুন, ঠিক আছে।
ধুর পাগল! লোহিতচন্দ্র আসলে রক্তেন্দু। জানো তো চাঁদের টিবি হয়েছিল।
–গাঁজাখুরি গল্প ছাড়ুন। কাক থেকে চাঁদ, তারপর যক্ষ্মা; এই সব আষাঢ়ে গল্প পরে শুনব। কাজের কথা বলুন।
কাক। বলো, পাঁচ রকমের কাক কারা?
–বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র আর অন্ত্যজ। এদের মধ্যে বিপ্র শ্রেষ্ঠ, বিপ্র কাকের মধ্যে সবচেয়ে ফেমাস আমার বাবা দ্রোণ-– যাকে লোক দগ্ধ কাক বলে।
উফ, সুযোগ পেলেই বংশগৌরব ফলানোর এই হ্যাবিটটা ছাড়ো তো দেখি! আমাদের কাজ হল অন্ত্যজ কাকেদের নিয়ে। এরা কঠিন শ্রম করেও খেতে পাচ্ছে না। শূদ্ররা তবু সেবা-টেবা করে একটু-আধটু এঁটোকাঁটা পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা অন্ত্যজদের নিয়ে। কলিযুগের শেষে এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা এগোচ্ছি। ভগবান চতুর্বেদী আমাদের তাই ফিল্ডে নেমে কাজ করতে বলেছেন।
–কী কাজ? উড়িয়ে দিতে হবে তো?
না হে উড়িয়ে দিয়ে কিসসু হবে না। নিমকি-বিপ্লবে বাল্মিকী-প্রতিভার মতো নাটক হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। শোনো, এই বিচালিঘাটে আমাদের প্রথম অ্যাকশন শুরু হবে। কেন এই জায়গাটা বেছে নিলাম জানো?
–কেন?
বলব?
–হ্যাঁ, বলুন।
শুনবে?
–এই তো আবার সেই বাংলা সিরিয়ালে ফিরে গেলেন!
রাগো কেন? মনে রাখতে হবে বেশিরভাগ লোক কিন্তু এক কথার চর্বিতচর্বণ ভালোবাসে। ধৈর্য রাখতে হবে। তাই তোমাকে একটু প্র্যাকটিস করাচ্ছিলাম।
–কেন এখান থেকে শুরু করলেন?
ওই যে দূরে বাদশা ওয়াজিদ আলির কবর দেখতে পাচ্ছো?
–একটা মাজার মতো দেখা যাচ্ছে। এই নবাব বাহাদুরের নাম তো শুনিনি! আবার আপনি ভ্যানতাড়া শুরু করলেন!
না, না। এই জায়গাটার মাহাত্ম্য না জানলে তো বুঝবে না, কেন আমরা অ্যাকশনের চিন্তন শিবির হিসাবে বিচালিঘাটকে বাছলাম!
–বলুন। কে এই নবাব?
নবাব নয়, রাজা। তাঁর জীবনী বলে কোনও লাভ নেই। অশ্ববদনের ভেতরে যে মেনি ইন ওয়ান যন্ত্রটা আছে, তাতেই সব পেয়ে যাবে। ইংরেজরা যখন তার অবধের রাজত্ব কেড়ে এই অঞ্চলে নির্বাসন দেয়, তখন তিনি গান-বাজনা, কবিতা-নাচ এই সব নিয়ে থাকতেন; একথা সকলেই জানে। তিনি নিজে চমৎকার কত্থক নাচতেন। ঠাকুর প্রসাদজী ছিলেন তাঁর কত্থক গুরু। এসব কথাও তুমি পেয়ে যাবে।
–তাহলে পাবো না কোনটা?
হা। হা। হা। ওয়াজিদের যখন অল্প বয়স, তখন জ্যোতিষীরা তাঁর মা-বাবাকে বলেছিলেন, এই ছেলে বড় হলে সন্ন্যাসী হবে। সন্ন্যাসী হওয়ার গ্রহ-নক্ষত্রের ফের কাটাতে তাঁরা নিদান দিয়েছিলেন, প্রত্যেক জন্মদিনে ওয়াজিদকে সন্ন্যাসীর পোশাক পরাতে। ওয়াজেদের পরীখানায় চারশো জন পরী ছিল।
–বলেন কী? সত্যি পরী!
হ্যাঁ। রাজার এই নির্বাসন তাঁকে সাধুসন্ত করে তোলে। তবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি, মানে তাঁর এক পোষা বাঘ আচ্ছা শোধ নিয়েছিল বটে!
–কী রকম?
সামনে এই যে নদী দেখছ, পুণ্যতোয়া মা গঙ্গা। এখানে এক সময় গরম কালে জল থাকত না। ভাঁটার সময়, নৌকো ছাড়া পারাপার করা যেত। তখন তো তোমার ফারাক্কা ব্যারেজ হয়নি। নির্বাসিত বাদশা বনে গিয়ে সন্ন্যাস উদ্যাপন করতে পারতেন না, তাই বাঘ-ভল্লুক পুষেছিলেন; অনেক পাখিও ছিল। একদিন একটি বাঘ বিচালিঘাট কোনাকুনি পার হয়ে ওপারে হাওড়া চলে গেল। বোটানিক গার্ডেন। সেখানে এক সাহেবকে জ্যান্ত খেয়ে আবার এ পারে চলে এল। না না, গুলি খেয়ে মারা গেল।
–আফিমের গুলি?
না হে ছোকরা। বারুদের গুলি। প্রতিশোধ!
–এটাকে আপনি প্রতিশোধ বলছেন? কোন ইংরেজ ডালহৌসি রাজার নবাবি কাড়ল, আর মারা গেল কে, না এক জর্মন সাহেব? দেখুন সেই জর্মন সাহেব হয়তো এক ভালো মানুষ ছিলেন। বাঘটাকে ক্ষুদিরামের মতো ফাঁসিতে লটকানো উচিত ছিল।
তাহলে তো তোমাকেও ফাঁসিতে লটকাতে হয়। তোমার বাপকে যে খুন করল, তাকে তুমি মারলে-– এটা কষ্ট করে না হয় মানলাম; কিন্তু ওই নিরীহ ছেলেগুলোকে যে ঘুমন্ত কচুকাটা করলে, তার বেলা!
–শত্রুপক্ষের কাউকে রেয়াত করতে নেই।
এই লজিকটা বদলাতে হবে আমাদের। সেই জন্য তোমার অ্যাকশন নিয়ন্ত্রণ করার ভার আমাকে দিয়েছেন ভগবান চতুর্বেদী। আমি তোমার জেনারেল।
–ঢাল নেই, তলোয়ার নেই; নিধিরাম সর্দার। শালা কাক হবে উয়ার জেনারেল! হা হা হা হা!
কথাটা তলোয়ার নয়, তরোয়াল! যেমন অনেক সময় আজনাদ-কে আমরা আন্দাজ বলি।
–আবার ভুল বকা শুরু করলেন!
উয়ার এক রকমের হয় না লোহিতেন্দু। তার নানা রকমফের আছে। তুমি ওপিয়াম-উয়ারের কথা জানো নিশ্চয়-– আফিম নিয়ে যুদ্ধ। একটু আগে আফিমের গুলি নিয়ে কী একটা বলছিলে না?
–না! ওই সব আফিম জঙ্গ পোষাবে না। তা ছাড়া তাঁর সঙ্গে বিচালিঘাট, রাজা ওয়াজিদ আলি বা আমাদের অ্যাকশন শুরুর কী সম্পর্ক? ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার স্বভাব আপনার গেল না। একবার শিবের গীত গেয়ে রামবিরোধী হয়ে তো মানুষ থেকে কাক হয়ে গেলেন! তাও শিক্ষে হল না আপনার!
জানো তো, ঢেকি স্বর্গে গেলে ধান ভানে।
–ফালতু কথা বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসুন। কাহিনি আর গসিপ ছেড়ে দু চারটে ইষীকাস্ত্র ছাড়ি, কী বলুন!
না হে। ও সব নলখাগড়ার অস্ত্র ব্যবহার করলে উলুখাগড়ার দল মরবে। তা ছাড়া হত্যাটা কোনও সমাধান নয়। ঈষীকা বা নলখাগড়াকে ক্ষমতার উৎস ভেবো না। জানো তো ওতে গর্ভস্থ শিশুও রেহাই পায় না।
–তা আর জানব না! গর্ভবতীর দক্ষিণার কথা কি আমার মনে নেই!
নামটাও ভুলে গেলে অশ্বত্থামা! যাক গে ওই যে জিজ্ঞেস করেছিলে, কাজে নামার আগে কেন এত কাহিনি, তত্ত্ব, শিবের গীত গাইছি। এ সব না জানলে, ইতিহাস না বুঝলে বিপ্লব হয় না বাপ। সারা জীবন জঙ্গলে কাটালে সমাজ-জীবন আর কী বুঝবি রে লোহা! একটু শোন, ধৈর্য ধরে বৃদ্ধ-বায়সের কথাগুলো ফলো কর। কাক-ফাক বলে খিস্তি করিস না।
–ঠিক আছে, বলুন। ঐ জায়গাটা–- বিচালিঘাট, বাদশা, ওপিয়াম উয়ার। তারপর?
১৮৪৬ সালে কলকাতার এক ভদ্রলোক মারা যান ইংল্যান্ডে। আর ঠিক তাঁর পরের বছর ওয়াজিদ আলি শাহ অবধের বাদশা হন। ন বছর বাদশাহির পর তাঁকে আনা হল এই এলাকায়, মেটিয়াবুরুজ; আসলে এটা গার্ডেন রিচ এলাকা।
–বুঝলাম। ১৮৪৬ সালে ইংল্যান্ডে কে মারা গেছেন? কলকাতার লোক, বিখ্যাত কেউ?
হ্যাঁ। অ্যাজ আ জমিন্দার হি অয়াজ মার্সিলেসলি এফিশিয়েন্ট অ্যান্ড বিজনেসলাইক, বাট নট জেনেরাস।
–হঠাৎ ইংরেজি কেন ক্রো আঙ্কল?
ইংরেজদের হাত ধরে এই ভদ্রলোক চিনের সাধারণ মানুষকে আফিমে বুঁদ করে দেবেন বলে আফিম ব্যবসায় নামেন। তখন ঘনশ্যাম দাস বিড়লা, পার্সি ব্যবসায়ী রুস্তমজিরা ছিলেন নামকরা ড্রাগ রানার।
–অ্যাঁ! বলেন কী! এরা সব এই সব করতেন। আর নাম হয় আমাদের! আমরা তো খাওয়া পরা আর অস্ত্র কেনার জন্য ড্রাগ চালান করেছি।
তোমরা চুনোপুঁটি, এইসব রাঘব-বোয়ালের ধারে কাছে যেতে পারবে না!
–লোকটা কে বলুন তো?
আর একটু শোনো, তা হলেই বুঝতে পারবে। এই ভদ্রলোক ডক কোম্পানি খুলেছিলেন এই অঞ্চলে, গার্ডেন রিচ এলাকায়। তবে এই বাঙালি ভদ্রলোকের দুটো ওপিয়াম ক্লিপার ছিল-– এরিয়েল আর মাভিস। প্রথমটা ৩১৭ টন, আর মাভিস ১১২ টন আফিম নিয়ে এই অঞ্চল থেকে সুয়েজ পাড়ি দিত, মুম্বাইকে পাশ কাটিয়ে।
–বুঝলাম। প্রিন্স ডোয়ার্কি।
তখন থেকেই এই জায়গাটা খতরনক। আফিম যুদ্ধের ইতিহাসটাও বেশ কৌতুকের। পলাশীর যুদ্ধের পেছনে ছিল এই ড্রাগ রানাররা। জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ আর তোমার প্রিন্সকে বলা হত বাংলার রথসচাইল্ড।
–প্রথম দুজনের সঙ্গে তো প্রিন্সের সময়ের অনেক ব্যবধান!
তা ঠিক। তবে এই প্রথম দুজনকে ব্যবসার বিচারে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পেরেছিলেন প্রিন্স।
–আফিম যুদ্ধটা শুরু হল কবে, কোথা থেকে?
বলতে পারো, তাঁর একটা প্রধান জায়গা এই গার্ডেন রিচ এলাকা। প্রিন্স কয়েকটা কাজ করেছিলেন-– ফ্লোটিং ব্রিজ, ডক কোম্পানি, ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি, এমনকি নুন কোম্পানিও। চিনি, মদের ব্যবসা, ফ্লেশ-ট্রেডিং। কয়লাখনি; সেসব কথা বললে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাবে।
–আফিম যুদ্ধটাই বলুন বরং।
শ্রীশ্রী কোম্পানি বাহাদুরের ইজারার কাল উত্তীর্ণ হলে এই দেশ ও চিনের মধ্যে ব্যবসাকার্য চালু হয়। সেই বাণিজ্য ছিল নিঃশুল্ক। ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার কলকাতায় বেশ শীত। সেই ঠাণ্ডায় টৌন হলে একটা সভা হয়।
–টৌন হল কোথায়?
উচ্চারণটা ভুল হয়ে গেসিল বাপ। টাউন হল। সেখানে ছিলেন প্রিন্স ডোয়ার্কি। অবশ্য তখনও তিনি প্রিন্স হননি। সেখানে বসেই এই সব আফিম চালানের ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়। সেই নকশা ধরে কাজ করতে শুরু করে কোম্পানি বাহাদুর। তাদের একচেটিয়া ব্যবসায় থাবা বসান ডোয়ার্কি ওরফে দ্বারকানাথ।
–কোম্পানি তা মেনে নিল?
মেনে কী সহজে নিয়েছে ভাইপো! শোনো, প্রথম আফিম যুদ্ধের কাল হল ১৮৩৯-১৮৪২। ক্যান্টন সিস্টেমের নিষেধাজ্ঞা তখন উঠে গিয়ে বোম্বাই থেকে ক্যান্টন এবং কলকাতা থেকে ক্যান্টন, এই দুটো রুটে আফিম চালান হচ্ছে। ১৮৩৯ সালে ৪০,০০০ চেস্ট আফিম রপ্তানি হয়, কয়েক বছরের মধ্যে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬,০০০ চেস্ট। এই চেস্ট বা বাক্সগুলো তৈরি হত নেপালে।
–দ্রুতগামী নৌকো ছিল তখন?
হ্যাঁ। ওই নৌকোগুলোকে বলা হত ‘স্মাগলার’। হং মার্চেন্ট থেকে শুরু করে সিক্রেট সোসাইটি, ব্যাঙ্ক অব্দি এই কারবারে যুক্ত ছিল। পূর্ব ভারতের ঘাঁটি ছিল কলকাতা, আর কলকাতার প্রধান জায়গা এই গার্ডেন রিচ এলাকা, ওপারে বোটানিক গার্ডেন। কিন্তু এই সব বাগানের মাথাটা কাজ করত বেলগাছিয়ার বাগানে!
–মানে?
বেলগাছিয়ার বাগানেই তো থাকতেন প্রিন্স সাহেব। সেই ছড়া শোনোনি?
বেলগাছিয়ার বাগানে হয়
ছুরি কাঁটার ঝনঝনি
খানা খাওয়ার কত মজা,
আমরা তার কী জানি!
মদের কত গুণাগুণ
আমরা তার কী জানি!
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।
–দারুণ!
তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে লোহিত, এই ব্যবসাতে মিশনারিরা অব্দি ঢুকে পড়েছিলেন। কার্ল গুৎজলফ নামের এক প্রটেস্টান্ট মিশনারি এই কারবারে যুক্ত ছিলেন।
–এত আফিম বিক্রি হত!
হ্যাঁ! এ দেশের চাকরিজীবীদের ৩০ শতাংশ মানুষ আফিমের গুলি খেয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতেন। স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া আফিম খেতেন।
–ঠিক এখানকার মতো। এখনও তো জনগণ, সরকার সবাই বুঁদ হয়ে আছে। নইলে এই নৈরাজ্য চলতে পারে না। লোকজন যদি নেশায় মশগুল থাকে তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। যাক গে বাকিটা বলুন।
প্রথম আফিম যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। একটা ডাইরেক্ট যুদ্ধ, অন্যটা পরোক্ষ। যুদ্ধে খুন হয় ৬৯ জন, আহত ৪৫১। কিন্তু সব মিলিয়ে সংখ্যাটা কুড়ি হাজার মতো।
–ভয়ঙ্কর!
হ্যাচিন্ত আর ভোলেগ নামের যে দুটো জাহাজ আফিম নিয়ে যেত, তাদের সঙ্গে থাকত ১৬টা উয়ার জাঙ্ক আর ১৩টা ফায়ার বোট।
–পরোক্ষ যুদ্ধটা কী রকম?
প্রথমে পাটনায় আফিম চাষ শুরু হয়। এখান থেকে ৬০০ মাইল দূরে। তবে বাংলাও বাঁচেনি, চাষীদের জোর করে আফিম চাষ করানো হত। তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। একজন কৃষককে দিয়ে বলপূর্বক একশোটা আফিম গুলি বানানো হত। আফিমের কারখানায় ছিল ল্যাবরেটারি থেকে নানা সব ব্যাপার স্যাপার। এমনকি নেশা বাড়াতে আফিমে অন্য মাদক দ্রব্যও মেশানো হত। এইসব কৃষক ও মজুররা ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, গ্যাংগ্রিন, সানস্ট্রোক ও অপুষ্টিতে মারা যেত ১৮৪০ সালে ৫,৩২৯ জন মানুষ মারা যান। এটা সরকার বলছে। ৪২-এ এক দিনে ১,১০০ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এগুলো আফিম যুদ্ধেরই ফল। অস্ত্রব্যবসায়ী আর আফিমের কারবারিরা ছিল ওয়াজিদের রাজত্ব কেড়ে নেওয়ার মূলে। অবশ্য এ সব পরোক্ষ ফল।
–কিন্তু একে পরোক্ষ বলছেন কেন?
পরোক্ষ নয়, তবে ওই যুদ্ধে গোলাগুলি খেয়ে মারা যায়নি, এই আর কী! যাক গে ভোর হয়ে এল, কাছেপিঠে তো ভালো বৃক্ষও নেই যে একটু ঘুমিয়ে নেব। ওই গাছটা কী বলো তো বাবা লোহিত শাহ?
–ওটা বাবলা গাছ।
ওখানেই যাই তাহলে।
আবার অশ্ববদনের কণ্ঠে শুনতে পাওয়া গেল, বৈশাখ মাসে শুষ্ক ও কণ্টকযুক্ত বৃক্ষে বাসা বাঁধলে দেশে দুর্দিন আসে।
ভূষণ্ডী গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, থাক! তাহলে আর কাজ নেই ঘুমিয়ে। কিন্তু লোহিত! তোমার এই কিন্নর বাহনটি বোধ হয় অন্ত্যজ কাক, ঠিক সময়ে সঠিক কথাটা জানিয়ে দেয়। এর মুখদেশ রুক্ষ, সূক্ষ্ম; স্কন্ধদেশ দীপ্তিবিশিষ্ট হলে কি হবে অশ্ববদনের শব্দ ও বুদ্ধিবৃত্তি স্থির। এর আশঙ্কাও অল্প।
লোহিতাশ্ব বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন। এর অনেক গুণ, সব ঠিকঠাক বলে দিতে পারে। আমি আমার বাহনের মুখে শুনেছি যে আপনি অযোধ্যায় শূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর উজ্জয়নীর এক সাধুর কৃপায় ব্রাহ্মণ-জন্ম লাভ করেছিলেন। তখন আপনি এতটাই রামভক্ত হয়ে পড়েন যে লোমশ মুনির হাজার ডাকেও সাড়া দেননি। তার পরেই তো মুনির অভিশাপে কাক হয়ে গেলেন।
ঠিকই বলেছ বৎস! তবে মনে রেখো, আমি কাক হলেও বিপ্লবী-বিপ্র। পুরীতে গেলে আমার বিগ্রহ দেখতে পাবে। একটু আফিমের গুলি পেলে ভোরবেলাটা নেশা করে কাটিয়ে দিতাম। দেখ না বাবা, কোথাও পাওয়া যাবে কিনা!
–চোলাই পেতে পারেন, আফিম জোগাড় করা এখন খুব শক্ত।
আফিম না পেলে গল্পটা শুরু করব কী করে?
–কোন গল্প?
১৮৫৬ সালে ওয়াজিদ আলির বাদশাহি চলে যায়। তারপর তাকে কলকাতায় নির্বাসন দেওয়া হয়। অতঃপর ১৮৫৭-তে সিপাহী বিদ্রোহ। রাজা বন্দী, কেল্লার কারাগারে। সেখান থেকে শুরু হবে তোমার রাজনৈতিক ক্লাস।
বাবুল মোরা নৈহর ছুটো জাএ
বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো জাএ
চার কহার মিল, মোরী ডোলিয়া সজাবেঁ
মোরা অপনা বেগানা ছুটো জাএ
বাবুল মোরা নৈহর ছুটো জাএ
বাবুল মোরা নৈহর ছুটো জাএ
–হঠাৎ সায়গলের গাওয়া ঠুমরি ধরলেন যে বড়!
এটা রাজা ওয়াজিদ আলির ঠুমরি, ভাইপো! সে অনেক গল্প!
–বলুন শুনি।
শোনো।
কাক ভূষণ্ডী লোহিতাশ্বের মুখোমুখি বসলেন। সামনে বয়ে যাচ্ছে পূণ্যতোয়া গঙ্গা। অদূরে বাদশার সমাধির চূড়া দেখা যাচ্ছে। মেটিয়াবুরজের সিবতায়নাবাদ ইমামবাড়া।
অপূর্ব লেখা। গল্প বললে গল্প, গদ্য বললে গদ্য। কিন্তু এ সংলাপ আরও শুনতে আকুলতা হয় যে! লেখকের প্রতি এক সশ্রদ্ধ পাঠকের আবেদন থাকল…