চার নম্বর নিউজডেস্ক
হরিয়ানার নিম্নবিত্ত বস্তি অঞ্চল! সন্ধে হব হব, পাড়ায় হনুমানজির মন্দিরে মাইকের হাল্কা গলা সাধা রাস্তায় ছেলেপুলের হইহল্লা, একটু দূরে হাইওয়েতে ছুটে যাচ্ছে মহার্ঘ্য চার চাকা। এসব থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাঁচকুলার হাল্লমাজরা বস্তিতে কিন্তু এখন বেশ অন্যরকম সময়। বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় থাকার কথা তো বাদ দিলাম, গলি প্রায় শুনশান। আপনার মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন? উত্তর জানতে হলে আপনাদের একটু এগিয়ে যেতে হবে এলাকার সরকারি স্কুলে, যেখানে প্রতিদিন ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, বেশিরভাগ বাচ্চা গিয়ে ভিড় জমায় তাদের দৈনিক তাইকোন্ড শেখার আসরে। তাদের একাধারে শিক্ষক এবং পরামর্শদাত্রী অমিতা মারওয়ার ভাষ্যে, এটা শুধুমাত্র ওদের তাইকোন্ড ক্লাস নয়, এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। ছোট্ট করে জানিয়ে রাখা যাক তাইকোন্ড হল এক রকম কোরিয়ান মার্শাল আর্ট, উঁচু লাথিতে যার পরিচয়।
অমিতা মারওয়া (৪৪) যখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের জন্য অবৈতনিক তাইকোন্ড ক্লাস শুরু করেন, সালটা ২০১১। মেডিক্যাল ল্যাব টেকনোলজিতে স্নাতক অমিতা মার্শাল আর্ট শিখছেন স্কুল থেকে, বিয়ের পরেও সেই অদম্য জেদে ভাঁটা পড়েনি, যার প্রমাণ পুরোদস্তুর সংসারী হবার পরেও ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করা। তিনি এই ক্লাস শুরু করেছিলেন যখন, নাম দিয়েছিলেন অমিতা মারওয়া অ্যাকটিভিটি সোসাইটি। নিজের শৈশবে মার্শাল আর্টের ভক্ত অমিতা বহু প্রতিশ্রুতিমান ছেলেমেয়েকে শুধুমাত্র অবস্থাপন্ন না হবার কারণে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে দেখেছেন। তাই বস্তির গরীব শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে তাইকোন্ড শেখানোর পরিকল্পনা মাথায় আসতেই আর দেরি করেননি অমিতা।
প্রথমে মাত্র পনেরো দিনের ক্যাম্প হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, আজ সেখানে পাঁচ থেকে চব্বিশ বছরের যে ৪৫০ ছাত্রছাত্রী দৈনিক তাইকোন্ড শিখতে ভিড় করে। এর প্রায় ৪০% মেয়ে। আত্মরক্ষা শুধু নয় মেয়েদের স্বনির্ভরভাবে গড়ে তুলতে তাইকোন্ডর গুরুত্ব ভোলেননি তিনি। কিন্তু তারই সাথে এটাও মনে করিয়ে দেন প্রতিদিন কী পরিমাণ জীবন সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে সেই সব ছেলেমেয়েদের যেতে হয়। যেমন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া পরমদ কুমার আর সুরজ কুমার অবসর সময়ে ওয়েটারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। যদিও আশার কথা স্পনসররা এগিয়ে আসায় বিভিন্ন জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ খরচ অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, খেলোয়াড়রাও এগিয়ে এসেছেন তাঁর সংস্থার সহযোগিতা করতে।
প্রতিদিন দেড় ঘণ্টার ক্লাস শেষে অমিতা ব্যস্ত থাকেন ছাত্রছাত্রীদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে, তাঁর কাছে এই ক্লাস এখন শুধু তাইকোন্ড নয়, একটা দস্তুরমতো কাউন্সেলিং সেশন। এখানে হাতের কাজ থেকে শুরু করে কত্থক পর্যন্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অমিতা নিজেও চার বছর ধরে কত্থকের চর্চা করছেন।
কিন্তু সময়ঘড়ি একটু পিছিয়ে দিলে দেখা যাবে, অমিতার জন্য ব্যাপারটা এত মসৃণ ছিল না মোটেই, সমাজের বাধা এসেছে প্রচুর, বাবা-মারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসতে বাধা দিয়েছে এমনকি ছেলেধরা অপবাদও পেতে হয়েছে। প্রায় এক বছর লেগেছে তাঁর এলাকার মানুষদের বিশ্বাস অর্জন করতে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বহু পদক বিজয়ী অমিতা গর্বিত যে তাঁর শখ আজ শুধু পেশা নয়, বাকিদের সাহায্যের হাতিয়ার। তাঁর স্বামী ও সন্তান এই পুরো ব্যাপারটাতে শুধু মানসিক সাথী তাই নয়, প্রতিবছর পারিবারিক আয়ের এক দশমাংশ স্বামী তুলে দেন অমিতা মারওয়া সোসাইটির হাতে। অফুরান শুভেচ্ছা রইল অমিতা ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের প্রতি…