প্রিয়ক মিত্র
গত সংখ্যার পর
জ্যাঙ্গো আনচেনড্
সত্তর দশক থেকেও পিছিয়ে যেতে হবে আরও অন্তত একশো বছর! টাকার ফোয়ারা ছুটছে কলকাতা শহরে তখন। বিখ্যাত পয়সাওলা সব বাবুরা রং ছড়িয়ে রেখেছেন শহরজুড়ে। বিলিতি মদ; স্কচ, জিন, শেরি, বাগানবাড়ি, রক্ষিতা, হাফ আখড়াই, খ্যামটা, কবিগান, বিদ্যাসুন্দর, বুলবুলির লড়াই — সব মিলিয়ে বাবুদের যে বর্ণময় যাপন, তা শহরকে মাতিয়ে রেখেছিল দিনের পর দিন।
এইরকম এক ‘বুলবুলির লড়াই’-এর দিন থেকেই আমাদের গল্পের শুরু।
কুখ্যাত বাবু রমাকান্ত রায় আর রাজা দেবকমল সিংহের ছেলে ইন্দ্রকমল সিংহ — এই দুই প্রতিপক্ষের বুলবুলির মধ্যে লড়াই! রমাকান্ত রায় লম্পট, শয়তান, ধূর্ত। লক্ষ টাকার জমিদারি তার। নায়েবদের মহল পরিদর্শনে পাঠিয়ে সে কলকাতায় থাকে ফূর্তি করবে বলে। অথচ গ্রামে তার জমিদারির ভেতরে কেউ শান্তিতে থাকতে পারে না তার পাইক বরকন্দাজদের জুলুমের দরুণ। তার জ্বালায় গ্রাম থেকে পালিয়ে বেঁচেছে অনেকে। রমাকান্ত রায়ের একটা অন্যতম নেশা ‘শিকার ধরা’! অর্থাৎ নারীহরণ! তার জন্য তার মোসাহেব মোতায়েন ছিল অজস্র!
ইন্দ্রকমল সিংহ ঘাঘু নেকড়ে। যেখানে সবাই নিজের ‘রাঁঢ়’দের খতিয়ান গোটা বিশ্বকে দিয়ে বেড়ায়, সেখানে কেউ জানে না ইন্দ্রকমল সিংহের রক্ষিতা কোথায় থাকে? কেই বা তার রক্ষিতা? আদৌ তার রক্ষিতা আছে কিনা তাও কেউ জানে না। আহিরীটোলার গঙ্গার ধারে ইন্দ্রকমল সিংহের রহস্যময় কুঠিবাড়ি। লোকে বলে ওটা মানুষখেকোর আস্তানা! একবার ওখানে ঢুকে আর কেউ বেরোতে পারে না। ইন্দ্রকমল যখন কারও অস্তিত্ব গুরুত্বহীন বলে মনে করবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ওই বাড়িতে তার কঙ্কাল জমা হওয়া নিশ্চিত হয়ে পড়বে। স্থানীয় লোকের দাবি গঙ্গার পারের এ বাড়ি অভিশপ্ত। এখানে প্রেতলোকের বাসিন্দাদের ঘোরাফেরা।
রমাকান্ত রায় বুলবুলির লড়াই খেলে, জুড়িগাড়ি চেপে বেশ্যা বগলে ঘুরে বেরিয়ে শহরকে জানান দেয় তার লাম্পট্যের কথা। শত্রুর নামে লোক ভাড়া করে ছড়া কাটায়। বিপক্ষের বাবু থেকে বেহারা, কারও ঘরের মেয়ে বাদ যায় না রমাকান্ত রায়ের নজর থেকে। “অন্যের ঘরের মেয়েমানুষ লুঠই যদি না করলুম, তাহলে আর আমার নাম রমাকান্ত রায় কেন!” রমাকান্ত রায়ের নামেও ছড়া কাটা কম হয়নি শহরজুড়ে। রমাকান্ত রায়ের নানাবিধ কেচ্ছার খবর শহরজুড়ে মানুষ পেয়েছে বটে। যেমন জানবাজারে পিয়ারী বলে এক গণিকার মারা যাওয়ার খবর বাতাসে ভেসে আসার পর জানা গিয়েছিল, এই পিয়ারীকে বহুদিন যাবৎ নিজের বাগানবাড়িতে ‘পুষছিল’ রমাকান্ত রায়। পিয়ারীর পিঠে ছুরি কে মেরেছে এ নিয়েও কারও কোনও সংশয় ছিল না। ‘সম্বাদ রসরাজ’-এ লেখা হল, “রমাকান্ত যে এই মুসলমান চরিত্রহীনা স্ত্রীলোকটিকে রক্ষিতা করিয়া রাখিয়াছিল, এতদ্বিষয়ে সকলেই অবহিত হইয়াছেন। এখন প্রশ্ন হইল এই স্ত্রীলোকটির ছুরিকাঘাতে হত্যার ষড়যন্ত্রে রমাকান্তর কোনও প্রকার বিশেষ ভূমিকা রহিয়াছে কিনা!”
কিন্তু ইন্দ্রকমল সিংহের কোনও অপরাধের খবরই কারও কানে পৌঁছোত না কোনওদিন। সবাই জানত ইন্দ্রকমল সাদা সিল্কের পাঞ্জাবির ওপর হাজার টাকার শাল চাপিয়ে ধুতির কোঁচা হাতে নিয়ে আতর মেখে ফিটনে চেপে বের হন। কিন্তু কোথায় যান, কী করতে যান, কেন যান — তা কেউ জানে না। ইন্দ্রকমলের চোখের দিকে কেউ সহজে তাকাতে পারে না। তার চোখ পাথরের মতন স্থাণু, কুমিরের মতন হিংস্র, আর শেয়ালের মতন ধূর্ত। তার বদগুণের খবর বিশেষ কেউই পায় না, তাকে নিয়ে মুখে মুখে কেচ্ছা রটানোর সাহসও নেই খুব বেশি লোকের। শুধু বুলবুলির লড়াইয়ের নেশাটাই তার গোপন নয়। বাদবাকি গোপন বিষয়ে তার নায়েব রাধামোহন ছাড়া আর বিশেষ কেউ জানত না।
রমাকান্ত রায়ের পূর্বপুরুষ গঙ্গাপদ রায় ছিলেন কোনও জমিদারের দেওয়ান। হঠাৎ একদিন সেই জমিদারিতে বড়সড় ডাকাতি হয়ে গেল। জমিদারের গলাকাটা লাশ পাওয়া গেল তার শয়নকক্ষে। পলাতক হলেন গঙ্গাপদ। তারপর শুরু করলেন নুনের ব্যবসা। সেই থেকেই তাদের যাবতীয় প্রতিপত্তি, জমিদারি।
ইন্দ্রকমলের পূর্বপুরুষ হেস্টিংসের পা ধোয়া জল খেতেন। তাদের বংশের আভিজাত্য অবশ্যই রমাকান্ত রায়দের চাইতে বেশি, কিন্তু দালালিও তাদের রক্তে। তবে ইন্দ্রকমল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে কোনওদিন কাউকেই রেয়াত করেনি, কারও শরণার্থী হওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। তার কার্যসিদ্ধির পথে বাধা তৈরি করেছে, এমন একটি পিঁপড়েকেও সে কোনওদিন পৃথিবীর আলোহাওয়ায় বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়নি।
এহেন দুই ব্যক্তির মধ্যে আজ বুলবুলির লড়াই জমে উঠেছে। জোড়াদীঘির মাঠে কুড়িজোড়া পাখির ডানা ঝাপটাঝাপটি, হিংস্র চিৎকার আর মোসাহেবদের হুল্লোড়ের শব্দ রীতিমতো অস্থিরতা তৈরি করছে। রমাকান্ত রায় তার পানরাঙা দাঁত খিঁচিয়ে অদ্ভুত অসভ্যের মতন মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে, তার মাথায় ছাতা ধরে রয়েছে তার একান্ত অনুচর বিশ্বনাথ। তার বুলবুলিরাই জিতছে। এই নিয়ে পনেরোবার। আড়চোখে একবার ইন্দ্রকমলকে দেখল রমাকান্ত!
ইন্দ্রকমলের চোখ পাথুরে এবং ভয়াবহ। রমাকান্তরও কেমন জানি অস্বস্তি হল তাকিয়ে। ওই মারণচোখে ইন্দ্রকমল ঠায় তাকিয়ে দেখছে বুলবুলিদের।
রমাকান্তর মোসাহেবদের হুঙ্কার বেড়েই চলেছে। ইন্দ্রকমলের মোসাহেবদের উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ছড়া কেটে চলেছে তারা।
“বুলবুলি রাখল না মান
গেল বুঝি রাজার পরাণ”
ইন্দ্রকমলের মেজাজের কী হাল হচ্ছে তা বুঝতে পেরে রাধামোহন খানিক বিব্রত। বাদবাকি মোসাহেবরা হুল্লাটবাজি করে চলেছে রমাকান্তর মোসাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
শেষত হারলেন ইন্দ্রকমল।
“দুয়ো রাজাবাবু দুয়ো”, কুৎসিত ভঙ্গিমায় চিৎকার করছে রমাকান্তর মোসাহেবের দল। ইন্দ্রকমলের পারিষদরা মুখ ততোধিক বিকৃত করে রমাকান্তর বিবিধ কেচ্ছা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তাদের।
রমাকান্ত উল্লসিত হলেও তা হাবেভাবে বোঝাচ্ছে না মোটেই, শুধু প্রসন্ন মুখে সব তোয়াজ উপভোগ করছে।
ইন্দ্রকমল গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে যাচ্ছে মাঠ থেকে, রওনা দিয়েছে তার জুড়িগাড়ির উদ্দেশ্যে। পিছু নিয়েছে মোসাহেবরা।
ইন্দ্রকমলের মোসাহেবদের মধ্যে মাতাল লম্পট বংশীধর ছিল সামনের দিকে। হিন্দু কলেজের এই প্রাক্তন ছাত্রর নামে ভদ্রঘরের মেয়ের সর্বনাশ করার ভুরিভুরি কেচ্ছা বাজারে রটেছে, ব্রাহ্মসমাজের এক সদস্যের মেয়ের সঙ্গে তার কেচ্ছা রটায় ব্রাহ্মরা তাকে ছিঁড়ে খেতে বাকি রেখেছে কেবল, সেসব নিয়ে সে বেপরোয়া। তার বন্ধুরা এসব কথা পাড়লে সে বলে, “আমি ওইসব কেয়ার করিনে ভায়া, আমি হলেম গিয়ে বাইরনের ডন জুয়ান! আর বেম্মগুলো পুওর ওল্ড ম্যান! থিওলজি নিয়েই থাকুকগে! আমার ঢের কাজ রয়েছে!” উদাত্ত কণ্ঠে ‘শি ওয়াকস ইন আ বিউটি’ আবৃত্তি করতে করতে এগোচ্ছিল সে, সম্পূর্ণ বেসামাল। তারপর আচমকা ভিড়ের দিকে তাকিয়ে খানিক থমকে “ওহ মাই গুড লর্ড” বলে বিশ্রীভাবে চিৎকার করে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল একজন গ্রাম্য ঘোমটাপরা নারীর ওপর এবং মারল হ্যাঁচকা টান। টাল সামলাতে না পেরে সেই যুবতী খানিক হুমড়ি খেয়ে পড়ল বংশীধরের ওপর। ঘোমটা খসে পড়ল লহমায়। বংশীধর তার মুখটা দুহাতে ধরে বলল, “কে তুমি মা আমার? কুইন ভিক্টোরিয়া? তাইলে আমি তোমার সারভেন্ট!” এত অবধি বলে সোজা সেই গ্রাম্য বধূর পায়ে গিয়ে পড়ল বংশীধর।
ততক্ষণে লোক জমে গেছে সেই তামাশা দেখতে। আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেছে সেই যুবতী, হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন বাকিদের পরিহাস দেখে।
বংশীধর গলার সোনার চেনটা খুলে টলমল হাতে জড়িয়ে দিচ্ছিল যুবতীটির হাতে। বলে উঠল “হোয়াই ক্রাইং মাই ফেয়ার লেডি? তোমাকে আমি অপ্সরা বানাব।”
ঠিক এই সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন কুচকুচে কালো গাত্রবর্ণের লম্বা সিড়িঙ্গে লোক বেরিয়ে এল, তার কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখদুটোতে আগুন জ্বলছে ধিকিধিক। গামছাটা কোমরে আঁট করে বাঁধা। নগ্ন ঊর্ধাঙ্গে হাড়পাঁজরা ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে প্রায়, আর তার কঙ্কালসার হাতে শোভা পাচ্ছে একটা ধারালো কাস্তে! তার লক্ষ্য বংশীধর।
বংশীধর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাকাল সিড়িঙ্গে লোকটার দিকে। লোকটার মতিগতি ভাল নয় বুঝে বংশীধর এক পা করে পিছোতে থাকল। লোকটাও এগিয়ে চলল বংশীধরের দিকে, এক পা এক পা করে।
হইচই শুরু হয়ে গেছে ভিড়ের মাঝে। কেউ এগোতে সাহস করছে না! কিন্তু রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছে মানুষজন। একটা খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে এমনটা বুঝে সকলেই বেশ খানিকটা শঙ্কায়।
বিশ্বনাথ রমাকান্তর মাথায় ছাতা ধরে এগোচ্ছিল, গোলমালের আভাস পেয়ে সে নিজে তাকাল জটলার দিকে। তার মনিবেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
বিশ্বনাথের চোখ যা খুঁজে পাওয়ার পেয়ে গেছে। রমাকান্তর জন্য শিকার!
সে যা আশা করেছিল ঠিক তাই হল! রমাকান্তর চোখ আটকে গেল জটলার মধ্যে একটি মুখের ওপর।
যে যুবতীকে পাকড়াও করেছিল বংশীধর।
এমন রূপসী আর কাউকে ইহজীবনে দেখেছে বলে মনে পড়ল না রমাকান্তর। শ্যামবর্ণা, সুঠাম গড়ন। অভাবের ছাপকে ছাপিয়ে গেছে শরীরী আবেদন।
রমাকান্তর চোখ খাদ্যখাদক সম্পর্কের সমীকরণ নির্ধারণ করে নিল।
বংশীধর এক পা এক পা করে পিছোতে পিছোতে দুম করে উল্টে পড়ল মাটিতে। এবং তারপরেই মাতৃভাষায় “ওবাবাগো মাগো” করে কর্ণপটাহবিদারী আর্তনাদ ও হাত পা ছোঁড়া শুরু হল।
গোলমালের শব্দ শুনে ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালেন ইন্দ্রকমল, পেছনে রাধামোহন।
ইন্দ্রকমল গোটা দৃশ্যটা দেখলেন। তার চোখ স্থির হল এই সিড়িঙ্গে কালো লোকটার ওপর।
চোখ সরু করে তাকে একবার মাপজোক করলেন ইন্দ্রকমল। হাতে কাস্তেটা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। মুখ থেকে টুঁ শব্দটি বেরোচ্ছে না। চোখে খুনে রাগ।
আরেকবার ইন্দ্রকমল চোখ বুলিয়ে নিলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীটির ওপর। তার চোখে এই মুহূর্তে ভয়, কান্না এবং আস্থা! আস্থাটা কার প্রতি? তা বোঝা যাচ্ছে বেশ!
বংশীধর সোজা পায়ে এসে পড়ল ইন্দ্রকমলের।
“সার, ইউ আর মাই ফাদারমাদার! আপনি বাঁচান আমায়! এই লোকটা, দিস ব্লাডি সোয়াইন ইজ ট্রাইং টু…”
বংশীধর কথা শেষ করার আগেই ইন্দ্রকমল পায়ের আলতো টোকায় বংশীধরকে খানিকটা দূরে ঠেলে দিল।
আবার তার চোখ চলে গেল ওই সিড়িঙ্গে লোকটির দিকে, এবং সেখান থেকে সরে এসে চোখ স্থির হল যুবতীটির ওপর। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটা ক্রূর হাসি।
ঠিক এইসময় রমাকান্তর অনুচর বিশ্বনাথ এসে হাজির হল এই জটলার মধ্যে। ভিড় খানিক ফাঁকা করে সে সামনে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গে আরও দুজন মুষকো পাইকগোছের লোক।
সেই দুজনে সামনে এগিয়ে গিয়ে যুবতীটির দুটো হাত কঠিনভাবে করায়ত্ত করল সোজা। এবং তারপর টানতে টানতে ভিড়ের বাইরে নিয়ে চলল। তাদের পিছু নিল বিশ্বনাথ।
গোটা ঘটনাটাই আচমকা ঘটল। ফলে কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। এইসময় সিড়িঙ্গে লোকটি মুখ দিয়ে আশ্চর্য সব শব্দ নির্গত করে কাস্তে হাতে সোজা ছুটে গেল লোকগুলোকে তাক করে। বিশ্বনাথের এক হাতে একটা ছড়ি ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে সেই ছড়িখানা সে সপাং করে চালিয়ে দিল সিড়িঙ্গে লোকটার মুখ বরাবর।
লোকটা আবারও আশ্চর্য সব শব্দে আর্তনাদ করতে করতে মুখ ঢাকা দিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল, তারপর শুরু হল তার তুমুল ছটফটানি।
যুবতীটি “আঁ আঁ” করে বিজাতীয় শব্দে ততোধিক ডুকরে কেঁদে উঠল, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল সিড়িঙ্গে লোকটার দিকে। পাইকরা তাকে ধরে ফেলল।
বিশ্বনাথ সামান্য হেসে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে। সিড়িঙ্গে লোকটা মাটিতে তার হাড়জিরজিরে বুক ঘষটে ঘষটে এগিয়ে এসে বিশ্বনাথের পা-টা চেপে ধরল। বিশ্বনাথের পরিষ্কার মনে হল একটা লোহার শেকল তার পায়ে পড়িয়ে দিয়েছে কেউ। সে মুখ বিকৃত করে আর্তনাদ করে উঠল।
রমাকান্তর আরেক পাইক ছুটে এসে একখানা বর্শার ফলা গেঁথে দিল লোকটার কবজি বরাবর, লোকটা আবারও কয়েকটা অস্পষ্ট শব্দে চিৎকার করে উঠল। পাইক বর্শাটার রক্তমাখা ফলাখানা লোকটার কবজি থেকে বের করে নিয়ে লোকটার বুক বরাবর মারল এক লাথি।
যুবতীটি ছটফট করতে করতে মাটিতে বসে পড়েছে ততক্ষণে। দুটো হাত প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত হচ্ছে দুজন পাইকের দুটো শক্ত হাতের মুষ্টির মধ্যে।
রমাকান্ত পালকির মধ্যে বসে পর্দা ফাঁক করে এই গোটা ঘটনাটা দেখতে দেখতে ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছিল। ওই সিড়িঙ্গে লোকটার লাশ ফেলে দিলেই হত। কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে ব্যাগড়া দিচ্ছে কার্যসিদ্ধিতে।
লোকটা পড়ে রইল ধুলোবালি কালিঝুলি রক্ত মেখে।
বিশ্বনাথের নির্দেশে পাইকরা যুবতীটিকে প্রায় পাঁজকোলা করে এনে তুলল রমাকান্তর পালকিতে।
দূরে দাঁড়িয়ে এই গোটা দৃশ্যটা দেখছিল ইন্দ্রকমল। তার চোখ আগ্নেয়গিরি থেকে ছিটকে আসা লাভার মতন ভয়াবহ, স্থাণু পাথরের মতন অবিচল। রাধামোহন ইন্দ্রকমলের চোখের দিকে তাকাল একবার। সে চেনে তার মনিবের এই দৃষ্টি। সে জানে কী ঘটতে চলেছে এরপর।
কিছুক্ষণ রমাকান্তর পালকির দিকে চেয়ে থেকে ইন্দ্রকমল রওনা দিল নিজের জুড়িগাড়ির উদ্দেশ্যে। পেছনে রাধামোহন।
ভিড় ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করল। যে যার পথ ধরল।
এইসময় দেখা গেল রংবেরঙের তাপ্পিমারা নীল কোটপরা, গলায় স্কার্ফবাঁধা এক সাহেবকে। তার চোখের মণি তার কোটের রং-এর চেয়েও বেশি নীল বোধহয়। সুপুরুষ, দীর্ঘাঙ্গী সাহেব ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল শুয়ে থাকা লোকটার সামনে।
লোকটা ঘৃণা যন্ত্রণা রাগমাখানো চোখ তুলে তাকাল সাহেবের দিকে।
সাহেব হাত বাড়িয়ে দিল লোকটির দিকে।
লোকটা সন্দেহমাখা চোখ নিয়ে তাকাচ্ছিল সাহেবের দিকে। সাহেব কিছুক্ষণ লোকটার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর খানিক নীচু হয়ে লোকটার ক্ষতবিক্ষত হাতটা ধরল পরম মমতায়, তারপর আচমকা হ্যাঁচকা টানে তুলে ধরল লোকটাকে, দাঁড় করাল সোজা।
সাহেবের নাম এইচ. এম জেমসন। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। বরখাস্ত হয়ে এখন জেমসন সাহেব মিশে থাকেন ভিড়ের মধ্যে। কী তার মতলব কেউই বিশেষ জানে না!
লোকটির একটি হাত নিজের কাঁধের ওপর রেখে লোকটিকে বহন করে নিয়ে চললেন জেমসন সাহেব।
শহরজুড়ে ঢি ঢি পড়ে গেল। রমাকান্ত প্রকাশ্যে নারীহরণ করিয়েছে। রমাকান্তর অনুচর বিশ্বনাথ এবং তার বাদবাকি সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকাশ্যে জোড়াদীঘির মাঠের সামনে থেকে এক গ্রাম্য যুবতীকে তুলে নিয়ে গেছে। রমাকান্তর মোসাহেবদের একজন বলেছে যুবতীটি রমাকান্তর “ঘরেরই মেয়েমানুষ”! রসিকতা করে ‘সম্বাদ রসরাজ’-এ লেখা হয়েছে “যৌবনবতী আর রূপসী কোন রমণীই বা রমাকান্তর ‘ঘরেরই মেয়েমানুষ’ নহে?”
রমাকান্ত এসবকে বিশেষ পরোয়া করে না কোনওকালেই। সে একরকম হারেম খুলে বসে আছে তার শোভাবাজারের বাড়িতে।
সন্ধে নামলেই পাপের দরজা খুলে যায় কলকাতা শহরে। চিৎপুরের এক গলিতে এক নব্য বাবু নেশার ঘোরে মালা জড়িয়ে টলমল হাঁটছিলেন এবং মাঝেমধ্যেই উচ্চস্বরে ‘আমায় দে মা তবিলদারি’ গেয়ে উঠছিলেন।
কমলার ঘরের সামনে এসে বাবুর নেশা খানিক চোট খেল। এত অন্ধকার, এত নির্জন কেন কমলার ঘর?
নব্য বাবুর এসব নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। তিনি বীরবিক্রমে দরজায় সজোরে পদাঘাত করলেন। দরজা সশব্দে হাট করে খুলে গেল।
কমলা নেই ঘরে।
বাবু আবার বেরিয়ে এলেন গলিতে।
অন্ধকার গলির মধ্যে খানিক বিভ্রান্ত হয়ে বাবু পেছনে ফিরলেন। জনশূন্য গলি। থমকালেন বাবু, তার ইয়ারবক্সি কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয়ার্ত হয়ে পিছু হাঁটতে গেলেন।
হনহন করে হাঁটতে শুরু করেছিলেন বাবু। এমন সময় ধুতির আলগা কোঁচা জড়িয়ে গেল পায়ের সঙ্গে। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলেন কোনওমতে।
ঠিক তক্ষুণি গলায় একটা ধাতব স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি। বাবুর প্রাণ ততক্ষণে গলায় চলে এসেছে।
একটা ধারালো ছুরি গলার সামনে ধরা।
বাবু ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। গলায় ছুরির ঠান্ডা ছোঁয়াচ আরও স্পষ্ট হল।
“শুধুশুধু বেগড়বাঁই করেন কেন বাবু? গরিবের অন্ন জোটে এমন বন্দোবস্ত করে দিন! তাহলেই হবে!”
নেশা, বেশ্যা, বিলাস, অপরাধ! সাহেবরা যাকে কলকাতার ‘ব্ল্যাক টাউন’ বলে, সেখানে বনেদি সন্ধে গড়িয়ে চলে।
সেই সন্ধ্যেবেলায় আতর মেখে ছড়ি নিয়ে বেরোতে চলেছে রমাকান্ত, এমন সময় রমাকান্তর বাড়ির বাইরে একটা জুড়িগাড়ি এসে দাঁড়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জুড়িগাড়ির শব্দ শুনে রমাকান্তর ভুরু কুঁচকে গেল। সে যা ভাবছে তা কি সত্যি? সত্যিই কি…
রমাকান্তর ভাবনা অমূলক নয়। জুড়িগাড়ির দরজা খুলে গেল, পাদানিতে পা রেখে মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন ইন্দ্রকমল সিংহ!
প্রায়ান্ধকার একটা পোড়ো বাড়ির ভেতর তখন একটা ভাঙা চেয়ারে বসে হাত পা ছুঁড়ে অবোধ্য ভাষায় চিৎকার করে চলেছে সকালের লোকটা।
সামনে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন জেমসন সাহেব।
এইচ এম জেমসন।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)