অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
কোকিলের ডাকে পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠছে ফুলেরা।
গঙ্গার জল নেমে যাচ্ছে — নিচে, অনেক নিচে।
একটা পেটমোটা লোক অনেকগুলি পেটমোটা শুয়োরকে খাবার দিচ্ছে।
একজন হিজরে — ঘাটের মাথায়।
পেটমোটা লোকটা ভাঙা ডাবায় খাবার ঢেলে সরে যায়।
তখন দেখা যায় হিজরেটা তার পেট বার করে দাঁড়িয়ে আছে। নাভির অনেকটা নিচে শাড়ি।
লোকটা শুয়োরদের জন্য টিঊকলের জল আনছে। ড্রামে করে। ঘাটের মাথায় কল।
গঙ্গা দিয়ে দূষণ বয়ে যাচ্ছে।
শুয়োরেরা মারপিট করে খাচ্ছে।
ঘোঁত ঘোঁত — ঘোঁত ঘোঁত।
হিজরেটা অপেক্ষা করছে।
সেক্সের বাজার এদিকে নাকি ভালোই চলে।
লরিওলা, ধাবাওলা, বাসের খালাসিরাও এখন এদের পছন্দ করে। এর ভেতর কিছু মধ্যবিত্ত পুরুষও আছে।
ঘাটে কিছু মানুষ স্নান করছে। কেউ কেউ এসে প্লাস্টিকে ফল বেঁধে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বোতলে জল ভরে নিয়ে যাচ্ছে। জল নেমে গিয়ে সিঁড়িতে থকথকে কাদামাটি জমে আছে। মাটির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ভাঙা শাঁখা। কেউ কেউ সেই মাটি তুলে গায়ে মাখছে। ওপারে কিছু জেলেনৌকা জাল ফেলে বসে আছে। এপারে একটা নৌকা ঘাটের তফাতে গাছের ছায়াতে নোঙর করে আছে।
এটা চৈত্রমাস — এই মাসে এমনই হয় — বলে উঠে গেল সেই লোকটা যে এতক্ষণ ঘাটের মাথায় বাঁধানো বটের নিচে বসে সুর করে হিন্দি রামায়ণ পড়ছিল আপনমনে।
ঘোঁত ঘোঁত — ঘোঁত ঘোঁত।
জল ও খাবার শেষ করে নানা বয়সের কুড়িটা শুয়োর ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।
মানুষজন স্নান করছে।
উঠছে… নামছে…
হিজড়েটা এগিয়ে এসে বলল, এখানে কোথায় কাপড় খোলে?
আঙুলের ইশারায় তাকে ঘর দেখালাম। তার ছাদে অনেকগুলি কার্তিকঠাকুর।
শুয়োরের মালিক চলে যাচ্ছে।
নৌকা নোঙর তুলে এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। ছইয়ের ভেতর একজন বৃদ্ধ। বাইরে এক অল্পবয়সী ছোকরা। উবু হয়ে ফর্সা রঙের জাল গুটোচ্ছে। হিজরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে, হাসছে। হিজরে ঘাটের ভেতরে নেমে ক্যারকেরে গলায় বলল, হারামজাদা, নৌকা ভিড়া। ঝাঁপ দিয়ে কি নৌকায় উঠব তোর? তারপর কাপড় ভিজলে কি পরব? তোর কাঁচি জাঙিয়া?
কদম গাছের ডালে বসে কয়েকটি কাক চিল্লিয়ে উঠল। অমনি ঢিপঢপ করে কয়েকটি কদমফুল খসে পড়ল। হিজরেটা নৌকা তাক করে ছুঁড়তে লাগল।
লোকজন তেড়ে এল। স্নান করছি দেখতে পাচ্ছিস না? ঢিল ছুঁড়ছিস কেন? মাথা ফাটলে কি তোর হেঁড়ে মাথাটা খুলে নিয়ে লাগাব?
সে আমার পিছনে মুখ লুকাল। তার দেহের ভার এখন আমার পিঠে।
কেউ সাবান ডলছে… একজন গান করছে… মাতাল জলের ভেতর ডিগবাজি খাচ্ছে… নৌকা চলে যাচ্ছে। কয়েকজন গাঁজার কলকে গামছার আড়ালে লুকিয়ে নেমে যাচ্ছে যেখানে ঘাট নেই।
হিজরে বলল, একটা গুলঞ্চগাছ দিতে পারো?
শুয়োরগুলো কচুঝোপের ভেতর গাদাগাদি করছে, কাদা করছে। ঘাটের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা ধরনের আবর্জনা। নদীর পারেই একটা ভ্যাট। সেখানেও নানাজাতের ময়লা। তা থেকে মাঝেমাঝে গন্ধ উঠে আসছে। গঙ্গার জোয়ার এই ময়লা টেনে নিয়ে চলে যায়।
বললাম, আমিও খুঁজছি।
পেয়েছ?
না।
তবে চলো দুইজনে মিলে খুঁজি।
উঠে পড়ি। নদীর জল আরও নেমে যাচ্ছে। ঘাটের দুদিকের কাদামাটিতে গেঁথে আছে মালসা, ইট, মদের বোতল, জামা-কাপড়, প্লাসটিকের জলের বোতল আর হাজার হাজার কচুরিপানার দাম। আটকে আছে দুই একটি চিংড়ি, ছোট মাছ। মাঝজল দিয়ে পরপর ভেসে যাচ্ছে থার্মোকলের কাজ। তার উপর বসে আছে কাক। তারা সব সমুদ্র দেখতে যাচ্ছে। আহা, সমুদ্রযাত্রা!
নদী নেমে যাচ্ছে।
হাঁটছি—
বট, অথত্থ, নিম… কই গুলঞ্চ?
গুলঞ্চগাছ নিয়ে তুমি কী করবে?
কিছুই না।
তবে?
এমনিই। তুমি?
এমনি নয়।
তবে?
গুলঞ্চগাছের অনেক কাহিনী আছে।
যেমন?
নদীর মতো সেই কাহিনী সমুদ্রের দিকে ভেসে যায়।
নদী-ঘাট-প্রেম-চুম্বন — গুলঞ্চ কই?
একজন বলল, গুলঞ্চগাছ? সে আছে ঐ মন্দিরটাতে।
চলো তবে, যাওয়া যাক।
যাচ্ছি…
দেবে?
দেবে…
অবশেষে সেই মন্দির।
বন্ধ।
ভেতরে গুলঞ্চগাছ মাথা দোলায় নদীর বাতাসে। মন্দিরের বড় গেটে টোকা দিই। একজন সেবায়েত ছোট গেট খুলে বেরিয়ে আসে। সাদা ধুতি। সাদা উড়নি। কপাল চন্দনচর্চিত। পরিষ্কার কামানো মুখ।
কী চাই?
গুলঞ্চগাছ।
এখন হবে না।
কেন?
প্রধান পুরোহিত বিশ্রাম নিচ্ছেন।
কখন ওনার ঘুম ভাঙবে?
ওনাদের ঘুম ভাঙে না, ওনারা জেগে ওঠেন। সেটা ওনাদের ইচ্ছাধীন।
সেই ইচ্ছাধীন সময় কখন আসবে?
আপনাকে আমি চিনি। সেবার অন্য একটি মেয়েছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। গুলঞ্চগাছ চাইতে। আজ আবার এসেছেন। মেয়েছেলেও পাল্টেছেন। এবার আরও উন্নতজাতের মেয়েছেলে — হিহি! সেই একই দাবি। গুলঞ্চগাছ। একজন হিজড়ে গুলঞ্চগাছ কোথায় পুঁতবে?
ঘুষি।
সেবায়েত মাটিতে। নাক দিয়ে রক্ত।
দৌড়…
দুপুরের ফাঁকা রাস্তাঘাট। তবুও সেবায়েত চিৎকার করছে।
হিজড়েটা পিছন ফিরে বলল, এটা চৈত্রমাস, মনে রাখিস ছোটবামুন।
এবার সেবায়েত গালাগাল করছে। পালটা দিল হিজড়েও।
দৌড়… দৌড়…
গঙ্গার ঘাট।
জুটমিলের শ্রমিকেরা ঘাটে নেমে গঙ্গাজলে টায়ারের জুতো থেকে ঘষে ঘষে ময়লা তুলছে। হাত মুখ পা ধুচ্ছে রগড়ে রগড়ে।
একটা নৌকা। একেবারে ঘাটে ভিড়ল। মাঝবয়েসি এক লোক। বাইরে এসে হাত বাড়াল। হিজড়েটা সেই হাত ধরে উঠে গেল। বিহারি শ্রমিকেরা হেসে উঠল। একজন বলল, কি মাঝি, মাছ আছে নাকি?
মাঝি বলল, জেলে দেখলেই মাছের খোঁজ, অ্যাঁ? জাল সবে ফেলেছি, এখন তিনঘণ্টা।
আর একজন বলল, এই তো মাঝি আড়া থেকে এতবড় একটা মাছ ধরলে, জলের মাছ নিয়ে কোন কারবারটা করবে শুনি?
সকলে অমনি হেসে উঠল।
নৌকা থেকে হাত নেড়ে হিজড়েটা বলল, কাল এই সময় এসো, কথা আছে।
শ্রমিকেরা আবার হাসল।
গঙ্গার জল বাড়ছে।
সেই জলে নৌকাটা এগিয়ে যাচ্ছে নদীর পেটের দিকে। বাইরে কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না।
একটা কুকুর এসে জল খেয়ে গেল। গঙ্গার ধারে বসে কেউ একজন খুঁ খুঁ করে কেঁদে চলেছে।
টুপটাপ বটফল ঝরে পড়ছে।
গাছভর্তি কদমফুল।
চৈত্রে এমনি হয়।
ঘাট ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেল।
নদী থেকে জল তুলে নিচ্ছে কাক-শালিক-চড়ুই। বটগাছে তাদের কুটির।
মাটি ধুয়ে যাচ্ছে জোয়ারের জলে। ঢেকে যাচ্ছে শাঁখা। ডুবে যাচ্ছে সিঁড়ি। শুয়োরের হাত-পায়ের ছাপ।
একটা লোক এল। হাতে হনুমান চালিশা।
পড়ছে।
ঘাটের ধাপে বসে।
দুলে দুলে পড়ছে আর কাঁদছে।
পড়া শেষ হল। বাতাস ঠান্ডা হয়ে আছে। নদীর ছায়া পড়ছে নদীতে।
কী হল কাকা, কাঁদো কেন?
এমনি।
এমনি কেউ কাঁদে?
সীতা মাইয়ার বনবাসের জন্য কাঁদছ?
তা নয়।
তবে?
আমার মেয়ে মারা গেল। গেল চৈত্র মাসে। এক হি লেড়কি থা হামারা।
কী হয়েছিল?
পেট মে বাচ্চা আ গয়ে থে।
বিষ খেয়েছিল?
না।
তবে?
বাড়ির গুলঞ্চগাছে ফাঁস লাগিয়ে গঙ্গা মাঈ কি পাস চলে গেল।