‘নিকাহ্ হালালা’ — ‘কনসেন্ট’ যেখানে অবান্তর

শতাব্দী দাশ

 

‘নিকাহ্ হালালা’ ও বহুবিবাহ নিয়ে বিভিন্ন পিটিশনের প্রথম শুনানি ছিল সুপ্রিম কোর্টে গত ২০শে জুলাই, যা হয়ত ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ রদের পর আবার এক বিতর্কিত কিন্তু উল্লেখযোগ্য রায়ের পথে প্রথম পদক্ষেপ।

‘নিকাহ্ হালালা’ নামক অমানবিক প্রথার কথা প্রথম জেনেছিলাম মহাশ্বেতা দেবীর ‘তালাক’ গল্প থেকে। সেখানে আরশাদ ছত্রিশ বছরের দাম্পত্যের পর রাগের মাথায় কুলসুমকে ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বলে দেয়! অথচ তালাকের জন্য প্রস্তুত ছিল না দুজনের কেউই। তাহলে উপায়? কীভাবে কুলসুমকে আবার ঘরে তুলবে সে? পুনর্বিবাহ করলেই কি হয়? না, হয় না।

শরিয়তি আইনে নাকি বিধান বাতলেছে এরকম: তিনবার তালাক দেওয়ার পর সেই স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করতে হলে, পুনর্বিবাহের আগে মহিলাকে অন্য একজনকে বিবাহ করতে হবে। শুধু বিবাহ নয়, যৌনসঙ্গম করতে হবে তার সঙ্গে। তারপর যদি সেই দ্বিতীয় ‘স্বামী’ মহিলাকে আবার তালাক দেন, তবেই প্রথম ‘স্বামী’ তাকে পুনর্বিবাহ করতে পারবে। বলা বাহুল্য, এই দ্বিতীয় বিবাহে ও দ্বিতীয়জনের সাথে যৌন সঙ্গমে নারীর কোনও সম্মতি বা এজেন্সির প্রশ্ন অবান্তর।

মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে মধ্যবয়সী কুলি-আরশাদ নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চোরের মতো কলকাতায় পালায়। কুলি বলে, বেকবাগানের অসংখ্য ভাড়াঘরের মধ্যে একটিতে সে, অন্যটিতে আরশাদ থাকবে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে না হোক, কাছাকাছি থাকা তো হবে! অন্য পুরুষের সাথে শুতে বাধ্য হওয়ার চেয়ে তা ঢের ভালো! পরবর্তীকালে সিগাল ‘টিল ডেথ ডু আস পার্ট’ নামক পাঁচ-গল্পের সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করে এর ইংরেজি অনুবাদ — ‘দ্য ডিভোর্স’।

‘নিকাহ্ হালালা’-র পদ্ধতিগত খুঁটিনাটি, ভারতীয় প্রেক্ষিতে তার প্রয়োগ ও ফলাফল নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল আলোচনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। বহু মুসলিম মহিলাই ‘নিকাহ্ হালালা’-র বিরুদ্ধে পিটিশন জমা করেছিলেন বহুদিন ধরে। তারই ফলস্বরূপ সুপ্রিম কোর্ট গত মার্চে ‘নিকাহ হালালা’ ও মুসলিম বহুবিবাহ সম্পর্কে সরকারকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতে বলে। জানা যায়, সরকার উভয়কেই “ক্রিমিনালাইজ’ করতে আগ্রহী। অতঃপর ২০শে জুলাই-এর প্রথম শুনানি। এমতাবস্থায়, কোনো মুসলিম নারীর কলমেই এই লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনমূলক প্রথার বিরুদ্ধে নিবন্ধ পড়তে পারলে ভালো লাগত। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর পদবী বহন করে সংখ্যালঘুর বিবাহ-আইন নিয়ে বলার চেয়ে তাঁদেরকেই মাইক এগিয়ে দেওয়া ও শ্রোতা হিসেবে উৎকর্ণ হওয়া রাজনৈতিকভাবে সমীচীন। তা সত্ত্বেও লিখতে হচ্ছে যখন, তখন আরেক ধরনের প্রান্তিকতা, নারীর লিঙ্গগত প্রান্তিকতার অধিকার থেকেই লেখা যাক৷

‘নিকাহ্’ কথার অর্থ হল বিবাহ৷ ‘হালালা’ হল বে-আইনি কোনও কিছুর আইনিকরণ। ‘আল-বাকারাহ’-র ২.২৩০ নং সুরায় বলা হয়েছে — ‘যদি পুরুষ নারীকে তৃতীয়বার তালাক দেয়, তাহলে সে আর তার আইনি স্ত্রী কখনও হতে পারবে না, যদি না তার দ্বিতীয় বিবাহ হয় ও দ্বিতীয় স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়।’ নবীর এই বিধানকে শিরোধার্য করেই ভারতে ‘নিকাহ্ হালালা’-র বাড়বাড়ন্ত, যদিও ইসলাম ধর্মে ও কোরাণে যাঁরা প্রকৃত পণ্ডিত, তাঁরা বারবার দাবি করেন, এই প্রথা আসলে কোরাণ-বিরোধী। তাঁদের যুক্তিগুলিতে পরে আসব৷

গতবছরের শেষদিকে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ স্টিং অপারেশন চালিয়ে বুঝতে চেয়েছিল কীভাবে এই পদ্ধতি ভারতে বাস্তবায়িত হয়। জানা গেছিল, মৌলবীরাই অনেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ‘নিকাহ্ হালালা’ ঘটিয়ে থাকে৷ অনেকেরই অফিসের সঙ্গে থাকে লাগোয়া শয়নকক্ষ৷ সেখানে দিনের যেকোনও সময়ে তারা ক্লায়েন্টের সাথে শুতে পারে, তাকে ‘নিকাহ্’ করে। তারপর তারা সেই ক্লায়েন্টকে ‘তালাক’-ও দেয় নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে। লেনদেন হয় পাঁচ বা ছয় অঙ্কের টাকায়। ক্লায়েন্টের পকেট বুঝে ২০ হাজার থেকে ১.৫ লাখ পর্যন্ত দাবি করা হয়৷

‘নিকাহ্ হালালা’-র আড়ালে ঘটে আরও অনেক অপরাধ৷ তার মধ্যে কতগুলিতে চোখ বোলানো যাক।

ঘটনা এক: এবছরের জুলাই মাসেই উত্তর প্রদেশের এক মহিলাকে তাঁর স্বামী তালাক দেয়। তারপর ‘নিকাহ্ হালালা’-র নাম করে তার ঘরে অন্য পুরুষ ঢোকায়। স্বামীসহ চারজন শেষপর্যন্ত গণধর্ষণ করে মহিলাকে। অতঃপর পুনর্বিবাহও হয় না।

ঘটনা দুই: এই উত্তর প্রদেশেরই বারেলিতে এক নারী নিকাহ্ হালালার অজুহাতে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে। পণের দাবি তুলে বর প্রথমবার ‘তালাক’ দেয়। তারপর জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটিরই শ্বশুরের সাথে। সেই বিয়ে ভেঙে হয় আগের স্বামীর সাথে পুনর্বিবাহ। কিছু বছর পর আবারও তালাক দেওয়া হয়। এবার জোর করা হয় দেওরকে বিয়ে করার জন্য, তার সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য। সামনে ঝোলানো থাকে সেই প্রথম স্বামীকে পুনর্বিবাহ-র গাজর। কিন্তু এবার মেয়েটি বেঁকে বসে। হাজির হয় সমাজকর্মী নিদা খানের (যিনি নিজেও নিকাহ হালালার শিকার) কাছে। বারেলির ইমামের অবশ্য এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্য হল — মিডিয়ায় সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে আজকাল মহিলারা কথায় কথায় শরিয়ত অমান্য করছে।

ঘটনা তিন: একইরকমভাবে, আর এক মহিলা বাধ্য হয় ‘নিকাহ্ হালালা’-র নামে শ্বশুরকে বিবাহ করতে। তারপর পুরনো স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার পর তার গর্ভে আসা সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়৷ তাকে গর্ভপাত করতে চাপ দেওয়া হয়, কারণ স্ত্রীর গর্ভে পিতার সন্তানের (অর্থাৎ অনুজ-র) উপস্থিতিও শরিয়ত বিরোধী। ‘মেরা হক’ এন.জি.ও জাতীয় ও রাজ্য মহিলা কমিশনের কাছে এই কেসটি নিয়ে আসে। সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়া পিটিশনগুলির মধ্যে এই মেয়েটির পিটিশন অন্যতম।

ঘটনা ৪: বন্ধুর সাথে জুয়ায় বউকে বাজি রেখে হারল এক ‘স্বামী’। বন্ধু বলল, শুতে চায় তার স্ত্রীর সাথে। তাই স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিল। স্ত্রী ধর্ষিত হল (ধর্ষিতার দাবি অনুযায়ী)। কিন্তু বন্ধু কোর্টে বলল, সে শারীরিক সঙ্গম করেছে, তার আগে নিকাহ্-ও করেছিল, কারণ এসব ‘নিকাহ্ হালালা’-র অংশ।

এরকম আরও অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে, নারীর যৌনতায় সম্মতির প্রাথমিক শর্ত উপেক্ষিত হয় এই প্রথায়, কারণ নারী এখানে হয় অসম্মত, নয় চাপে পড়ে সম্মতি দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে বিবিসি ইউকে-তে সমীক্ষা চালিয়ে দেখে, সে দেশেও দক্ষিণ এশীয় মুসলমানদের মধ্যে ‘নিকাহ্-হালালা’-র প্রকোপ যথেষ্ট। আবার ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট খুলে বা সোশ্যাল-মিডিয়া-পেজের মাধ্যমে ‘নিকাহ্ হালালা’-কে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যে ক্লায়েন্ট মেয়েটি প্রথম স্বামীর কাছে ফিরতে চায়, সে এমন আগ্রহী পুরুষ আন্তর্জালে খুঁজে পেতে পারে, যে অর্থের বিনিময়ে নিকাহ্ করে, শারীরিক সম্পর্ক করে, তারপর তালাক দিতে রাজি। টুইটারের ‘হালাল নিকাহ্’ পেজটি যেমন নিজের বর্ণনায় লিখেছে: ‘আসসালামু আলাইকুম, আলমাদুলিল্লাহ! মুসলিম বিশ্বনাগরিক এখানে বিবাহের সংযোগ খুঁজে পাবেন। শীঘ্রই সুযোগ নিন…’ ইত্যাদি।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড-এর ভূমিকা চিরকালই শরিয়তপন্থী৷ তাঁরা অনেকবারই বলেছেন — মুসলিম আইনে পরিবর্তনের যেকোনও প্রচেষ্টাই আল্লা-র ইচ্ছেবিরোধী৷ AIMPLB-র সহ সভাপতি মৌলানা সৈয়দ জালালুদ্দিন উমরি ‘নিকাহ্ হালালা’ সম্পর্কে যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হল: ভারতে লক্ষ লক্ষ বিচ্ছেদ হয়। তার মধ্যে শতকরা হিসেবে বিচ্ছেদের পর ‘নিকাহ্ হালালা’ ঘটছে, এমন কেসের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তার উপর, প্রধানত ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ বা তালাক-এ-বিদ্দতের ক্ষেত্রেই এই ‘নিকাহ্-হালালা’-র আশ্রয় নেওয়া হত। অন্য তালাকের ক্ষেত্রে এসবের প্রয়োজন খুব একটা দেখা যায় না। সুতরাং ‘তালাক-এ-বিদ্দত’ উঠে যাওয়ার পর আবার আলাদা করে ‘নিকাহ্ হালালা’ নিয়ে শুনানি নিষ্প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

সুখের বিষয় হল, মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহল থেকে বারবার এই বক্তব্য উঠে আসছে এতদিনে যে, শুধু উত্তর প্রদেশের ঘটনার মতো ‘ম্যানিফেস্ট রেপ’-এর ক্ষেত্রে নয়, যে কোনও ‘নিকাহ্ হালালা’ আসলে ধর্ষণেরই নামান্তর। ঐতিহাসিক রাণা সাফভি যেমন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের বিরোধিতা করে প্রশ্ন তুলেছেন — পার্সেন্টেজের দিক থেকে যতই নগণ্য হোক এই ঘটনা, মাত্র একজন মহিলাও বা ‘নিকাহ্ হালালা’-র যন্ত্রণা কেন ভোগ করবেন? তিনিও ‘নিকাহ্ হালালা’-কে কোরাণ-বিরোধী আখ্যা দেন।

শুধু তিনি নন, বিংশ শতকের প্রথমার্ধে পরাধীন ভারতীয় মুসলিম জুরিস্ট মৌলানা আশরফ আলি থানভি (১৮৬৩-১৮৪৩) ইসলামি বিশ্বাস ও রীতি-নীতির এক হ্যান্ডবুক লেখেন — ‘বাহিস্তি জেওয়াস’। সেখানে তিনি ‘তালাক’ ও ‘নিকাহ্ হালালা’-র ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে:

স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল হলে, তা মিটিয়ে নিতে হবে। নাহলে, পরের ধাপে বাড়ির গুরুজনেরা দুজনকে বোঝাবে। এতেও কোনও কাজ না হলে, “প্রথম তালাক” দেওয়া যায়। এর অর্থ, এক ঋতুকাল অব্দি দুজনে আলাদা থাকবে, কোনও শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না, যদিও তারা এক ছাদের তলায় থাকবে। একে ‘ইদ্দত’ কাল বলে৷ এখন, এই সময়কালে তাদের মিলন হলে, ‘তালাক’ বাতিল হবে।

আর যদি এক ঋতুকাল পরেও তাদের সম্পর্ক ঠিক না হয়, বা তারা মিলিত না হয়, তখন আর এক ঋতুকাল তারা শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকবে। অন্তত দুই ঋতুকাল পরে “দ্বিতীয় তালাক” দেওয়া যায়। আবার এমনও হতে পারে সেই দ্বিতীয় তালাকের আর কখনও প্রয়োজন পড়ল না, পুনর্মিলন হয়ে গেল। বা প্রয়োজন পড়ল বেশ ক’বছর পর৷

এই দ্বিতীয় তালাকও প্রথম তালাকের মতো উপায়েই নাকচ হতে পারে দুই ঋতুকালের মধ্যে মানসিক ব্যবধান ঘুচলে, শারীরিক মিলন হলে৷ কিন্তু কয়েক মাস বা বছর পরে যদি “তৃতীয় তালাক”-ও দেওয়া হয়ে যায়, তখন ইসলাম সেই স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করতে বাধা দেয় বটে। এই অবস্থায় স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন বা অবিবাহিত থাকতে পারেন। দ্বিতীয় বিবাহে শারীরিক মিলনের পর, একই পদ্ধতিতে আবার ডিভোর্স হলে, তিনি প্রথম স্বামীর কাছে ফিরতে পারেন। শারীরিক মিলনের আগে দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিলে বা মারা গেলে প্রথম স্বামীর কাছে ফেরার উপায় নেই। অর্থাৎ, ‘নিকাহ্ হালালা’-র বিধান ছিল। কিন্তু তার প্রয়োগ এত যথেচ্ছভাবে হবে, তেমন দূরদৃষ্টি ছিল না।

‘ইন্ডিয়ান ল ইন্সটিটিউট’-এর গবেষক ফুরকান আহমেদ বলেন, আসলে মহম্মদের উদ্দেশ্য ছিল একটি অরাজকতাপূর্ণ সমাজে বিবাহ ও বিচ্ছেদকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বিবাহ যাতে লোকে, বিশেষত পুরুষেরা, খেলাচ্ছলে ভাঙতে না পারে, বারবার ভাঙতে না পারে, তারই প্রচেষ্টা ছিল এই অনুশাসন।

অবশ্য উপরিউক্ত এই যুক্তিও নারীবাদীদের মতে প্রো-ম্যারেজ ও ডিভোর্স-বিরোধী, তাই তার সমালোচনাও হতে পারে। কিন্তু বহুযুগ আগে, একটা যাযাবর জাতিকে সামাজিক অনুশাসনে বাঁধার প্রয়োজন মনে করেছিলেন মহম্মদ, আর তা করতে গিয়ে এইসব নিয়মনীতির অবতারণা করতে হয়েছিল হয়ত। গোড়ার উদ্দেশ্য ততটাও নারীবিরোধী ছিল না, বরং নারীকে পুরুষের যথেচ্ছাচার থেকে বাঁচাতেই চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতে ভাষাগত ব্যবধান (আরবি ভাষা পাঠ সাধারণ মুসলিমের করায়ত্ত নয়) ও অসদুদ্দেশ্য — এই দুই কারণে কোরাণের অপব্যাখ্যা প্রায়শই হয়ে থাকে, ইসলামি স্কলারেদের মতে।

‘তালাক’ বিষয়ে আরও বলা হয়ে থাকে, রাগের মাথায় কেউ তিন তালাক দিলে, তার একটাও তালাক গণ্য হওয়ার কথা নয়। হতাশায় দেওয়া তালাকও গণ্য হবে না। নেশার মধ্যে দেওয়া তালাক মান্য নয়। চিঠি বা ফোনে দেওয়া তালাক গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ ইন্সট্যান্ট তিন তালাক, যা এতদিন বাদে সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ করল, তা আসলে নাকি কোরাণেরও স্বীকৃতি পায়নি কখনও৷ কিন্তু ঘটনা হল, তাৎক্ষণিক তিন তালাক এতদসত্ত্বেও রমরমিয়ে চলত। ঠিক একইভাবে, বর্তমানে ‘নিকাহ্ হালালা’-ও বহাল এ দেশে।

মাথায় রাখতে হবে, বিবাহ-চুক্তিতে কিন্তু কোথাও লেখা হয় না যে ‘আগের স্বামীকে পুনর্বিবাহের উদ্দেশ্যেই অস্থায়ী বিবাহ করা হচ্ছে।’ এই উদ্দেশ্যে বিয়ে আসলে ইসলামে ‘হারাম’৷ ‘মুতাহ্’ বিবাহ বা সজ্ঞানে অস্থায়ী বিয়ে ‘পাপ’ ইসলাম মতে। আর প্রথম স্বামীকে পুনর্বিবাহের উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে বা ‘তহলিল’ বিবাহও ‘হারাম’। উল্লেখ্য, রশিদুন খালিফতের দ্বিতীয় খালিফা উমর (৫৭৯-৬৪৪ খৃষ্টাব্দ) এরকম বিয়ের ক্ষেত্রে মুহাল্লিল লাহু (দ্বিতীয় স্বামী) ও মুহাল্লাল লাহু (প্রথম স্বামী) উভয়কেই পাথর মেরে হত্যার নিষ্ঠুর বিধান দিয়েছিলেন। সুতরাং বর্তমানে, উদ্দেশ্য সেরকম থাকলেও, খাতায় কলমে তার উল্লেখ থাকে না।

সুপ্রিম কোর্টে ২০ জুলাই থেকে যে শুনানি শুরু হয়েছে, সেখানে ‘নিকাহ্ হালালা’ ছাড়াও বহুবিবাহের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঐতিহাসিক রাণা সালভির ‘নিকাহ্ হালালা’ বিষয়ক বক্তব্য আগেই বলা হয়েছে। ৬ জুলাই, ২০১৮-র ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এ তিনি মুসলিম বহুবিবাহ নিয়েও কিছু কথা বলছেন:

“There are only two verses in the Quran which talk of polygamy in the Surah Nisa, verses 3 and 129. Both are in response to a specific situation and set many conditions. In the 7th century, when many wars were taking place, and there were many orphans and widows, verse 3 recommended that men could marry the female orphans under their care if they felt they couldn’t act equitably towards them otherwise, with the rider that if you could not treat them with equal fairness, then marry only one. Thus polygamy was allowed only if they could treat wives equally and verse 129 clarified, ‘It will not be within your power to treat your wives with equal fairness, however much you may desire.’ So, nowhere does the Quran give carte blanche for Muslim men to indulge in polygamy.”

অর্থাৎ বহুবিবাহের মধ্যযুগীয় স্বীকৃতির পিছনে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ছিল, ছিল শর্ত। এখন আমরা মধ্যযুগে বাস করছি না, তাই বহুবিবাহ অপ্রয়োজনীয়৷ উপরন্তু বহুবিবাহের প্রাক্ শর্ত ও বিবাহোত্তর শর্তগুলিও মেনে চলা হয় না। পলিগ্যামির ক্ষেত্রেও তার মানে কোরাণের বিকৃতিই ঘটানো হয়েছে, রাণা ও অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতদের দাবি অনুযায়ী।

তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রচণ্ড বিরোধিতার মধ্যে গতবছর রদ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তার পিছনে নিশ্চয় ছিল বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা। কিন্তু তাতে আখেরে মুসলিম নারীসমাজ আশ্বস্তই হয়েছিল। ‘নিকাহ্ হালালা’ বা বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সর্ব্বোচ্চ আদালত কী সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, মুসলিম নারীসমাজ তাকে স্বাগত জানায় কিনা, জন্মসূত্রে হিন্দু-সংখ্যাগুরু কিন্তু রাজনীতিতে সেক্যুলার ব্যক্তিবর্গ বিষয়টিকে প্র‍থমত ‘নারীবিরোধী’ হিসেবে দেখবেন নাকি প্রথমত ‘সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অধিকার’ হিসেবে দেখবেন, সেই অনুযায়ী কোন রাজনীতিতে অংশ নেবেন — এইসব নানা প্রশ্ন এখন আমাদের সামনে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. বাংলাদেশে এটি মূলত ‌’হিল্লা বিয়ে’ নামে পরিচিত। যদিও বাংলাদেশে মৌখিক তালাক আইনগতভাবে সিদ্ধ নয় তবু সমাজের রক্ষণশীল অংশটি – যাদের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে – মৌখিক তালাকের পর হিল্লা বিয়ে ছাড়া পুনরায় বিয়ে অনুমোদন করে না। এক্ষেত্রে রক্ষণশীল মুসলিম মেয়েরাও একমত বলে শুনেছি। লিখিত বা মৌখিক যাই হোক না কেন, তালাকের পর পুনরায় স্বামীর কাছে ফিরতে মুসলিম মেয়েদের আরেকটি সাময়িক বিয়ে করতে হবে – এই হচ্ছে হিল্লা বিয়ের মূল কথা। বাংলাদেশেও অনেক ইসলামবেত্তা বলে পরিচিত বলে থাকেন যে ইসলামে হিল্লা/হিলা বিয়ে বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো কোরান শরিফের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা।
    আমার এই মন্তব্যটি লেখার মূল কারণ এটি বলা যে, যাঁরা বলেন ইসলামে হিল্লা বিয়ের বিধান করা হয়েছিল মুসলমান পুরুষদের বিয়ে নিয়ে যথেচ্ছাচার করা ঠেকাতে, তাঁরা স্পষ্টত ভুল বলেন। কারণ, ভুল যে করবে দায় তাকেই নিতে হবে। তার দায় মেয়েটিকে নিতে হবে কেন? স্বামীর কেন শাস্তি বিধান করা হলো না ধর্মগ্রন্থে?
    তাছাড়া, ইসলামের ইতিহাসের মূলধারায় প্রাকইসলাম আরবকে যেভাবে আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থাৎ মাৎস্যন্যায়ের জগৎ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে ব্যাপারটা মোটেও সেরকম ছিল না। তখন মেয়েদের যদি অধিকারই না থাকবে তাহলে বিবি খাদিজা (রা:) এত বড় ব্যবসার মালিক হলেন কী করে? প্রাক-ইসলাম আরবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তখন নারীর ওপর নির্যাতন হতো তবে তাদের অধিকার ইসলাম-পরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেশি ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আরো শক্তিশালী ও পদ্ধতিগত হয়ে উঠেছিল।
    শরিয়তে থাক বা না থাক, ধর্মগ্রন্থে থাক বা না থাক, যে কোনো নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে সেই সমাজের মানুষের এক হয়ে দাঁড়ানোই তাদের মনুষ্যত্বকে প্রমাণ করে। বিধবা বিবাহ বা সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিরাই। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন তাঁরাই। মুসলমান বা অন্য কোনো ধর্মের মানুষ গিয়ে হিন্দু ধর্ম সংস্কার করেনি। সুতরাং নিজেদের ধর্মের নেতিবাচক দিকগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের উঠে দাঁড়ানোর হ্যাডম যদি মুসলমানদের না থাকে তবে আইসিস-এর ঝাড়ই জন্ম নেবে তাদের বীজ থেকে। অতীতে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম সমাজে বহু সংস্কার আমরা দেখেছি যা থেকে সমাজ উপকৃত হয়েছে, সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। উপকৃত হয়েছে বিশ্ব মানবতা। শুধু হিল্লা বিয়ে নয়, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বাঁটোয়ারা থেকে শুরু করে বাধ্যতামূলক পর্দার বিধানসহ আরো অনেক প্রথা ও বিধানের বিরুদ্ধে যৌক্তিক ভিত্তি সহকারে মুসলমানরাই উঠে দাঁড়াবেন এই আশা রাখি।

আপনার মতামত...