বিপুল দাস
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা ছোটগল্পের জগতে যে কজন গল্পকার শক্তিশালী কলম নিয়ে এসেছিলেন, রমাপদ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মতি নন্দী, অসীম রায়, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অবধারিতভাবেই রমাপদ চৌধুরী। সেই সময়ে বাংলা ছোটগল্পের ভুবন নক্ষত্রমণ্ডলীর আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রযুগের অবসানের পর বাংলাসাহিত্যের গদ্যে যে শূন্যতার আশঙ্কা অনেক সমালোচক করেছিলেন, দেখা গেল রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত একঝাঁক লেখক তাঁদের নতুন কথনভঙ্গি, বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে লিখতে এসেছেন। এমনকী, বিখ্যাত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখন-শৈলী থেকেও এরা আলাদা একটা নির্মাণের পথ খুঁজে নিচ্ছেন। শোষণ, ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র, দলিতের জেগে ওঠা, প্রেম, সামাজিক অবক্ষয় –এসব নয়, এর বাইরেও ব্যক্তিমানুষের সংশয় এবং সংকটের উপাখ্যান সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পথ ধরে লেখা হতে শুরু করল। তার অনেক আগে এই ধরণটি আমরা পেয়েছিলাম জগদীশ গুপ্তের লেখায়। তারপর দীর্ঘদিন বাংলা উপন্যাস এবং ছোটগল্প আচ্ছন্ন হয়ে ছিল রবীন্দ্র এবং তদনুসারী গদ্যে। রবীন্দ্র অবসানে বাঁক বদল ঘটতে শুরু করেছিল। বুদ্ধদেব বসুর গদ্যে তার ছায়া ম্লান হয়ে এলেও গ্রহণ পূর্ণ অতিক্রম করতে পারেনি। যাকে আমরা কল্লোল যুগ নামে অভিহিত করি, সেই আবর্তনে সাহসী হয়ে উঠেছিলেন কয়েকজন গল্পকার। এই গদ্য লিখিয়েরা মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা, দেশভাগ, মানুষের লোভ এবং হিংসার উন্মুক্ত চেহারা দেখেছেন, জারিত হয়েছেন সেই অভিজ্ঞতায়। স্বাভাবিকভাবেই তাদের লেখায় সেই সব বিষয় উঠে এ’ল। কিন্তু তার সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা মোটা দাগে শুধু আবেগপ্রবণ context নির্মাণ নয়, নির্মাণ কৌশলে নতুন শৈলী, ব্যক্তিমানুষের সংকটের কথা এ’ল সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা নিয়ে। লিখনের নতুন রীতি নিয়ে বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে এলেন শক্তিশালী কয়েকজন গদ্যকার। রমাপদ চৌধুরী সামান্য পরে এলেও তাঁর লেখায় মিতকথনের ভঙ্গি, সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাঠককে মুগ্ধ করল।
রমাপদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২২-এর ২৮শে ডিসেম্বর। চলে গেলেন ২০১৮-র ২৯শে জুলাই। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, আই আই পি এম পুরস্কারে সম্মানীত এই লেখক ঘোষণা করেই তার লেখক জীবনের ইতি টেনেছিলেন। তাঁর লেখায় যেমন ছিল নির্মোহ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও রেখে গেলেন সেই নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর সৃষ্টির জগত থেকে বিদায় নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে, সেটা আমরা হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু সেই বেদনার অংশভাক হতে পারি না। ঠিক সময়ে এ রকম দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেবার মানসিক দৃঢ়তা সবার থাকে না। সেদিক দিয়েও রমাপদ চৌধুরী যখন অনুভব করেছেন সময় হয়েছে বৃত্ত থেকে সরে দাঁড়াবার, বাংলা গদ্যকে ঋদ্ধ করার জন্য আরও কিছু কলম অপেক্ষা করে আছে, তখনই তাঁর কলমকে স্তব্ধ করে দেবার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। এও এক অনুকরণীয় মহৎ শিক্ষা আগামী লেখকদের কাছে। এক ব্যতিক্রমী লেখক রমাপদ চৌধুরী।
রমাপদ চৌধুরীর একটি বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ভারতবর্ষ’। গল্পটি বহুচর্চিত। আপাত একটি গল্পের আড়ালে যে বার্তা তিনি দিয়েছেন, সেটি চিরকালের সংকটের কথা। একটি সার্থক গল্পের ভেতরে তো সব সময় অন্য একটি গল্প লুকিয়ে থাকে। একটি অন্তর্লীন মেসেজ থাকে মননশীল পাঠকের জন্য। নইলে গল্প তো ঘটনার হুবহু বর্ণনায় খবরের কাগজের রিপোর্টিং হয়ে যেত। এই গল্পেও সেই বার্তাটুকু রয়েছে। একটি জনজাতি, এ গল্পে প্রোটাগনিস্ট তাকেই ‘ভারতবর্ষ’ বলেছেন, মাহাতোগাঁয়ের কালো কালো মানুষগুলো কেমন করে ভিখারি হয়ে গেল — খুব নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে সেই আখ্যান বর্ণিত হয় এই গল্পে।
একটি জনজাতি তাদের কৌমের পরম্পরাগত ঐতিহ্যের অহংকারটুকু, সহজ সারল্যের অভিমান হারিয়ে ফেলল। আপাতভাবে মনে হয় তারা হারিয়ে ফেলল, কিন্তু গল্পের দু’টি লাইনের মাঝে যে অদৃ্শ্য লাইন থাকে, তার পাঠোদ্ধার করলে দেখা যায় পৃথিবীজোড়া এক জালের কথা। লোভের জাল, প্রাচীন মানুষকে তার শিকড় থেকে উপড়ে তার শিরদাঁড়াকে দুমড়েমুচড়ে দেবার কথা, ভোগবাদের রঙিন ছবি লুঠ করে চিরকালের ঐতিহ্যকে, আত্মবিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙে দেবার জন্য তার সামনে তুলে ধরে ভোগের ছবি, লোভের জালে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধে ক্ষুধার্ত মানুষকে। এভাবেই ভিখারি হয়ে যায় মাহাতোগাঁয়ের সব মানুষ।
‘স্টেশন ছিল না, ট্রেন থামত না, তবু রেলের লোকদের মুখে মুখে একটা নতুন নাম চালু হয়ে গিয়েছিল। তা থেকে আমরাও বলতাম “আন্ডা হল্ট”।’ এই আন্ডা হল্ট নিয়ে রমাপদ চৌধুরীর গল্প ‘ভারতবর্ষ’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দিদের (POW) নিয়ে এবং কখনও শুধু আমেরিকান সৈনিকদের নিয়ে মাঝে মাঝে ট্রেন যেত মাহাতোদের গ্রামের পাশ দিয়ে। লাইনের দু’পাশে কাঁটাতারের বেড়া। ভোরবেলা সেই ট্রেন হল্টে থামলে ব্রেকফাস্ট হিসেবে সৈনিকদের দেওয়া হ’ত সেদ্ধ ডিম। রাশি রাশি ডিমের পরিত্যক্ত খোসা জমত লাইনের পাশে কাঁটাতারের ওপর। সেই থেকে নাম হ’ল আন্ডা হল্ট। ডিমের খোসা জমতে জমতে হিমালয়ের মত ডিমালয় হয়ে উঠেছিল আন্ডা হল্ট। মার্কিন সৈনিকদের দল খাদ্যের সারটুকু খেয়ে বর্জ্য অংশটুকু ফেলে যেত আন্ডা হল্টে। মাহাতোদের গ্রামের পাশে।
এ পর্যন্ত গল্প চলছিল স্বাভাবিক গতিতে। মসৃণভাবে। গল্পে বাঁক বদল ঘটল যেদিন দেখা গেল মাহাতো গ্রামের এক নেংটিপরা ছেলে কোন সাহসে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের ডিমরুটিকফি খাওয়া দেখছে। গল্পের কথকের বয়ানে “কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো-বাঁধা ছেলেটাকে একটা বাচ্চা মোষের পিঠে বসে যেতে দেখেছি একদিন।”
এখান থেকে শুরু হয় কৌশলী নির্মাণ। দু’টি ভিন্ন চরিত্রের তলের ঘর্ষণ শুরু হয়। একদিকে লেখক নির্জন এক হল্ট স্টেশনের আবহ নির্মাণ করেছেন। একদিকে রেললাইন, লালশালু উড়িয়ে ট্রলির চলে যাওয়া, ঠিকাদার, বেহারি কুক, সার্ভার কুলি, মার্কিন সৈনিকদের দল — এসবের প্রয়োগে নির্মিত হয় ধাতব, স্বাভাবিক মনুষ্যস্পর্শরহিত নির্জন যান্ত্রিক এক আবহ। তার বিপরীতে ক্রমে রেললাইনের পাশে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে জমা হতে থাকে মাহাতো গ্রামের মানুষজন। ওদের নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে দূর থেকে দেখা এই ট্রেনের আসাযাওয়া, মার্কিন সৈন্যদের ডিমরুটি খাওয়া — এসবই ছিল নতুন এক দৃশ্য। প্রথমে শুধু কৌতূহল ভরেই ওরা দেখত এই আশ্চর্য দৃশ্য। আর কিছু নয়, কোনও প্রত্যাশা নয়, কোনও লোভ ছিল না ওদের চোখে — এই আশ্চর্য চলমানতা দেখবে বলেই সহজ সরল মানুষগুলো এসে দাঁড়াত কাঁটাতারের বেড়ার পাশে।
একদিন এক সৈনিক তার হিপ পকেট থেকে চকচকে একটা আধুলি বার করে ছুঁড়ে দিয়েছিল কাঁটাতারের ওপারে। ‘ওরা অবাক হয়ে সৈনিকটার দিকে তাকাল, কাঁটাতারের ভিতরে মোরামের ওপর পড়ে থাকা চকচকে আধুলিটার দিকে তাকাল, নিজেরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল… আমি আধুলিটা তুলে মাহাতোবুড়োর হাতে দিলাম। সে বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর সবাই নিঃশব্দে চলে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই।’
কথকের এই বয়ানে আমরা বুঝতে পারি কত সংক্ষিপ্ত ইশারায় কত কথা বলা যায়। কাঙালের মত খাবার বা বকশিসের লোভে মাহাতোগাঁয়ের মানুষ এসে দাঁড়াত না। শুধু কৌতূহল ছিল ওদের চোখে। ট্রেন এলেই ছুটে দেখতে আসত। ওদের ছিল খেতির কাজ, পরিশ্রমের ফসল তুলত ওরা। ওদের ছিল মুরগির লড়াই, গলায় লালসুতোয় ঝোলানো দস্তার তাবিজ, পুতির মালা। ছিল ধামসা মাদল, মহুয়া বন, আদিম সঙ্গীত। সাহেব বকশিস দিয়েছে শুনে ওরা উল্লসিত হয়নি। নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল। আসলে লেখক বলতে চেয়েছিলেন এটা ছিল ওদের কাছে বিস্ময়, একটা ধাক্কা, হয়তো অপমানও। সহজ সরল যে বিশ্বাস নিয়ে ওদের জীবনযাপন, সেখানে এই লোভের হাতছানি, বকশিস বড় বেমানান। বিস্মিত হয়েছিল ওরা।
তারপর একদিন একমুঠো আনি, দোয়ানি ছুঁড়ে দিয়েছিল এক সৈনিক মাহাতোগ্রামের মানুষদের দিকে। দু’টো বাচ্চা ঝাঁপিয়ে পড়ল পয়সা কুড়োতে। খবর্দার — চিৎকার করে সাবধান করেছিল মাহাতোবুড়ো। বাচ্চাদু’টো শোনেনি, যতটা পেরেছে পয়সা কুড়িয়ে নিয়েছে। মাহাতোবুড়ো কী সব বলে যাচ্ছিল আর হাসছিল মাহাতোগ্রামের সবাই। পালটে যাচ্ছে ধরমকরম, বিশ্বাস, রীতরেওয়াজ। ভেঙে যাচ্ছে আমাদের ব্রতকথা, আমাদের মঙ্গলকাব্য, আমাদের লক্ষ্মীর আলপনা। আমাদের দিকে নেমে আসে রঙিন ছবি।
এই ভিড়ে মাহাতোবুড়ো আর আসত না। কথক বলছে তার একরকম গর্ব হ’ত। একজন অন্তত এই বেড়াজালে ধরা দেয়নি। এই ষড়যন্ত্র তাকে বাঁধতে পারেনি। দীনহীন হয়ে যাওয়ার লজ্জাকে ঢেকে দিয়েছে একা মাহাতোবুড়ো। লজ্জাকে এই অহংকারের ভেতরে লুকিয়ে রাখা যায়।
এভাবে কখনও আমেরিকান সৈন্য-বোঝাই ট্রেন, কখনও ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ট্রেন এসে দাঁড়াত। কাঁটাতারের ওপাশে মাহাতোগ্রামের সমস্ত লোক এসে দাঁড়াত হাত বাড়িয়ে। একদিন কথক দেখলেন ‘সমস্ত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাহাতোবুড়োও হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে — সাব বকশিস, সাব বকশিস।’ উন্মাদের মত, ভিক্ষুকের মত।
গল্পের শেষ মোচড়টা অসাধারণ। যেদিন মাহাতোবুড়োও ভিখারি হয়ে গেল, সেদিন আর ট্রেন থামল না। আর কোনও দিনই থামেনি। মাটি আর অরণ্যের সহজ মানুষগুলোকে ভিখারি বানিয়ে ট্রেন চলে গিয়েছিল।
এ গল্প স্থানিক একটি ঘটনাকে নিয়ে লেখা, অথচ আমরা জানি, স্থান-কাল-পাত্রের সীমায় এই কথন আবদ্ধ নয়। চিরকাল এই ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়। যারা বিক্রি হতে চায় না, যাদের শিরদাঁড়া শক্ত, যেভাবে হোক, তাদের ভিখারি বানিয়ে দাও। জগৎজুড়ে ভোগবাসনার রঙিন সুখের স্বপ্ন দেখাও। সব কেনা যায়। তারপর কেনা হয়ে গেলে আমরা আর ট্রেন চালাব না। সবাইকে ভিখারি না বানালে আমাদের রাজ্যপাট চলবে কেমন করে। পয়সা তোমাকে তুলতেই হবে।
মানুষকে ভিখারি বানানোর এ এক আশ্চর্য গল্প।