সোমনাথ চ্যাটার্জি — কিছু টুকরো কথা

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় | রাজনীতিবিদ

প্রদীপ ভট্টাচার্য

 

সবেমাত্র দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তাঁর আশি বছর বয়সের জন্মদিন পালন করতে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল লাইভ অনুষ্ঠান করছে। প্যানেলে শান্তিনিকেতনের বিশিষ্টজন সহ তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার বিরোধীরা — সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদক। সেদিন ওনার প্রশংসায় অভিধানের সব শব্দ অকৃপণভাবে ব্যবহৃত তাঁদের চলনেবলনে, অপসারণের কয়েকদিন আগেও যাঁরা অভিধানের বাইরে থেকে তুলে আনা শব্দের বিষ শরে বিদ্ধ করে গেছেন বছরের পর বছর, হ্যাঁ সোমনাথবাবুকে। সেদিন বলেছিলাম, “যে দল থেকে উনি অপসারিত হলেন দলীয় অনুশাসন না মানার কারণে সেই দল বা তাঁদের নেতৃত্ব একটি কুকথাও উচ্চারণ করেননি। পাশাপাশি যাঁরা কুৎসিত গালিগালাজ করে গেছিলেন অবিরাম ধারায়, তাঁরা আজ ভরিয়ে দিচ্ছেন প্রশংসায়। তবে কি দল থেকে অপসারণ তাঁকে অজাতশত্রু করেছে?”

এর বেশ কিছুদিন পর সোমনাথবাবুর গোয়ালপাড়ার ‘খেয়া’ বাড়িতে একটি বিশেষ কাজে যেতে হয়। সেই লাইভ অনুষ্ঠানের সব খবর তিনি পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যেই। সামনে সযত্নে লালিত ফুলের বাগান। উনি একা। “আপনি কি আমার অপসারণে খুশি?” না, কোনও প্রশ্নবোধক উচ্চারণ ছিল না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কিছু সাংবাদিক স্তাবকতার আড়ালে তাঁর কান ভারী করত। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ওনার সখ্যতা সবার জানা। উত্তরে বলেছিলাম, “আমি কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে ওখানে যাইনি। তাই অপসারণের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি।” বাকি সব কথা, যা সেদিন বলেছিলাম হুবহু জানাই। শেষে বলেছিলাম, সব তিরস্কার, বহিষ্কার ভেসে গেছে প্রশংসার বানে। এক চিলতে হেসেছিলেন। তারপর সখেদে বলেছিলেন, “ওরা আমাকে অনেক কিছুই করতে দিল না। চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থা করারও বিরোধিতা করল! আমার মোহভঙ্গ হয়েছে। আর ক্ষমতাও নেই…”

মোহভঙ্গ বললেন, তবে আমরা জানতাম ওটা কথার কথা। বোলপুর-শান্তিনিকেতন সহ বেশ কিছু এলাকার উন্নয়নের ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন — পদে থাকুন আর নাই থাকুন। তাঁর ঐকান্তিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মহিলা কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণে সিপিআই(এম) সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি, রামচন্দ্র ডোম থেকে মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সাংসদ অর্জুন সেনগুপ্তকে সামিল করেছিলেন এই মহতী প্রয়াসে। অর্থ কোনও বাধা হয়নি, বলা ভালো হতে দেননি।

বোলপুর-শান্তিনিকেতন তাঁর জন্মভূমি নয়, কর্মভূমি হয়েছে সাংসদ হবার পর। অথচ তিনি এই এলাকার সার্বিক উন্নয়নে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। প্রত্যন্ত গ্রামের খোঁজখবর রাখতেন নিয়মিত। পাশাপাশি আশ্রমকন্যা অমিতা সেন যখন আবদার করে বললেন, “সোমনাথ, আমার আদিবাসী মেয়েদের বড় জলকষ্ট…” বাকিটা বলতে হয়নি। যদিও সে কাজেও বাধা পেয়েছেন পরিবেশরক্ষার ঠিকাদারদের কাছে। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরাগী সোমনাথ চ্যাটার্জির বিনম্র শ্রদ্ধা দেখেছি অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের প্রতিও।

আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে ছিল সূক্ষ্ম রসবোধ। তার সাক্ষী থেকেছি কয়েকবার — অনুষ্ঠান সংগঠন ও সঞ্চালনার সুবাদে এই সুযোগ পেয়েছি। বিশাল মঞ্চ, তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। পর্দার পিছনে এক যুবক স্বেচ্ছাসেবক ওনাকে মিমিক্রি করছে। ওনার কানে পৌঁছেছে। গম্ভীর গলায় বললেন ছেলেটিকে ডেকে আনতে। সে তখন ভয়ে ত্রিসীমানার বাইরে। “ভারী সুন্দর নকল করেছে। ওকে আমার কাজে লাগবে। শরীর আর ব্যস্ততার কারণে অনেক জায়গায় যেতে পারি না, ওকে পাঠাব। প্রক্সি দেবে।”…

যাঁরা তাঁর গোয়ালপাড়ার বাড়িতে একবার গেছেন তাঁরাই জানেন সোমনাথবাবুর আতিথেয়তা। একদিন ওনার কাছে গিয়েছি একটি জরুরি চিঠি নিয়ে। “আসছি…” বলতেই সেই বজ্রকণ্ঠ, “সহবতগুলো ভুলেই গেছেন। কারও বাড়ি এলে একটু জল অন্তত না খেয়ে যাওয়া যায় না, জানেনই না।” ততক্ষণে ডিশে মিষ্টি আর গ্লাসে সরবত চলে এসেছে। নিজেও খাদ্যরসিক ছিলেন। চিকিৎসকের নিষেধ সবসময় মানতেন না। একটি গ্রাম এলাকায় অনুষ্ঠান শেষে এলাহি আপ্যায়নের পরে ডেকে বললেন, “এখানে ভোটের প্রচারে এসে এক হাত লম্বা মচমচে বেগুনি খেয়েছিলাম। ওসব বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?” সেই বেগুনি আনানো হল। এবং যথাযথ সদ্‌ব্যবহার।

সোমনাথ চ্যাটার্জি দশবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, সাধারণ সদস্য থেকে দলনেতা, স্পিকার সবরকমভাবেই সংসদ তাঁর নখদর্পণে বলা যায়। সংসদীয় আপস কাকে বলে তিনি জানেন। কিন্তু সময় মেনে চলার বিষয়ে আপস করতে দেখিনি — মাঝেমাঝে তথাকথিত ভদ্রতার সীমা ছাড়াতেও তোয়াক্কা করতেন না। তখন তিনি কোনও পদে নেই। কিন্তু উন্নয়ন পর্ষদ নাট্য উৎসবে উদ্বোধক হিসাবে সোমনাথবাবুকেই বেছে নিয়েছেন। বেলা ৩টেয় শুভারম্ভ। উনি হাজির হলেন দশ মিনিট আগে। মঞ্চে তখন বিশ্বখ্যাত বহুরূপী সুবল দাসবৈরাগ্য আর সঞ্চালক আমি, গুটিকয়েক নাট্যকর্মী — আয়োজক সংস্থার কেউ নেই। ঘড়িতে তিনটে বাজতেই উনি ডেকে জানতে চাইলেন, সেই মহাপুরুষরা কোথায়। আমতা আমতা করছি, উনি উঠে পড়লেন। “আপনি আমি না হয় ভ্যাগাবন্ড, কিন্তু সুবলবাবু কে ওরা জানে?” দূর থেকে দেখি কার্যনির্বাহী আধিকারিক আসছেন। একটাই বজ্রনিনাদ “আমি যদি আজ চেয়ারম্যান থাকতাম, আপনাকে স্যাক করতাম…।” মহকুমাশাসক এসে শান্ত করতে যেতেই ধমক, “আপনি কটায় এলেন?” বিকল্প উদ্বোধক দিয়ে শুরু হল নামকাওয়াস্তে নাট্য উৎসব। পাশাপাশি অন্য ঘটনায় নিজে দেরি করার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন প্রকাশ্যে। স্কুলের নবনির্মিত ভবনের দ্বার উদ্‌ঘাটন। অনুষ্ঠান শুরুর দশ মিনিট আগে প্রধান শিক্ষকের ফোনে জানালেন “আমার যেতে দেরি হবে। বাচ্চাবাচ্চা মেয়েদের নাচগানের আসর থেকে ছাড়ছে না। আপনারা ঠিক সময়েই কিন্তু শুরু করবেন।” নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পরে উনি এসে পৌঁছলেন। একটি গান চলছিল। শেষ হবার পর মঞ্চে উঠে সকলের কাছে ক্ষমা চাইলেন দেরি হবার জন্য। তখন উনি লোকসভার অধ্যক্ষ। ব্যস্ততা আছে কিনা জানতে চাইতেই বলে উঠলেন, “সকলের শেষে এসেছি, সকলের শেষেই বলতে ডাকবেন।”

সংবাদ শিরোনামে থাকা সন্ত্রাসকবলিত একটি গ্রামে যুব ফেডারেশন আয়োজন করেছে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা। সোমনাথবাবু প্রধান অতিথি। শরীর খুব ভালো নয়। তখন কোনও পদেও নেই। তবু রাজি হয়েছিলেন ওই এলাকায় ওনার উপস্থিতি যদি কাজে লাগে। দেরি হয়েছিল। সেই ছাত্র-অভিভাবক জমায়েতে উনি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

হস্তশিল্পীকে নিয়ে গেছি তাঁর বাড়িতে। শিল্পসৃষ্টি দেখে বিশদে জানতে চাইলেন — তাঁর উৎসাহ আর সহযোগিতা চাইতেই বললেন, “কী করতে হবে, পদ্মশ্রী পাইয়ে দিতে হবে?” কুণ্ঠিত শিল্পীকে আশ্বাস দিলাম ওনার ভিতর আর বাইরে এক নয়। বললাম, “না দাদা, ও নামের আগে শ্রী-ই লেখে না, পদ্মশ্রী তো দূর অস্ত্‌।” তারপর আর্জি শুনলেন। সমস্ত কাজগুলো রেখে দিলেন, বিনিময় মূল্য নিতে বাধ্য করলেন। একটা দরখাস্ত লিখতে বললেন, প্রাপকের নাম ফাঁকা রাখার নির্দেশ দিয়ে। শিল্পীর ইমেল ঠিকানা নেই শুনে রেগে গেলেন। আমার ইমেল নিচে লেখা হবার পর রেখে দিলেন। দিন দশেক পর রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে জানানো হল কিছু তথ্য, কাগজপত্র জমা দিতে হবে। সরকারি দক্ষতায় নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পরও কোনও নথিই জোগাড় করা গেল না। সব জানাতে ওনার কাছে গেলাম। “দেখছেন তো কী হাল দেশটার। এসব ভালো লাগে না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন।”

শান্তিতে তাঁকে থাকতে দেওয়া হল না। না পরিবারেও না। যে সহবতের শিক্ষা সবাইকে দিতে চেয়েছেন, সে সহবত মৃত্যুর পরেও পরিবার শিখল না। স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার সোমনাথ চ্যাটার্জিকে গান স্যালুট জানায় স্বেচ্ছাচারী সরকারের পুলিশ। আপনি কি খুব ক্লান্ত সোমনাথদা….?

লাশ কাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই
লাশকাটা ঘরে শুয়ে থাকুন টেবিলের পরে… আরও কিছুকাল

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...