পার্থসারথি চৌধুরী
শতাব্দীর যশস্বী মার্কসবাদী চিন্তক, অর্থনীতিবিদ সামীর আমিন গত ১২ই আগস্ট এই পৃথিবী ছেড়ে প্রায় নিঃশব্দেই চলে গেলেন। শুধু মার্কসবাদী চিন্তকই বা বলি কেন, ক্ষুরধার বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, তৃতীয় বিশ্বের অস্তিত্বের গুরুত্ব অনুধাবন ও তাদের সংহতির পক্ষে জোরালো সওয়াল, একই সঙ্গে একজন দায়বদ্ধ কর্মী ও মার্কসবাদের বর্তমান সংকটকালে যুগযন্ত্রণায় কাতর একজন সাধারণ হয়েও অসাধারণ মানুষ। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক চেতনায় মগ্ন মানুষ আজ শোকসন্তপ্ত, তার সঙ্গে আমরাও। কীভাবে এই মানুষটিকে ব্যাখ্যা করব জানি না। এরিক হবসবমের পর, হ্যারি ম্যাগডফ এবং তারপর সামীর আমিন। প্রভাত পট্টনায়ক আমিন সম্পর্কিত তাঁর লেখায় বলেছেন, আমিন সমসাময়িক মার্কসবাদী চিন্তকদের থেকে দুটি কারণে আলাদা, প্রথমত, তিনি একজন বাস্তববাদী চিন্তক এবং দ্বিতীয়ত, কখনওই তিনি স্বপ্নবিলাসী নন। বাস্তবের নিরিখেই তিনি মার্কসবাদকে আলোচনা ও তার প্রয়োগের কথা ভেবেছেন। বহুদিন থেকেই ‘মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকায় মানুষটির লেখা পড়ে আসছি। আশির দশকের শেষ দিকে রুশ সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, কেন, তার ব্যাখ্যার জায়গা এটি নয়, অনেকেই ব্যথিত হলেন, পৃথিবী জুড়ে আস্ফালন শুরু হল পুঁজিবাদের। সংকটের মধ্যে থেকেও পুঁজিবাদের এই উল্লাস দেখে আমিন একদিকে যেমন ব্যথিত আবার সোচ্চারও হলেন।
মিশরীয় পিতা ও ফরাসি মাতার পুত্র সামীর আমিন। প্রাথমিক পর্বের লেখাপড়া শেষ করে তিনি ফরাসি দেশে চলে যান। সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাশিবিজ্ঞানে শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিপত্র পান। পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর বেশ কিছুদিন পরে তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আমিন বোধহয় এক্ষেত্রে হবসবমের পদাঙ্কই অনুসরন করলেন। হবসবম তাঁর ‘অন হিস্ট্রি’ গ্রন্থে সখেদেই বলেছেন যে, মার্কসবাদ নিয়ে আমার ভাবনা পৃথিবীতে সমাদৃত হলেও সোভিয়েত কোনওদিন আমার লেখাকে সমাদর করেনি, এমনকি আমার লেখা দেশের মানুষকে জানতেও দেয়নি। আমিন অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু জানাননি। তবে একটা সময়ের পর সোভিয়েতের সামাজিক সম্রাজ্যবাদের চেহারা আমিন মেনে নিতে পারেননি।
আমিন কখনওই একমেরু বিশ্বের অস্তিত্ব দেখতে চাননি, তিনি সবসময় চেয়েছেন বহুমাত্রিক পৃথিবীর অস্তিত্ব। এই বহুমাত্রিক বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্বকে বিনাশ করবে, প্যারিস, বার্লিন ও সোভিয়েতের জোট প্রয়োজনে বেজিংকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহাসিক মহাজোট তৈরি করে এই প্রভুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই তিনি আজীবন চেয়েছেন। তবে তার এই চাওয়া সবটাই মার্কসীয় আঙ্গিকে।
তবে ইসলামি সংস্কৃতির আবহমিশ্রিত যে পাঠ আমিন দিয়েছেন তা আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু সংস্কৃতির শিকড় নির্ভর ইতিহাস পাঠ এবং সামাজিক চলশক্তির ব্যাখ্যা বিন্যাসে সংস্কৃতি, আচার আচরণ, এমন কি খ্যাদ্যাভ্যাসকেও যে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয় তা তিনিই আমাদের শেখালেন। আমরা ভারতীয় মার্কসবাদীরা স্বভূমিকে গুরুত্ব দিয়ে কোনওদিন ভাবতে শিখিনি। আমিনের এই অন্বেষক ভূমিকা আমাদের শিক্ষণীয়। আরও শিক্ষণীয় যে, তিনি অর্থনীতিকেই মার্কসবাদের একমাত্র চালিকাশক্তি বা সমাজ ও রাজনৈতিক ভাবনার একমাত্র চালিকাশক্তি তা ভাবেননি। এখানেই স্বতন্ত্র চিন্তক। অর্থনীতির বিশ্বায়নের ক্ষেত্রেও আমিন রক্ষণশীল। ঐতিহ্যবাহী মার্কসবাদী ভাবনার অনুসারী হয়ে তিনি বলেন যে, উৎপাদন ও মালিকানায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বর্তমান বিশ্বের অনেক উন্নতিশীল দেশ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের বিরোধিতায় ও উৎপাদনে ও সম্পদে রাষ্ট্রীয় অনুপ্রবেশে অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে।
তবে আমিনের এই তত্ত্ব আমাদের কাছে ঐতিহ্যবাহী মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ঘরানা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলে দেয়। আমিন পরবর্তীকালে মার্কসীয় তত্ত্বকে যারা বিকশিত করেছেন যেমন গ্রামশি তাদের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। জনগণের চৈতন্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তার ভাবনায় বা আলোচনায় কোনও প্রতিফলন পড়েনি। এদিক থেকে বিচার করলে সময়ের নিরিখে মার্কসবাদের বিকাশ কোন পথে ঘটবে তা নিয়ে আমাদের কাছে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েই গেল।