উদ্বাস্তু সমস্যার মূলে কী?

মোহাম্মদ ইরফান

 

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনের হিসেব অনুযায়ী এই আগস্ট মাসে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক নূতন উদ্বাস্তুর আগমন ঘটেছে গ্রিক দ্বীপের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। আর এঁদের শতকরা সত্তর ভাগ এসেছে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান থেকে। অর্থাৎ এমন তিনটি দেশ থেকে যেখানে গণতন্ত্র প্রবর্তনের সশস্ত্র প্রচেষ্টায় লিপ্ত মার্কিন সহ অন্যান্য পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রায় দুদশক যাবৎ। জনবিতাড়নের এই সাম্প্রতিক ব্যাপকতা নব্বই দশকের শুরুর উদ্বাস্তু স্ফীতির সাথে তুলনীয়। নব্বইয়ে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বলকানের লোকজন, আর এবারের উদ্বাস্তুদের প্রচুর পরিমাণ আসছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে। ইয়েমেন কিংবা মায়ানমার, সিংহল কিংবা সোমালিয়া, কঙ্গো কিংবা কম্বোডিয়া, ব্যাপকবিস্তৃত এই মহামারী নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চল বা কোনও একটি বিশেষ ধর্মের লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এমনটি বোধহয় বলা যাবে না।

আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহ, জাতিগত হানাহানি কিংবা পরিবেশগত বিপর্যয়, আর বিপর্যয়রোধের জন্য পর্যাপ্ত সামর্থ্যের অভাবই এসব সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতির পেছনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে জাতিসংঘ ও প্রচলিত ধারার উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সতর্ক এবং সজাগ শব্দচয়নে। তবে এইসব আপাতদৃষ্ট কারণের পেছনে যদি আরও গভীর কোনও কারণ থেকে থাকে সেইসব গভীর কারণগুলো খুঁজে বের করে তার সমাধানের উদ্যোগ না নিলে উদ্বাস্তু সমস্যা থেকেই যাবে বিশ্বের ধনসম্পদ আরও দশগুণ বাড়লেও।

উনিশশো নব্বই থেকে দুহাজার পনেরো এই সময়ে বিশ্ববাসী তাদের মাথাপিছু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে তিনগুণ। হাতের মুঠোয় উইকিপিডিয়ার জ্ঞানভাণ্ডার, গুগলের গবেষক, ফেসবুকের যোগাযোগ, যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা, আর যানবাহনের স্বয়ংচালনা পার্থিব মানুষকে জ্ঞানে ক্ষমতায় পুরাণোক্ত দেবতার মতো শক্তিশালী করে তোলার শুভারম্ভ ঘটেছে এই সময়টুকুতেই। উন্নত প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আর উন্নত জীবনযাপনের হাতছানি বিশ্বে ক্ষুধা, দারিদ্র, যুদ্ধ, হানাহানি, উচ্ছেদ, উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ঘটাবে এই আশার সঞ্চার ঘটেছিল একালে। দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতনের মাধ্যমে পশ্চিমা উদারনৈতিক বুর্জোয়াব্যবস্থা মানবজাতির সামাজিক ঐতিহাসিক বিবর্তনের চূড়ান্ত অধ্যায়ের সূচনা করেছে এমন সমাপ্তিতে উপনীত হয়েছিলেন ফুকুয়ামার মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা। নব্বই দশকের শেষ থেকে শুরু করে শূন্য দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্য অনেক ভালো প্রবণতার মতো উদ্বাস্তুর সংখ্যাও কমতে থাকে। এই নিম্নমুখীনতা বদলে যায় ২০০৬ থেকে (https://data.worldbank.org/indicator/SM.POP.REFG?view=chart)। ২০০৭/০৮-এর মন্দাবস্থা অধিকাংশ দেশ সামলে উঠলেও উদ্বাস্তু সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থেকেছে অদ্যাবধি। বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তুর সংখ্যা, যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল দু হাহাজার পাঁচ নাগাদ, দুহাজার পনেরোতে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে ঊনিশশো নব্বইয়ের সংখ্যাকে। ইউ,এন,এইচ,সি,আরের হিসেব অনুযায়ী নিজদেশে বাস্তুচ্যুত এবং ভিনদেশে আশ্রয়শিবিরবাসী কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী লোকেদের সংখ্যা এই মুহূর্তে সাত কোটির কাছাকাছি (ঊনসত্তর মিলিয়ন)। সাতশো কোটি (সাত বিলিয়ন) মানবসন্তানের প্রতি একশোজনে একজন আজ উদ্বাস্তু। কোনও এক আশ্চর্য অলীক প্রভাবে যদিওবা বিশ্বজোড়া হানাহানি কাটাকাটির চূড়ান্ত অবসান ঘটে, তারপরও কেবল উপকূলীয় প্লাবন আর খরা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পনেরো থেকে বিশ কোটি বিশ্ববাসী মধ্যশতক নাগাদ বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকেরা।

সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু ঢলের অধিকাংশ স্বল্প আয় কিংবা নিম্ন মানব উন্নয়নের মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান দেশগুলো থেকে আসা। এদের আশ্রয় দেয়ার কারণে ইউরোপীয় সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস আসন্ন, ইউরোপের সমাজ সংস্কৃতি মূল্যবোধের দূষণ অপ্রতিরোধ্য, ইউরোপীয় জনপদে সন্ত্রাসের কালো থাবা, এ ধরনের নানান বাতচিতে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তবে মজার ব্যাপার হল উদ্বাস্তু আশ্রয়দাতা দেশগুলোর বেশিরভাগ কিন্তু এখনও গরীব প্রতিবেশী দেশগুলোই। উদ্বাস্তু কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, মেহমানদারিতে এগিয়ে থাকা দশটি দেশের — তুরস্ক, পাকিস্তান, লেবানন, ইরান, ইথিওপিয়া, জর্ডান, কেনিয়া, উগান্ডা, জার্মানি, চাদ — নটিই উন্নয়নশীল। এদের কোনও কোনওটি আবার চূড়ান্ত দরিদ্র। সাম্প্রতিককালে মায়ানমারের বৌদ্ধবান্ধব জান্তা-গণতান্ত্রিক শংকর সরকারের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমর্থনে এগিয়ে আসতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যখন নির্বিকার, বিশ্ব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় দ্বিধান্বিত সেই মুহূর্তে নিম্নমধ্যম আয়ের জনবহুল বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যে মানবতার পরিচয় দিয়েছে সেটি অনুকরণীয়। ঊনিশশো একাত্তরে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা থেকে পালিয়ে বেড়ানো বাঙালিদের একইভাবে আশ্রয় দিয়েছিল সে সময়কার দরিদ্র, পশ্চাৎ নানান সমস্যায় ভারাক্রান্ত ভারত, পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে।

সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু সমস্যার জরুরি সমাধান দরকার অবশ্যই। পুনর্বাসন, প্রত্যাবাসন শুধু মানাধিকারের ব্যাপার নয় আশ্রয়দাতা, আশ্রয়প্রার্থী উভয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়ও জরুরি। ধনী দেশ কিংবা সেসব দেশের ধনিক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন ইংরেজি গণমাধ্যমগুলো আশ্রয়প্রার্থীদের দুর্দশা প্রচারে যতটা উৎসাহী, আশ্রয়দাতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মহানুভবতা তুলে ধরতে উৎসাহী নন ততটা। যেমন, কানাডার ছোট ট্রুডো কিংবা জার্মান চ্যান্সেলরের বিভিন্ন উদ্বাস্তুবান্ধব পদক্ষেপের পাশাপাশি এমনকি মার্কেলের নামে উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের নামকরণ হচ্ছে এসব খবরও পৌঁছে যায় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। অথচ, আমরা অনেকেই জানি না অর্থনৈতিক সামর্থের বিচারে (মাথাপিছু তুল্য ডলার উৎপাদনের নিরিখে) উদ্বাস্তু আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে যে পঁচিশটি দেশ এগিয়ে আছে তাদের সবকটিই উন্নয়নশীল, এদের পনেরোটিতেই আবার উন্নতির পরিমাণ ন্যূনতম। উদ্বাস্তু কমিশনের ২০০৯-এর প্রবণতা প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তান, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, তানজানিয়া, সিরিয়া, চাদ এসব দেশ তাদের প্রতি মাথাপিছু পিপিপি ডলার আয়ের বিপরীতে উদ্বাস্তু ধারণ করছে সাতশো তেত্রিশ থেকে দুশো ত্রিশ জন, আর জার্মানি ধারণ করছে কেবল ষোলো জন। উন্নত দেশের রক্ষণশীল সরকার কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে কী মনোভাব পোষণ করে সেটি প্রচার না করে অবশ্য উপায় থাকে না এসব দেশের লিবারেল মিডিয়ার। বাস্তুহারা সিরিয়ানদের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব, কিংবা ইউরোপ জুড়ে উদ্বাস্তুবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারণা আমরা অহরহই খুঁজে পাই নিউইয়র্ক টাইমসের মতো উদারপন্থী কিংবা গার্ডিয়ানের মতো প্রগতিশীল পত্রিকায়। এতে বিশ্বজুড়ে সহানুভূতিও তৈরি হয় এসব পত্রিকা কিংবা পশ্চিমা উদারদের ভূমিকার ব্যাপারে। তবে টাইমস কিংবা গার্ডিয়ান সুচতুরভাবে, যতদিন সম্ভব উপেক্ষা করতে থাকে রোহিঙ্গা নির্যাতক বর্মী জান্তার পক্ষে পশ্চিমাদের হাতে মানবাধিকারের সনদ পাওয়া সু-কি-র সাফাই। শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য ইউরোপীয়দের কাছে তুরস্কের মোটা অংকের সাহায্য পাওয়ার কথাকে চাঁদাবাজি বলে পুনঃ পুনঃ প্রচার করলেও রোহিঙ্গাদের জন্য তুরস্ক সরকারের দিনের পর দিন দূর বাংলাদেশে লঙ্গরখানা চালানোর কথা তুলে ধরে বিশাল প্রতিবেদনের ভেতরের ছোট দু-চারটি বাক্যে।

যে ব্যাপারে পশ্চিমা গণমাধ্যম, গণপ্রতিনিধি এবং গবেষকদের বিশাল অংশ, তথাকথিত মূলধারা একেবারেই নীরব সেটি হচ্ছে এই উদ্বাস্তু সমস্যার মূল কারণ কী? কোন সব ঘটনাবলী উদ্বাস্তু তৈরি করে গণহারে? সেসব ঘটনার সূত্রপাত কী করে হয়? কী কী পদক্ষেপ নিলে এই ধরনের ঘটনা ঘটা বন্ধ হবে? উদ্বাস্তু সমস্যার আশু পরিচর্যা তথা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করার জন্য সামাজিক সম্পর্ক, উৎপাদন ব্যবস্থা, বণ্টন, বাজার, রাষ্ট্রীয় সীমানা এসব প্রচলিত প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার। এসব প্রশ্নের আন্তরিক এবং পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ ছাড়া এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান অধরাই থেকে যাবে।

সমস্যাটির তাৎক্ষণিক সমাধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতিসংঘ উদ্বাস্তু দপ্তর কিংবা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তাদের কাজটি মূলত আমলাতান্ত্রিক, গভীর বিশ্লেষণে না গেলেও চলে ওনাদের। বড় জোর ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণই কৌশল প্রণয়নে যথেষ্ট। ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আনান-ওগাতার মতো জাতিসংঘ নেতৃত্ব শান্তিরক্ষী বাহিনীকে মোটামুটি সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন শরণার্থী পুনর্বাসনে। রোয়ান্ডার মতো দু-একটি চূড়ান্ত ব্যর্থতা অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য, তবে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাফল্যও কম নয়।

উদ্বাস্তু সমস্যার রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করার, বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব কিন্তু জাতিসংঘের নয়, কিংবা কেবল জাতিসংঘের নয়। সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক গবেষণা চোখে পড়ে না বললেই চলে। অক্সফোর্ডের মতো নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিফিউজি স্টাডিজ সেন্টার’, এমনকি রিফিউজি শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে কারিকুলাম-এর একটি বড় অংশ রিফিউজিদের কী করে আত্ম-নির্ভরশীলতা শেখানো যায়, রিফিউজিরা কী করে আশ্রয়দাতা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এসব বিষয়বস্তু ঘিরেই আবর্তিত। অনাচার, অন্যায়, স্বৈরাচারের হাত থেকে বাঁচতে ভিটে-মাটি ছেড়ে সম্পূর্ণ নিজ অর্থে চূড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে যারা অন্য দেশে আশ্রয় নিতে এসেছে তাদের নূতন করে সেলফ-রিলায়েন্স শেখানোর জন্য অর্থায়নে এসব স্টাডি সেন্টারের পৃষ্ঠপোষকেরা যতটা আগ্রহী উদ্বাস্তু সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান খুঁজতে এরা ঠিক ততটা আগ্রহী নন নিশ্চয়ই।

উদ্বাস্তু সমস্যার পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিদ-গবেষকদের বাইরে অনেক চিন্তাবিদই কথা বলেছেন। স্লাভোজ জিজেক তার ‘রিফুজিস, টেরর এন্ড আদার ট্রাবলস’ বইতে (২০১৬) এ বিষয়ে একটি অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন। তিনি এবং সমাজ প্রগতি নিয়ে গবেষণা করেন তাদের অনেকেই প্রথমেই যে প্রশ্নটি করেন, এই যে ধর্ম-পুরাণে বর্ণিত মাত্রার মতোই ব্যাপক অনির্দিষ্ট যাত্রা, আদিম শিকারী-মাধুকরী জীবনযাপনেই কেবল যার উপযোগিতা ছিল, আজও তা কেন ঘটছে। জিজেক বেশ কিছু ঘটনার উদাহরণ হাজির করেছেন, সুনির্দিষ্ট কোনও উদ্বাস্তু ঢলের পেছনের গূঢ় কারণ খোলসা করার চেষ্টা করেছেন। এর কোনও কোনওটি সাদা চোখেই বোঝা যায়, পত্র পত্রিকা পড়লে, যেমন — লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রিস-ইটালি যাত্রা শুরু হওয়ার আগে লিবিয়াতে ইউরোপীয় সামরিক হস্তক্ষেপ, সিরিয়ায় আসাদকে সরিয়ে গণতন্ত্র তামিল করার পশ্চিমা প্রয়াস; কোনও কোনওটি আবার মূলধারার গণমাধ্যমে কেবলই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের মাধ্যমে বলা — যেমন, মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিকে নূতন পাওয়া তেলের মালিকানা নিয়ে ফ্রান্স ও চিনের রেষারেষিই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় মুসলমান বনাম খ্রিস্টানদের গৃহযুদ্ধে (মুসলমানদের মদতদাতা ফ্রান্স এবং খ্রিস্টানদের মদতদাতা চিনাদের মাধ্যমে) ফলশ্রতিতে অগুনতি মানুষের গৃহত্যাগ।

পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যার পেছনে “মূলধারা”র পশ্চিমা গবেষকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশের কৃষকদের নিম্ন উৎপাদন ক্ষমতা, এসব সমাজের দুর্নীতি, অব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব এসবকে দায়ী করে। আসলেই কি তাই? আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের খাদ্য সংকট কি কেবলই প্রাকৃতিক বা আভ্যন্তরীণ সংকট? এই সংকটের অধিকাংশই কি কৃষির বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমা ধনবাদী দেশের চাপিয়ে দেয়া সমস্যা নয়? পশ্চিমা দেশ এবং তাদের আর্থিক প্রাধান্যে পরিচালিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আর বিশ্ব ব্যাংকের ভ্রান্ত নীতিতে আবশ্যক খাদ্যশস্যকে অর্থকরী ফসলের মতো একই কাতারে ফেলে তথাকথিত ‘কাঠামোগত সংস্কারের’ নামে সার, বীজ, জ্বালানী সরবরাহ বাজার ব্যবস্থার হাতে তুলে দেয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক উৎপাদন খরচ জোগাতে হিমশিম খায়। নরমান বোরলগের জেনেটিক গবেষণার ফলশ্রুতিতে পাওয়া সবুজ বিপ্লব আপাতদৃষ্টিতে অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য সংকট দূর করার প্রতিশ্রুতি তৈরি করে একদিকে। অপরদিকে উচ্চ উৎপাদনে উচ্চ মুনাফালাভের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ছুটে আসা বিদেশি কোম্পানির সাথে টিকতে না পেরে একমাত্র উপার্জন-মাধ্যম জমি থেকে ছিটকে পড়ে হাজার হাজার কৃষক পরিবার। অন্য কোনও দক্ষতা না থাকায় শহর কিংবা শহরপ্রান্তে স্বল্প দক্ষতার নিম্ন আয়ের কাজে নিয়োজিত হয় এদের কেউ কেউ। স্বল্পোন্নত অর্থনীতিতে অধিকাংশ উচ্ছিন্ন কৃষকের ভাগ্যে কোনও কাজই জোটেনি আর। অপরদিকে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কৃষি উৎপাদন-বণ্টনের একচেটিয়া অধিকার পায়। আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর নির্ভর করতে হয় অনেক আফ্রিকান দেশকে। এসব পুঁজিবান্ধব নীতি পরিহার করে প্রান্তিক চাষী, তথা কৃষি-আয়ের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করলে দুর্যোগ পরবর্তী মানব ঢল রোধ করা সম্ভব।

পশ্চিমা পুঁজিবাদ যদি শরণার্থী সমস্যাকে তাদের সংস্কৃতি, জীবনধারার জন্য হুমকি স্বরূপই মনে করে থাকে তবে তাদের নিজেদের স্বার্থেই এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি, চূড়ান্ত সমাধান খোঁজা দরকার। প্রাচীর তুলে নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচানোর চেষ্টার মূল্য অনেক চড়া, পশ্চিমা উদারনৈতিক বুর্জোয়া মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিকও। প্রশ্ন হচ্ছে, পুঁজিবাদ নিজস্ব কাঠামো বজায় রেখে উদ্বাস্তু সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে সক্ষম হবে কিনা?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...