সূর্য শেখর দাস
প্রিয় স্বপ্না বর্মণ,
এই চিঠি যখন আপনাকে লিখছি তখন আরও একটা দিন বাসি হয়ে আসা পেঁয়াজের মতো নেতিয়ে পড়েছে। চারিদিকে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। এবং লোডশেডিং। এবং মশার কামড়। তবু না লিখে পারছি না আপনাকে।
আমি কলকাতার একটা কলেজে পড়াই। বুঝলেন স্বপ্না, আমার পোস্টটার একটা গালভরা নাম আছে, college-appointed contractual whole time teacher। আমার সাবজেক্ট ইংলিশ। আমাকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ — সবই করতে হয়। ক্লাস নেওয়া, রুটিন তৈরিতে সাহায্য করা, সিনিয়র কলিগের হয়ে যাবতীয় ফাইফরমাশ খাটা, কলেজে সেমিনার, ইন্টারভিউয়ের সময় ফাইলপত্র, জলের জগ বহন করা, টেবিল চেয়ার সেট করা, প্রয়োজনে লাঞ্চ বক্স এগিয়ে দেওয়া… কোনও কিছুই বাদ যায় না। গতকালই টয়লেটের সামনে জল জমেছিল বলে এক সিনিয়র কলিগ পরিষ্কার করে দিতে বললেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে কাজটা করে দিলাম। আজ সেই কলিগই স্টাফ রুমে বসে ট্যাঁরা হাসি হেসে বললেন, আমি খুব অবাধ্য মেয়ে। হ্যাঁ… আমি তখন ওনার মুখোমুখি বসে। আমাদের বসার টেবিল আলাদা। যাঁরা ফুলটাইমার টিচার, তাঁদের জন্য আবার আলাদা টেবিল বরাদ্দ, বেশ বড় টেবিল। আমরা ওঁদের টেবিল-চেয়ারে বসতে পারি না। কথায় বুদ্ধি করে পেরেক বিঁধিয়ে ওঁরা বলেন, ওটা ছোটদের টেবিল। ফুল টাইমাররা পান ভালো পোক্ত লকার। আমরা পাই জংধরা ভাঙাচোরা লকার। ওঁদের জন্য রয়েছে ঝকঝকে টয়লেট। আর আমাদেরটা? অনেক সময়ই রেলের টয়লেটকেও লজ্জা দেয়। একবার ভুল করে সেই ভিআইপি টয়লেটে ঢুকে পড়েছিলাম। এক স্নেহপ্রবণ সিনিয়র কলিগ সেটা জিবি মিটিংয়ে তুলে আমাকে অপদস্থ করতে একদম ভুলে যাননি!
এবং জিবি মিটিং। গভর্নিং বডি মিটিং। এখানেও চারিদিক আলো করে বসে আছেন নির্বাচিত কিছু ফুলটাইমার। সত্যিই তো, ওঁরাই তো যাবতীয় ফুল ছড়াচ্ছন এবং ছড়াবেন। জিবিতে আমাদের ভোট দেওয়ার কোনও অধিকার নেই। সেখানেও ভোট দিতে পারবেন শুধুমাত্র পূর্ণ সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
আমাকে মাথা নিচু করে কাজ করতে হয়। যখনই মাথা তুলতে গেছি, কে বা কারা যেন ঘাড়টা ধরে নামিয়ে দিয়েছে। অন্যায় হলে প্রতিবাদ করতে পারব না। প্রতিবাদ করলেই মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে কেউ বলবেন, চুপ থাকো। কারণ আমি যে ফুলটাইমার নই! আমি যে কার্যত আগাছা! একজন প্রণম্য দাদা এই তো সেদিন মুখের ওপর বলেই দিলেন যে তিনি আমাকে কলিগ মনেই করেন না। তাঁর স্যালারি সত্যিই আমার চেয়ে অনেকটাই বেশি।
আমি তো কলেজ দ্বারা নিযুক্ত শিক্ষিকা। আমাকে বিভাগীয় প্রধান থেকে শুরু করে প্রিন্সিপাল — এঁদের মন যুগিয়ে চলতে হয়। তাই তো অনেক অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে আপস করে চলতে হয়। নাহলে তো চাকরি বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল আছে! হয়ত আমার contract-টা আর রিনিউ-ই করাল না! কিন্তু এভাবে চলতে চলতে কখন যে পাপোষ হয়ে গেছি সেটা বুঝতেই পারিনি। এখন বুঝতে পারছি কোথায় যেন মেরুদণ্ডটাই বেঁকে গেছে। নিজের মনের বক্তব্যকে বাধ্য হয়ে চেপে দিলে এরকম দুরবস্থা তো হবেই। আমি তো কলেজে কার্যত একজন voiceless শিক্ষিকা!
আমাদের কলেজটা যেন ধর্মে, বর্ণে বিভক্ত এক টুকরো ভারত। যেন এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায় বিদ্ধ, সাদা কালোয় দ্বিখণ্ডিত দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই আমরা-ওরা-র নির্মম বিভাজন। এ কথা কে বলেছে যে মানুষ শিক্ষিত হলেই সে সত্যিই উদার হবে? পুঁথিগত বিদ্যা সবসময় চেতনার আলো জ্বালাতে পারে না।
এবার আপনার কথায় আসি। আপনি তো ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেললেন, স্বপ্না। প্রথম ভারতীয় অ্যাথলিট যিনি এশিয়ান গেমস থেকে Heptathlon-এর মতো কঠিন ইভেন্ট থেকে সোনার পদক পেলেন।… ভাবছিলাম আপনার কথা। আপনার বাবা অনেক বছর আগে ভ্যান চালাতেন, এখন তো তিনি অসুস্থ, ঘরে বসা। আপনার মা কাজ করতেন চা বাগানে। এমনকি এবার এশিয়াডে ব্যর্থ হলে আপনিও তো চা বাগানেই নিজেকে গেঁথে ফেলতেন। আপনার বাইশ বছরের শরীরটা তো প্রায় ঝাঁঝরা। কোমরে, পিঠে, পায়ে এবং দাঁতে গরম শিক ঢুকিয়ে দেওয়ার পরের যন্ত্রণা। আপনি তো প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে এবার এশিয়ান গেমসে নেমেছেন! ব্যথা কমাতে একটার পর একটা ইঞ্জেকশন নিয়েছেন। তবু শরীরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়েছে। দরমার বেড়া দেওয়া, টিনের চালওলা আপনার ছোট্ট বাড়ি জলপাইগুড়ির এক অখ্যাত গ্রামে। বাড়িতে দারিদ্র রক্তের স্বাদ পাওয়া ম্যানইটারের মতো খালি জিভ চেটে যায়। রাজমিস্ত্রির কাজ করা দাদা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও জীবনের অঙ্ক মেলাতে পারেন না। অথচ আপনি রেলের চাকরি ছেড়ে দিলেন! মেয়ের সাহস দেখো! আপনার লক্ষ্য ছিল একটাই। যেভাবেই হোক এবারের এশিয়ান গেমসে ভালো ফল করা। ক্রমাগত বিদ্রোহ করতে থাকা শরীর নিয়ে যেভাবে রেকর্ড সংখ্যক পয়েন্ট স্কোর করে Heptathlon-এ সোনা জিতলেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আপনার জীবনের তালিকায় প্রায় সব কিছুই তো না বা নেই-তে পূর্ণ। আপনি সেই সব কিছুকে পাত্তাই দেননি। আপনার দুটো পায়েই তো ছ’টা করে আঙুল। আপনি তো আগে আর পাঁচজনের মতো পাঁচ আঙুল বিশিষ্ট জুতো পরেই খেলতেন। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। তবু একদিনের জন্য ট্র্যাক ছেড়ে পালিয়ে যাননি। অভিযোগ করা আপনার ধাতে নেই। পালিয়ে গেলে এবারের জাকার্তা এশিয়াডে সোনা পেতেন না। জলপাইগুড়ি থেকে জাকার্তা — আপনার এই দৌড় বাংলা তথা ভারতীয় Atheletics-এর জগতে এক স্বর্ণোজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে।
এবং দ্যুতি চন্দ। আপনার মতই খুব গরিব বাড়ির মেয়ে। বাড়ি ওড়িশায়। বয়স ২২। ছোটবেলায় স্পোর্টস শু কেনার টাকা ছিল না। তবু মনে জ্বলতে থাকা “কিছু করতেই হবে” নামক আগুনের দৌলতে দৌড়তেন। দ্যুতির শরীরে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে পুরুষ হরমোন — এই কারণে তাঁকে ২০১৪ সালে নির্বাসিত করা হয়।
পণ্ডিতরা ভাবলেন দ্যুতির জীবনে নেমে এল এক অনন্ত আঁধার। একা হয়ে যান উনি। কেউ ভালো করে কথা বলেন না। বিষাক্ত ব্যঙ্গবিদ্রূপের Concentration Camp-এ ঠেলে দেওয়া হয় ওঁকে। দ্যুতি ঠিক করলেন একবার মরণ কামড় দেবেনই। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় এবং প্রকৃতই দ্রোণাচার্য পি গোপীচন্দ। কঠিন এক আইনি লড়াই জিতলেন দ্যুতি। তবু ব্যঙ্গবিদ্রূপের বাণে ক্রমাগত রক্তাক্ত হয়েই যাচ্ছেন। প্রায় সবাই যখন ভাবলেন উনি ফিনিশড, এবারের এশিয়ান গেমসের ট্র্যাকে আলো ছড়িয়ে দুর্দান্তভাবে দৌড় ফিনিশ করলেন। পেলেন দু’টো পদক। এক অনন্য দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হল জাকার্তা এশিয়াড। যারা ওঁকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল তাঁদের উপযুক্ত জবাব দিলেন দ্যুতি।
এবং মধুমিতা কুমারী। বাড়ি ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। বয়স ২১। বাবা কয়লার ডাম্পার চালান। চোখে ও ফুসফুসের কোণে জমা হয় কয়লার গুঁড়ো। কোথায় যেন জীবন হাঁফিয়ে ওঠে। মধুমিতা কুমারীর এলাকায় মেয়েরা অল্প লেখাপড়া শিখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়। কিন্তু মধুমিতা তিরন্দাজির প্রেমে পড়ে গেল। তখন ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। রোজ আট কিলোমিটার হেঁটে তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ নিতে যায়। গ্রামের লোকেরা প্রশ্ন করে, এতটা রাস্তা ঠেলে তীর-ধনুক চালিয়ে ছ্যাবলামো করার কোনও মানে হয় কী? মেয়ে বরং মন দিয়ে রান্নাটা শিখুক। ওটাই তো বিয়ের পর কাজে লাগবে। যথারীতি ছুঁড়ে দেওয়া হয টিটকিরি। তবু ছোট্ট মেয়েটি শক্ত হাতে তীর ধনুক ধরে নিজের টার্গেটে অবিচল থাকে। যার ফলশ্রুতি হিসেবে এবার এশিয়ান গেমসে রুপোর পদক ছিনিয়ে নিলেন। হ্যাঁ স্বপ্না, আপনার যেমন পাশুপত হল অদম্য জেদ, তেমন ওটাই মধুমিতার প্রধান অস্ত্র।
এবং বাঙালি তীরন্দাজ পিনাকী উপাধ্যায়। বয়স তিরিশ। অসম্ভব প্রতিভাবান। একচিলতে ঘর শংসাপত্র এবং মেডেলে পরিপূর্ণ। বেশ কয়েকবছর হল বাবা মারা গিয়েছেন। আর্থিক সমস্যায় মাঝে খেলা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। থাকেন ভাড়া বাড়িতে। স্থায়ী কোনও চাকরি নেই। পাশে শুধু মা। দুর্দিনে সবাই সরে পড়েছেন। আর পিনাকীর গায়ে ছুঁড়ে দিয়েছেন অবহেলা এবং অপমানের থুতু। পিনাকীর কাছে আজ আর আধুনিক ফাইবার গ্লাসের ধনুক নেই। চোখের জল এবং হতাশা কামড় বসায় ঠিকই, তবু অদম্য এক জেদের বশবর্তী হয়ে এই সময়েও হাতে তুলে নেন বাঁশের ধনুক! হাতে যেহেতু বাঁশের ধনুক, লোকে শুধুই ঠাট্টার হাসি হাসে, রোদে পুড়ে জলে ভিজে প্রায় নিরন্ন পিনাকী নিজের অনুশীলন করে যান — একদম একা। উনি ঠিক করেছেন হারার আগে হারবেন না। শেষ দেখে তবেই ছাড়বেন। অর্থহীন, বন্ধুহীন পিনাকী রূঢ় বাস্তবের বিধ্বংসী প্লাবনের মধ্যে জীবনের নৌকোর হাল শক্ত করে ধরে বসে রয়েছেন।
স্বপ্না, আপনি জীবনযুদ্ধের ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের বিরুদ্ধে লড়ে জিততে পেরেছেন। পেরেছেন দ্যুতি, মধুমিতা কুমারীরা। মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পিনাকী। আমিও শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম নিজের জীবনটা নিজের মতো করেই বাঁচব। কারও দয়াদাক্ষিণ্যের প্রয়োজন নেই। আপনি, দ্যুতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক, কেউ যদি পরিশ্রম এবং অন্তর্নিহিত প্রতিভার সঠিক মেলবন্ধন ঘটাতে পারে, তাহলে সে সাফল্য পাবেই। আজকের এই পাইয়ে-দেওয়া সর্বস্ব সমাজে আপনারা প্রমাণ করলেন কঠিন শ্রমের আজও মূল্য আছে। আমি হয়তো পরিস্থিতির শিকার, কিন্তু নির্ভেজাল পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে পর্যন্ত শিকার করা যায়! ধন্যবাদ স্বপ্না, আপনাদের অনুপ্রেরণায় আবার নতুন করে লড়াই করার রসদ খুঁজে পাচ্ছি। নিজের কী নেই আর ভাবছি না। আরে, জেদটা তো আছে! বুকের মধ্যে কিছু করার আগুনটা তো দাউদাউ করে জ্বলছে! ওটাই যথেষ্ট।
আজ ভোরবেলা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।… ঘুমের মধ্যে হাজির এক খিদ্দা। সেই কোনি সিনেমার মতো। খিদ্দা বলে, আর ঘুমোস না, ওঠ। ফাইট, সোমা ফাইট…
এক নতুন কিছুর স্বপ্নে এক নতুন উদ্যমে জেগে উঠি…
বলুন তো স্বপ্না, আমাদের জীবন যেখানে শুধু অজস্র না-তে ভর্তি, যেখানে লোক বলতে শুধু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদেরই বোঝায় যারা হাসতে হাসতে আমাদের ধাক্কা মেরে গর্তে ফেলে দেয়,… সেখানে আমাদের চোয়াল চাপা দুর্দম লড়াই ছাড়া আর আছেটা কী?
ভালো থাকবেন।
ইতি–
আবার নতুন উদ্যমে বাঁচতে চাওয়া,
সোমা