সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কুরাশ, উশু, সেপাকটাকরো… না না ছাপার ভুল নয়। এই সবগুলোই একেকটা খেলার নাম, যেগুলোর নাম আমি আপনি শুনিনি… কিন্তু ভারত জাকার্তায় অষ্টাদশ এশিয়াডে একাধিক পদক পেয়েছে এই সবকটাতেই। সব মিলিয়ে ৬৯টি পদক (এখনও অবধি বিগত সব এশিয়াডে ভারতের পদক শিকারের বিচারে সবথেকে বেশি) যার মধ্যে ১৫টা সোনা। সব মিলিয়ে ভারত অষ্টম স্থানে, সোনার নিরিখে। ১৯৫১ সালে দিল্লিতে প্রথম এশিয়াডের পর এত সোনা ভারত পায়নি আগে। আসুন একটু ছুঁয়ে দেখি কিছু জ্যান্ত রূপকথা।
সৌরভ চৌধুরী, বছর ষোলো-র বিস্ময় বালক। আয়নার সামনে কব্জিতে ইট বেঁধে অনুশীলন করতেন, হাত স্থির করার জন্য। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ভারতকে সোনা এনে দিয়েছেন তিনি।
তাঁর থেকে বয়সে অল্প ছোট, পনেরো বছরের শার্দুল ভিহান ডাবল ট্র্যাপ শুটিং-এ পেয়েছেন রুপো।
দুর্ঘটনায় আহত রাহী স্বর্ণাওয়াতকে এখনও হাসপাতালে যাতায়াত করতে হয়, তবুও এরই মাঝে ২৫ মিটার পিস্তল শুটিং-এ স্বর্ণ পদক পেয়েছেন।
শুটারদের এই বোলবোলার মধ্যেই পদক পাননি ষোলো বছরের মানু বেখার এবং পনেরো বছরের স্কুল পড়ুয়া অনিশ ভানওলা। দুজনেই কমনওয়েলথ বিজয়ী। এর মধ্যে মানু এশিয়াড কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে রেকর্ডও করেছিলেন। পরবর্তী আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁদের কাছ থেকে সোনা আসা শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া তৃণমূল ভিত্তিতে যে কাজ শুরু করেছেন, মধ্যপ্রদেশ সরকারের ভোপাল একাডেমি বা গগন নারাঙ্গের ‘গান ফর গ্লোরি’ উদ্যোগ তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর প্রতিভাবান শুটার উঠে আসছেন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে।
এবার আসি অ্যাথলেটিক্সে। ভারতের অ্যাথলেটিক্স বিগত দশকে উন্নতি করেছে প্রচুর, এবারের গেমসে ১৯টি পদক এসেছে শুধুমাত্র এখান থেকেই। ১৯৫১-র পরে সবথেকে বেশি।
আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ধিংগের মেয়ে অনূর্ধ্ব ২০-র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিমা দাস, ইভেন্ট শেষ হবার পর নাকি বাবাকে বলেছিলেন, তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে, আমি তখন পদক জিতছিলাম। ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর দৌড় অবশ্য উত্তেজনায় টানটান হয়ে দেখেছে দেশবাসী, ৪০০ মিটারে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের সাথে কাঁটায় কাঁটায় টক্কর দিয়ে রুপো।
সদ্য সমাপ্ত কমনওয়েলথ গেমসে শরীরে অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন পাওয়ার এক বিতর্কিত এবং অবৈজ্ঞানিক অভিযোগে সুযোগ পাননি দ্যুতি চাঁদ। ফেডারেশনও নির্লিপ্ত ছিল। আজ ১০০ ও ২০০ মিটারে রুপো (পি টি ঊষার পরে প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে এশিয়াডে জোড়া পদক) পেয়ে তাঁর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল।
স্বপ্না বর্মণ, হেপ্টাথলনের ইতিহাসে ভারতের প্রথম সোনা আনার পরে ট্র্যাকে বসে থাকা তাঁর দুই পায়ের ছ ছ আঙুলের মাটিমাখানো ফোস্কার ছবি, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যালবামে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। কোনও স্পেশ্যাল জুতোর ব্যবস্থা ছিল না তাঁর জন্য, সাধারণ পাঁচ আঙুলের উপযোগী জুতো নিয়ে প্রবল যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে তাঁর এই মহাদেশ বিজয়। একই ইভেন্টে অল্পের জন্য পদক পাননি পূর্ণিমা হেমব্রম।
এই নিয়ে পাঁচ পাঁচ বার মেয়েদের ৪*৪০০ মিটারে সোনা জিতল ভারতীয় দল। কিন্তু, এবারে বাহরিনের আফ্রিকায় জন্মানো অ্যাথলিটদের নিয়ে বানানো টিমকে টেক্কা দেবার জন্য দরকার ছিল মাস্টার স্ট্র্যাটেজির। নবাগতা বিস্ময়াকে নামিয়ে এবং দ্রুততম ভারতীয় হিমা দাসকে শেষে না নামিয়ে প্রথমে শুরু করিয়ে ভারতীয় কোচ গালিনা বুখারিনা বাজিমাত করলেন এবারেও।
ছেলেদের ১৫০০ মিটারে জিনসন জনসন সোনা পেলেন রিও অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয়ীর চেয়ে দ্রুততর সময়ে। ৮০০ মিটারে সোনা পেলেন মঞ্জিত, কে বলবে মাত্র কয়েক মাস আগেও ওএনজিসি-র চুক্তিভিত্তিক চাকরি যাবার পর পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন তিনি।
জ্যাভেলিনে নীরজ চোপড়া, জুনিয়র বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী, নিরাশ করেননি। দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর থেকে প্রায় ৬ মিটার বেশি ছুঁড়েছেন। ৪৮ বছর পর ট্রিপল জাম্পে ভারতের সোনা নিয়ে এলেন অরপিন্দার সিং। তেজিন্দার পাল সিং তূরের ছোঁড়া শট পাটে শুধু সোনাই আসেনি, চুরমার হয়ে গেছে এশিয়াড রেকর্ড। এছাড়া বক্সিঙে আগের বারের মতো ফাটাফাটি না হলেও সোনা পেয়েছেন অমিত পাঙ্ঘাল, তাও অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে।
মহিলাদের কুস্তিতে ভারতের ইতিহাসে প্রথম সোনা এল বিখ্যাত ফোগোট পরিবারের, ভিনেশ-এর প্যাঁচে, আর এদিকে বজরং পুনিয়ার পুরুষদের ৬৫ কেজি ফ্রি স্টাইল কুস্তিতে সোনা আনলেন। পুরুষদের ডাবলস টেনিসে চ্যাম্পিয়ন বোপান্না আর দ্বিবীজ শরণ। একটি সোনা এসেছে রোয়িং-এও।
এবারেই প্রথম ব্রিজ অন্তর্গত হয়েছিল ইভেন্ট হিসেবে, সেখানে ‘তাস দাবা পাশা তিন সর্বনাশা’ প্রবাদকে ফুঁয়ে উড়িয়ে সোনা জিতে নিলেন দুই বাঙালি প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকার। সদ্য বরিষ্ঠ নাগরিক হয়েছেন প্রণব, শিবনাথ ৫৬।
কমপ্যাক্ট তীরন্দাজিতে (যাতে লিভারের সাহায্যে ধনুকে বিভিন্ন অ্যাডজাস্টমেন্ট করা যায়) অল্পের জন্য সোনা পাননি পুরুষেরা, তবে মোটের ওপর কোরিয়া ও চিনের একচেটে সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ এবারেও।
৩৬ বছর পরে আবার পদক এসেছে অশ্বারোহী ক্রীড়ায় ফাওয়াদ মির্জার হাত ধরে, এই প্রথম পদক এসেছে মেয়েদের ব্যাডমিন্টনে (সাইনা — ব্রোঞ্জ, সিন্ধু — রুপো), সেইলিং-এ প্রথমবার মেয়েরা রুপো, ছেলেরা ব্রোঞ্জ, ষাট বছর পর টেবিল টেনিসে প্রথমবার পদক মিক্সড ডাবলস আর মেয়েদের ডাবলসে, সংস্থার আভ্যন্তরীণ গোলযোগ সামলেও স্কোয়াশে শক্তিশালী মালয়েশিয়াকে হারিয়ে মেয়েদের ও ছেলেদের পদক… প্রচুর স্বপ্নের শুরুয়াত।
এছাড়াও ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে অল্পের জন্য ভিরধাভাল খারে ব্রোঞ্জ মিস করেছেন, ২০০ মিটার বাটারফ্লাইতে জাতীয় রেকর্ড করেছেন কেরলের বন্যায় বিপর্যস্ত সজ্জন প্রকাশ। ১৫০০ মিটার দৌড়ে তাঁর পরের প্রতিযোগীর থেকে ২৯ সেকেন্ড আগে দৌড় শেষ করেও লেন চেঞ্জের অপরাধে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে পদক হারিয়েছেন গোভিন্দন লক্ষণ। প্রচুর পার্সোনাল বেস্ট আর ন্যাশনাল রেকর্ডও ধূলিসাৎ হল। সবশেষে, বাহরিন এবং কাতারের ‘ন্যাচারালাইজড আফ্রিকান নাগরিক’ অ্যাথলিটদের যোগদান না থাকলে ভারতের পদক সংখ্যা যে আরও বাড়ত তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এত সাফল্যের মাঝেও কিছু খোঁচ রয়ে গেছে অবশ্যই। পুরুষ ব্যাডমিন্টন টিমে কিদম্বি, প্রণয়ের মতো হেভিওয়েট দুজনেরই প্রথম রাউন্ডেই হেরে যাওয়া যদি অবাক করা হয়, দুই কবাডি টিমেরই বিনা সোনা ফেরত আসা এই প্রথম। দু’ক্ষেত্রেই ঘাতক, ইরান। তাঁদের মহিলা টিমের কোচ আবার ভারতীয়! হকিতে গ্রুপ লিগে ৭৬টা গোল করেও পেনাল্টি শুট আউটে সেমিফাইনালে পুরুষরা হেরে গেলেন নিচের পয়েন্টের মালয়েশিয়ার কাছে। এই নিয়ে মোটে দ্বিতীয়বার এশিয়াড হকি ফাইনাল হল ভারত অথবা পাকিস্তান ছাড়া, সেখানে পাকিস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পেলেন ভারতীয়রা। মেয়েরা ফাইনালে জাপানের কাছে হারলেন। ওয়েট লিফটিং-এ পদকহীন থাকবে ভারত, কমনওয়েলথ গেমসে ৭টা সোনাজেতা দল, সেটাও ভাবা যায়নি। কুস্তিতে অলিম্পিক পদকজয়ী সুশীল কুমারের প্রথম ম্যাচেই ছিটকে যাওয়া আরেকটা অঘটন। রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ী সাক্ষী মালিকও পদক পাননি।
ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোড় নিজে একজন অলিম্পিক পদকজয়ী, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আশা করা যেতেই পারে আগামীকালে আরও পদক আসবে, অলিম্পিকেও। ‘খেলো ইন্ডিয়া’ ব্র্যান্ড অ্যাথলেটিক্স সহ প্রচুর খেলার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু নিয়মিত অলিম্পিক পদক মানের জন্য এখনও অনেকটা দৌড় বাকি। স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার যুগ্ম উদ্যোগে চলা টপস স্কিম এবং অলিম্পিক গোল্ড কোয়েস্ট এবং গো স্পোর্টস-এর মতো সংস্থার এগিয়ে আসা অত্যন্ত ইতিবাচক, কিন্তু দিনের শেষে ব্রোঞ্জজয়ী সেপাকটাকরো টিমের সদস্য হরিশ কুমারকে যখন আবার সেই চায়ের দোকানেই ফিরে যেতে হয় — বুঝি আমরা এখনও খেলা শুধু দেখতেই ভালোবাসি।